শারমিন সুলতানা চৌধুরী
রজত আর মীরার আংটি বদল হয়েছে আজ তিন মাস। মীরার বড় বোন অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরবেন কিছুদিন পর, তখনই বিয়ে হবে। চিরাচরিত এরেন্জড ম্যারেজে যা হয়, অচেনা মানুষ, অনুষ্ঠানের আগে হয়তো দু একবার মুঠোফোনে কথা!! মীরাদের পরিবার একটু সেকেলে। তাই রজতের সাথে বাইরে কোথাও ঘুরতে যাওয়া সম্ভব না বিয়ের আগে। কিন্তু এই অপেক্ষাটার অন্য একটা মজা আছে। রাত জেগে ফোনে কথা বলা, দুজন মিলে স্বপ্ন সাজানো, ভালোবাসার দু একটি শব্দ, ভালোই কেটে যাচ্ছিলো দিন।
হীরের আংটিটা মীরার নিজের পছন্দে কেনা। না, তাকে যেতে হয়নি। যুগ টা ডিজিটাল তো। ভাইবারে ছবি পাঠিয়ে পছন্দ করিয়ে, তারা রীতিমত প্রমাণ করেছে যে, তার বেশ আধুনিক।
এনগেজমেন্টের রাতে আংগুল ছুঁয়ে আলতো করে খেলছিলো মীরা। একা একাই। কেমন একটা বন্ধন নয়!!মনে হচ্ছে মানুষটা ছুঁয়ে আছে।
"বেশি দামী হয়ে গেলো, মা, আংটি টা? "হঠাৎই রজতের কন্ঠস্বর শুনে অবাক হয়ে গেলো মীরা..হাসলো সে, গভীর প্রেমে পড়েছে, এখন হেলুসিনেশনও হচ্ছে।
"মা,তুমি কি রাগ করেছো? সোনার আংটির জায়গায় হীরের কিনলাম যে"
মীরা অবাক হয়ে গেলো,সে এসব ভাবছে কেন!! নাহয়, রজতের কথা খুব মনে পড়ছে,তাই বলে এসব ভাবছে কেন!!
"মা, কিছু করার ছিলোনা, মীরার পরিবার খুব খুতঁখুতে, তুমি দেখোনি, ওদের বেশবাস। মেলে আমাদের সাথে?কতভাবে যে ব্যালেন্স করছি..যদি ওনারা রাজি না হতো!!"
২মিনিট চুপ আংটি টা..এরপরই আবার রজত বললো, "মা, বিয়েটা তো হতে দাও, পরে দেখা যাবে...মীরা সোনার ডিম পাড়া হাস, মা। এমনি এমনি কি এগিয়েছি আমি?"
ভয়ে আংটিটা খুলে ফেললো মীরা..এসব কি হচ্ছে...ব্যাখ্যাই বা কি..সে কি এই অদ্ভুতুড়ে কাণ্ডকে বিশ্বাস করবে? একটা আংটিই তো, এটা কি যাদুর কিছু? আর যদি সত্য হয় সবকিছু? এটা প্রেমের বিয়ে নয়, সে রজতকে চেনেই বা কতদিন?? ছি ছি, এসব কি ভাবছে মীরা.. নিজেকে বকা দিলো। মনে হয়, এনগেজমেন্টের টেনশনে ঘুম না হওয়াতে এমন হচ্ছে!! রেখে দিলো সে আংটিটা..
পরদিন রজত এলো, অন্যদিনের মতোই তো সে। ধুর, মীরা কি সব ভেবেছিলো, বিয়ের চিন্তায় সব অশুভ ভাবনাই যেন ঘিরে ধরে মানুষকে..
রাতে আবারো আংটিটা পড়ে নিলো মীরা.. ঘুমোবে..। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলো তার.. আংটিটা জ্বলজ্বল করছে। আবারো রজত!!
কিন্তু কার সাথে? একটা বাচ্চা, কি পরম মমতায় রজতকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোচ্ছে..কে? ওর দাদার মেয়েটা কি? কিন্তু বাচ্চাটার পাশে মহিলাটা কে!! কিছুই বুঝে পাচ্ছে না..আজ আংটিটা তাকে এসব দেখাচ্ছে কেন.. হীরেটার মধ্যে..
আর দেরী করলোনা মীরা...গয়নার দোকানে গেলো..ওদের পরিচিত দোকান..মালিককে খুঁজলো..
হরিপদ কাকা ক্যাশেই বসেছিলেন..কাছে গেলো মীরা..
"কাকা, আমি সেদিন যে আংটিটা কিনেছিলাম, ওটা কি আপনাদের বানানো নাকি বাইরে থেকে আনিয়েছেন?"
"না,মা। আমাদের বানানো, ঠিক বানানোও নয়। একজন বিক্রি করেছিলো, আমি সেই সোনাটুকু নিয়ে আবার গড়েছি। কেন, মা?"
"আপনাদের কাছে লেখা থাকে, কে বিক্রি করেছে?"
"না,তবে একে তুমি চিনবে, তোমায় প্রলয় কাকুর মেয়ে অন্তরা। স্বামীটা অপঘাতে মরে গেলো, সে এই আংটি রাখবেনা আর। বুঝলাম না কেন, একটা স্মৃতি ছিলো.."
আর দাঁড়ালো না মীরা। হীরক’দার মৃত্যুর কথা সবাই জানে। চরিত্রহীন একটা, অন্তরা দি যে কি বুঝে প্রেমে পড়েছিলো, হাজারটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিলো হীরক’দার।সেই হীরক’দাই বিয়ের ছ' মাস পর কিনা আত্মহত্যা করে বসলো।
বাসায় ফিরলো মীরা। তাকে একবার রজতের সাথে দেখা করতেই হবে। সত্য জানা প্রয়োজন তার।
বাসার পাশে ছোট্ট কফি শপটায় রজত এলো। একথা, সে কথার পর আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো মীরা..
"রজত, তোমার দাদার মেয়েটার কথা তো সবসময় বলো, টুম্পার একটা ছবি দেখাও না"
রজত মোবাইল থেকে বের করে দেখালো..বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো মীরা, অবিকল আংটির হীরেতে দেখা সেই বাচ্চাটা!!
বাসায় ফিরে রজতদের গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর বেলাবোতে পরিচিত কাউকে খুঁজে বের করলো মীরা। ওর এক বান্ধবীর খালার বাসা ওখানে। অবাক হয়ে গেলো, ওই ঠিকানায় এখন আর কোন বাড়ি নেই। তার মানে রজত যাদের নিয়ে এসেছিলো, সবই মিথ্যে পরিচয়ে। বাবা মাকে জানালো মীরা, এতদিন ওনারা বিশ্বাস করেই বসে ছিলেন, এবার সব জেনে নিজেদের মতো করেই জানলেন, রজত বিবাহিত। অত:পর বিয়ে টাই ভেঙে দিলো মীরা..
হরিপদ কাকার দোকানে গিয়ে আংটিটা ফিরিয়ে দিলো মীরা, বলে গেলো রজতকে যেন দিয়ে দেওয়া হয়।
না, আংটি নিতে রজত আসেনি। দুদিন পরই বাইক এক্সিডেন্ট, স্পট ডেড..কেউ জানলোনা, মৃত্যুর আগে একটা সাদা শাড়ি পরা মেয়েকে দেখেছিলো রজত...শুধু একটা শব্দই শুনেছে সে..
"শাস্তি!!"
দু'মাস পর। রূপার বিয়ে, অনীশের সাথে... আংটি কোন দোকানেই পছন্দ হচ্ছে না রূপার.. কি যে বিরক্তিকর!! কাকন অপেক্ষা করছে অনীশের জন্য!!
"কাকা, ওই আংটিটা প্লিজ দেখাবেন?
সুন্দর না, অনীশ? দেখো, হীরেটা কেমন? আয়নার মতো"....