ভোলা ফারজান
আমি ভোলা ফারজান। একটা সোজা কথা পরিষ্কার করে বলতে চাই। কোনো তেলবাজির আশ্রয় নিয়ে কথাগুলো বলব না। কিছুটা সাহিত্য রসের মতো মনে হতে পারে। কিন্তু সব হাছা কইলাম।
ছোটবেলা থেকেই নিজেকে সবার থেকে আলাদা করে ভাবতাম। ঠিক স্রোতের বিপরীত। যেভাবে মহা মনীষিরা নিজেদের ভাবতেন। তবে দার্শনিকের মতো সেই ভাবনা মনেই রাখতাম। কারো কাছে প্রকাশ করতাম না। যদি হিতে বিপরীত হয়ে যায়! তখন আসলে তেমন সুযোগও ছিল না নিজেকে প্রকাশ করার।
মাঝে মাঝে প্লেটোর একটা কথাখুব আওড়াতাম। বলেছিলেন, ‘খারাপ করার কোনো সুযোগ না থাকলেই কেবল মানুষ ভালো কাজ করে।’ কথাটার মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলতাম। যেমন পানির ভেতর চিনি নিজেকে বিলিয়ে দেয়। অনেকেই বলত, আমার ভেতর নাকি সাহিত্যিক একটা ভাব আছে। গর্বে বুকটা আসমান হইয়া যাইত।
এবার মূল কথায় আসি। স্কুলে পড়ার সময় দোকানে বাকি খাইতাম। সেই টাকা দিতে অনেক সময় লাগত। এর পেছনে একটা বিশাল কারণ ছিল, যেটা আবিষ্কার করতে কেটে গেছে অনেক গুলো বছর। আসলে শিক্ষার কি শেষ আছে?
ছোটবেলায় গাছ থেকে পরে গিয়ে মাথায় আঘাত পাই। এরপর ঠিক বাংলা সিনেমার মতো আমার স্মৃতিশক্তি লোপ পায়। তবে সেটাতে কিছুটা হলিউডের ছোঁয়া ছিল। আগের স্মৃতি পুরোটা ভুলি নাই। ওই ঘটনার পর থেকে অল্প অল্প করে পেছনের স্মৃতি ভুলে যেতে থাকি। তাই ‘ফারজান’ থেকে হয়ে যাই ‘ভোলা ফারজান’। নামটার মধ্যে নিজের মতোই একটা বিশালতা খুঁজে পাই। পুরো একটা জেলাকে নিজের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া কি চাট্টিখানি কথা!
একদিন বিকেল বেলা গ্রামের পুকুড় পাড়ে বসেছিলাম। এক দোকানী এসে বলল, আমার কাছে নাকি ১০ হাজার টাকা পাওনা আছে। শুনে একেবারে টাশকি খেয়ে গেলাম। ঠিক আসমান থেকে মাটিতে পড়ার দশা। কি কয় এসব। জীবনে আমি যেখানে কারো কাছে বাকি খাই নাই, সেখানে ১০ হাজার টাকা পাওনা! অনেক দিন চেয়ে অবশেষে দোকানী আল্লাহ রাস্তায় ছেরে দিয়েছে। নিজেকে একটু পরহেজগার পরহেজগার মনে হতে লাগল। বাহ! এত সুন্দরভাবে আল্লাহর রাস্তায় নিজেকে সপে দিলাম? বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেও সেই স্মৃতি ভালো হয় নাই। খাইলে টাকা দিতে ভুলে যাই, পরে আর সেটার কথা স্মরণ থাকে না। এভাবে আমার জীবন চলছে রোমান্টিক গতিতে। কিন্তু ছেদ পড়লো কয়েক দিন আগে। পত্রিকার পাতায় যখন মিষ্টি একটা খবর দেখলাম। খবরটি থেকে হাছনা হেনার গন্ধ আসতে থাকে আমার দিকে।
দেখলাম, হলের ক্যান্টিনে ২০১৬ সালের আগস্ট পর্যন্ত একটি খাতায় পাওনা ২৬ হাজার ৭০০ টাকা। ৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৯ অক্টোবর পর্যন্ত বাকি ২ হাজার ১৯০ টাকা, একই মাসের ১৭ থেকে ২১ তারিখ পর্যন্ত ৩ হাজার ২৪০ টাকা। রাতের খাবার বাবদ কোনো দিন ২৮০ টাকা আবার কোনো দিন ২৫০ টাকা, নাস্তা বাবদ ৫০, ৭৫, ১২০ এই রকম অংক মিলিয়ে এ বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হিসাব দাঁড়ায় ৮ হাজার ৪৯২ টাকায়। সে হিসাবে শুধুমাত্র দুটি হিসাবের খাতায় ৩৫ হাজারের মতো উঠানো আছে। এছাড়া হিসাবের বাইরে আরও ৩৫-৪০ হাজার টাকা খাওয়ার হিসাব ক্যান্টিনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে।
অংকে কাঁচা ছিলাম ছোট বেলায়। এখনও সেই ঘোর কাটেনি। কিন্তু ফেসবুকে যা দেখছি, তাতে নিজেকে প্রকাশ না করে পারলাম না। আসলে নিজের স্মৃতির কারণে বাকির কথা ভুলে যাই। এটা কি আমার অপরাধ? মর্যাদাকর পেশার কথা তুলে আমার এসব কাজ নিয়ে অনেকে উল্টো প্রশংসা করছেন, যেটাকে ঘুরিয়ে বললে—বাঁশ দিচ্ছেন।
ফেসবুক ব্যবহারকারীদের উদ্দেশ্যে বখতিয়ার খিলজীর সুরে বলতে চাই, আমায় ভুল বুঝবেন না। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা খারাপ হওয়ায় নিজের স্মৃতি এখনো ঠিক করতে পারি নাই। তাই, বাকি খাইছি, লজ্জা দিবেন না।