• ০৫ ডিসেম্বর ২০১৭ ২০:২৩:৪৮
  • ০৫ ডিসেম্বর ২০১৭ ২০:২৩:৪৮
অন্যকে জানাতে পারেন: Facebook Twitter Google+ LinkedIn Save to Facebook প্রিন্ট করুন
বিজ্ঞাপন

অনুপমের লাশ

হাফিজুর রহমান। ফাইল ছবি


হাফিজুর রহমান:


যে শিশুটি বইয়ের বোঝা বইতে বইতে রোজ ক্লান্ত হয়ে একাই স্কুলে আসে আজ সে আজ তার বাবার সাথে স্কুলে এসেছে। স্কুল ব্যাগটি বাবার হাতে দিয়ে অনেকটা নাচের ভঙ্গিতে স্কুলে ঢুকতেই গেটে বাঁধ সাধেন স্কুলের দারোয়ান। কারণ আর কিছু নয়, দারোয়ান এই লোকটিকে কখনও দেখেননি আগে। লোকটি যে আর কেউ নয়, অনুপম এর বাবা সেটা তাদের জানা ছিলোনা। আর জানবেই বা কি করে, অনুপমের বাবা কখনও স্কুলে আসেনা। খুব প্রয়োজন হলে অনুপমের মা এসে স্কুলের বেতন দিয়ে যায়। স্কুলের বেশীরভাগ ছাত্রছাত্রীর অভিভাবক গাড়িতে চড়ে সন্তানদের স্কুলে নিয়ে আসেন এবং স্কুল শেষে গাড়িতে করে নিয়ে যান। 

অনুপমের বাবার কোন গাড়ি নেই তবে ইচ্ছা আছে ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় অফিসার বা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার তৈরি করবেন। এলাকার নামকরা স্কুলে ভর্তি করার পর অনুপমের বাবা কৌশিকের অন্য থানায় বদলী হওয়ায় সমস্যায় পড়ে যান তিনি। ছুটে যান উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের কাছে বদলী বাতিলের জন্য। কিন্তু কোন কথায় কাজ হয়নি। অসুস্থ অনুপমের মায়ের আর কখনও সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা নেই। নিয়মিত ডাক্তারের চিকিৎসা নিতে হয় তার। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েই কৌশিক অন্য থানায় যোগদান করেন।

অনুপম তার বাবাকে পরিচয় করিয়ে দেয় দারোয়ানের সাথে। কৌশিক নিজেও পরিচয় দেয় নিজেকে একজন গর্বিত পুলিশ বিভাগের সদস্য হিসেবে। দারোয়ান সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করে কেন তিনি স্কুলে আসেননা?খুব সহজভাবে উত্তর দেয় কৌশিক। যখন কৌশিক স্কুলে ভর্তি হয় তখন তিনি এই এলাকার থানায় কর্মরত ছিলেন। কিন্তু জানুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে বদলী হয়ে চলে যান এই জেলারই অন্য থানায়। আর থানার ডিউটির চাপে তিনি সময়ের অভাবে স্কুলে আসতে পারেননা। নাইট ডিউটি করে যদি কখনও সময় পাওয়া যায় সে সময়ে এসে অনুপমের মাকে ডাক্তারের নিকট নিয়ে চিকিৎসা করাতেই সময় শেষ হয়ে যায়। মাঝে অনুপমের মা অনেক অসুস্থ হয়ে পড়লে পাঁচ দিনের ছুটি নিয়ে এসেছিলেন কিন্তু স্কুলে আসার সময় পাননি তিনি। ছোট্ট এই ছেলেটি একাই স্কুলে আসে যায়। পুনরায় এই থানায় বদলী হওয়ার আবেদন দিয়েছেন কৌশিক কিন্তু কর্তৃপক্ষের দয়া এখনও পাওয়া যায়নি।

কৌশিকের থানায় মোবাইল ডিউটি আজ। মনটা সকাল থেকেই কেমন খারাপ লাগছে তার। কোন কিছুই ভাল লাগছেনা কৌশিকের। বাসায় ফোন দিয়ে অনুপমের মায়ের সাথে কথা বলে। অনুপমের মাও সে রাতে খুব দুঃস্বপ্ন দেখেছে বলে জানায়। অনুপমের আজ বাংলা পরীক্ষা স্কুলে। ফোনে অনুপমকে দোয়া করে দেয় কৌশিক এবং ভাল করে পরীক্ষা দিতে পরামর্শ দেয়। এক ঘন্টা পর হঠাৎ স্কুল থেকে ফোন আসে কৌশিকের মোবাইলে। আসার পথে স্কুলের সামনে রোড এক্সিডেন্টে অনুপম মাথায় আঘাত পেয়ে অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে। অজ্ঞান অবস্থায় তাকে স্থানীয় ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে। ডাক্তার বলেছে অবস্থা খুব ভাল নয়, দ্রুত উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিতে হবে। কৌশিকের চোখে মুখে আতঙ্কের ছাঁপ দেখা যায়। চোখের জলে তার বুক ভেসে যাচ্ছে। যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট বিষয়টি জানিয়ে দ্রুত রওনা হয় কৌশিক। বাসায় ফোন দিয়ে অনুপমের মাকে ক্লিনিকে চলে যেতে বলে। মফস্বল শহরের খানাখন্দে ভরা ভাঙ্গা রাস্তা দিয়ে কোন রকম ছুটে চলে কৌশিকের গাড়ি। শীতের সকালে ঘাম ঝরে পড়ছে তার শরীর থেকে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে যতই ছুটে চলে গাড়ি ততই কৌশিক ক্লান্ত হয়ে পড়েন।

মহাসড়কে ওঠার পর দ্রুত ছুটে চলছে কৌশিকের গাড়ি। তবুও বারবার বলছে আরও জোরে গাড়ি চালাতে। উড়ে যেতে চাইছে কৌশিক ঝড়ের গতিতে। একমাত্র ছেলের দূর্ঘটনার খবরে সে দিশেহারা। মনের মধ্যে নানা আশঙ্কার বানী উচ্চারিত হচ্ছে। আর কখনও কৌশিকের স্ত্রী সন্তান নিতে পারবেনা। অনুপমের জন্মের সময় সিজারিয়ান ডাক্তারের এই কথাগুলো বারবার কৌশিকের অন্তরে বেজে চলছে। নিজের বাবা মা ও অনুপমের নানা বাড়িতে ইতোমধ্যে ফোন করে দূর্ঘটনার খবর জানানো হয়েছে। তারাও খবর শুনে রওনা হওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে অনুপমের মায়ের মোবাইল থেকে ফোন আসে। ফোন ধরে ছেলের খবর জানতে ব্যাকুল কৌশিক জিজ্ঞাসা করে তার অনুপম কেমন আছে। ক্লিনিকের নার্স সেই ফোন থেকে জানান অনুপমের মা জ্ঞান হারিয়েছে, তাকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। কৌশিককে দ্রুত ক্লিনিকে আসতে বলেন নার্স। অনুপমের কি খবর জানতে চাইলে কোন উত্তর না দিয়ে ফোনের লাইন কেটে দেয়।

কৌশিকের হার্টবিট বেড়ে যায় কয়েকগুন। নিজেকে সামলে নিতে কষ্ট হয় তার। ঘামে ভিজে যাচ্ছে শরীর, চোখের সামনে অন্ধকার পৃথিবী। নিজের পেশাটাকে বিষময় মনে হচ্ছে তার। থানা থেকে বদলী না হলে এরকম পরিস্থিতী হয়তো তাকে গ্রাস করতে পারতো না। গাড়ি এগিয়ে চলছে তার নিজস্ব গতিতে। নিজেকে সামলে নিয়ে কৌশিক ফোন দেয় অনুপমের মায়ের মোবাইলে। না কেউ ফোন রিসিভ করছে না। আরও দুশ্চিন্তা হয় কৌশিকের। ক্লিনিকের গেটের সামনে পৌঁছাতেই অনেক মানুষের ভিড় ঠেলে ভিতরে ঢুকে রিসিপশনের সামনে স্ট্রেচারে রক্তাক্ত সাদা কাপড়ে ঢাকা লাশ দেখতে পেয়ে হৃদয়ের মধ্যে একটা শক্ত ঝাঁকুনি অনুভব করে কৌশিক। বুঝতে আর বাকি থাকেনা কি ঘটে গেছে এরই মধ্যে। 

খবর পেয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ সহ অন্যান্য অফিসার ও সহকর্মী ছুটে এসেছেন। তারা কি বলে শান্তনা দিবে কৌশিককে, খুঁজে পায়না। পাশের কেবিনে চিকিৎসাধীন অনুপমের মা জ্ঞান হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়েছে আগেই। অধিক শোকে পাথর হয়ে যাওয়া কৌশিক কান্নার বর্ণমালা খুঁজে পায়না হৃদয়ের ডিকশোনারীতে। সম্মূখে স্কুলের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের মুখের পানে তাকিয়ে কি যেন বলতে চায় কৌশিক, কিন্তু বলতে পারেনা। অফিসার ইনচার্জকে শুধু বলে দেয় এই চাকুরীটা তার আর করা হবেনা। যে চাকুরী তার আদরের সন্তানকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ সে চাকুরী তার প্রয়োজন নেই। মোবাইল ফোনে বাড়িতে ও শশুর বাড়িতে ফোন দিয়ে তাদেরকে আসতে নিষেধ করে বলে, তাদের আসতে হবেনা বরং অনুপমের লাশ নিয়ে সে নিজেই বাড়িতে আসছে।

লেখক: হাফিজুর রহমান, বাংলাদেশ পুলিশে কর্মরত।

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
Page rendered in: 0.1463 seconds.