প্রতীকী ছবি
হাফিজুর রহমান:
অনেক অনুনয় বিনয় করেও থানার গেটের পুলিশটার মন গলাতে পারেনি সুরুজ মিয়া। সেই ভোরে ফজরের নামাজ পড়ে বাসা থেকে বের হয়েছেন। নামাজ পড়ে রোজ হাঁটাহাঁটি করেন প্রাইমারি স্কুলের রিটার্ড প্রধান শিক্ষক সুরুজ মিয়া। তবে নামাজ পড়ে কিছু হালকা খাবার মুখে দিয়ে তারপর হাঁটতে বের হন। ডায়াবেটিকস ধরা পড়ার পর থেকেই তিনি নিয়ম করে রোজ হাঁটেন। তবে আজ আর খেয়ে বের হওয়া সম্ভব হয়নি।
পাশের বাড়ির দারোয়ান এসে খবর দিয়ে গেছে একমাত্র ছেলে ফিরোজকে রাতে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে থানায়। অনেক রাত পর্যন্ত টিউশনি করে বাসায় ফেরে ছেলেটা। মাঝে মাঝে রাত বেশী হলে বাসায় ফিরে আসে না। আজও সেরকম কিছু হয়েছে বলে ভেবেছিলো সুরুজ মাস্টারের পরিবার।
খুব ক্ষুধা পেয়েছে সুরুজ মিয়ার। কিন্তু ছেলেটি হয়তো সারা রাত কিছু খেতে পারেনি এই ভেবে নিজেও খেতে যেতে পারছেন না। অবসরে যাবার পর থেকে পেনশনের যে টাকা পায় আর ছেলে ফিরোজ মিয়া টিউশনি করে যে আয় করে তা দিয়ে শহরের এই ছোট্ট বাড়িতে ভালোই কেটে যাচ্ছে তাদের ছোট্ট সংসার। ঘাড়ে রাইফেল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশকে লক্ষ্য করে শেষ বারের মতো জিজ্ঞাসা করে ফিরোজকে নাস্তা দেয়া যাবে কিনা?
ঘাড় থেকে রাইফেল নামিয়ে পুলিশ লোকটি আবার জানিয়ে দেয় স্যার না আসা পর্যন্ত কোন কিছুই সম্ভব না।
বয়সের ভারে নুয়ে পড়া রিটায়ার্ড স্কুল মাষ্টার মাথা নিচু করে থানার পাশে পুকুরের পাড়ে গিয়ে সজনে গাছটির তলায় বসে। দু-এক ফোঁটা শিশিরের পানি ঝরে পড়ে গায়। সেদিকে তেমন ভ্রুক্ষেপ নেই, শুধু ভাবে তার ছেলের কি অপরাধ? কেনোইবা পুলিশ তার ছেলেকে গ্রেপ্তার করেছে? এইসব ভাবতে ভাবতে পেটের ক্ষুধা ভুলে গেছেন সুরুজ মিয়া।
২.
চাচা মিয়ার ছেলের নাম কি ফিরোজ মিয়া?
পিছনে তাকিয়ে সালাম দিয়ে উত্তর দেয় সুরুজ মিয়া, জি আমার ছেলের নাম ফিরোজ মিয়া।
কবে থেকে এই ব্যবসা করে?
জ্বি, ওতো কোন ব্যবসা করেনা, বাসায় বাসায় টিউশনি করে।
আরে রাখেন টিউশনি ফিউশনি, ওসব মুখোশ। মুখোশের আড়ালে কি ব্যবসা করে সেটা বলেন।
না বাবা আমার ছেলে অন্য কোন ব্যবসা করে না। সারাজীবন শিক্ষকতা করে ছেলেকে সৎ পথে মানুষ করেছি। পেনশনের এককালীন যে টাকা পেয়েছিলাম তা দিয়ে শহরে একটু জায়গা কিনে আর গ্রামের বাড়ির জমিজমা বেঁচে কোনরকম একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই করেছি।
এইসব গল্প স্কুলের ছোট ছেলে মেয়েদের শোনাবেন। আপনার ছেলে ইয়াবা সহ ধরা পড়ছে। ওর পকেটে ইয়াবা পাওয়া গেছে। এখন বুঝবেন মাস্টারের মান সম্মান কোথায় যায়। খালি মাস্টারি করা অভ্যাস। যারে পায় তারে পড়াইতে চায়, যত্তোসব।
বাবা আমি আমার ছেলেকে এই শিক্ষা কখনও দেই নাই যে সে ইয়াবা বিক্রি করবে। সেদিন পাড়ার নামকরা ইয়াবা ব্যবসায়ী ছমিরনকে যখন পুলিশ আটক করে তখন কেউ পুলিশের কাছে সিজার লিস্টে সাক্ষী দিচ্ছিলো না, ফিরোজই সাক্ষী হয়ে পুলিশের সিজার লিষ্টে সই করেছিলো।
অতো কাহিনী বলে লাভ নেই। এখন মানসম্মান বাঁচাতে চাইলে স্যারের সাথে যোগাযোগ করেন। নইলে জেলের ঘানি টানতে টানতে জীবন যাবে। একবার মাদক ব্যবসায়ীর লিস্টে নাম উঠলে স্বয়ং ভগবানও সে নাম মরার আগে কাটতে পারে না।
বাবা আমি মাস্টার মানুষ। ছেলেটাও আমার মতো সৎ হয়েছে। রাস্তা দিয়ে হেটে যাবার সময় ডানে বামেও তাকিয়ে দেখে না। সারাদিন টিউশনি করে ক্লান্ত হয়ে রাতে বাসায় ফিরে চুপচাপ খেয়ে শুয়ে পড়ে। বাবা তুমি আমার ছেলের মতো। আমার মানসম্মান নষ্ট করো না। তোমাদের স্যারের সাথে একটু দেখা করিয়ে দেও। তিনি যা বলেন তাই করবো।
বলবে আর কি? শেষ পর্যন্ত ঘুরে এই সামছুর সাথেই কথা বলতে বলবে। উঠুক স্যার ঘুম থেকে। ততোক্ষণ বসে থাকেন।
বাবা ফিরোজকে একটু নাস্তা খাওয়ানো যাবে?
ওর পকেটে টাকা ছিলো। সেই টাকা দিয়ে রাতে ভাত খাওয়াইছি, রিক্সা ভাড়া দিয়ে আপনার পাশের বাসার দারোয়ানের কাছে খবর দিয়ে আইছি, সকালে ডিম পরোটা দিয়ে নাস্তা করাইছি। আপনি কোন চিন্তা কইরেননা। এই সামছু থাকতে কোন চিন্তা নেই। সব মুশকিল আসান হবে।
সুরুজ মিয়া কেঁদে দিয়ে সামছুর হাত চেপে ধরে বলেন, বাবা তুমি আমার মানসম্মান রক্ষা করো। আল্লাহ তোমারে আপদ বিপদ থেকে রক্ষা করবেন।
সামছু মিয়া এবার কিছুটা নড়েচড়ে দাঁড়ায়। চাচা বুঝেন তো মাদকের মামলা। জানাজানি হলে আর কিছু করার থাকবেনা। স্যার থানা কোয়াটারের বাসায় ঘুমাচ্ছেন। চলেন বাসায় গিয়ে দেখি স্যারের সাথে কথা বলে কিছু করা যায় কিনা।
মাদকের মামলা খুব খারাপ, এইটুকু প্রাইমারি স্কুলের রিটায়ার্ড মাস্টার সুরুজ মিয়া বুঝেন। সত্য হোক মিথ্যা হোক এলাকার কেউ বিশ্বাস করবেনা। সবাই মাস্টারের দিকে আড়চোখে তাঁকিয়ে দেখবে এটাই স্বাভাবিক। পেটের ক্ষুধা কখন হারিয়ে গেছে ভুলে যায় সুরুজ মিয়া। সামছুর পিছনে হেঁটে চলে আর ভাবে, যেভাবেই হোক এই জঘন্য মামলা থেকে রেহাই পেতে হবে। থানার পিছনে একটি বাসার সামনে এসে সুরুজ মিয়াকে দাঁড়াতে বলে ভিতরে যায় সামছু।
৩.
একা একা দাঁড়িয়ে আকাশ পাতাল ভাবতে থাকেন সুরুজ মাস্টার। জীবনে কখনও কোন অন্যায়ের সাথে আপোষ করেননি। আজ শুধু মানসম্মান রক্ষা করতে যা করতে হয় তাই করবেন বলে মনকে কঠিন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সুরুজ মাস্টারের অনেক ছাত্র এখন এসপি, ওসি। তাদেরকে আগে থেকে জানানো যাবে না। যেভাবেই হোক ফিরোজকে আগে থানা থেকে ছাড়াতে হবে। তারপর যা করার করবে।
সামছু ফিরে এসে ডেকে নিয়ে বাসার ভিতরে নিয়ে যায় সুরুজ মিয়াকে। সামনের ড্রয়িং রুমে বসে থাকে দুজনেই। সাদা সফেদ লুঙ্গী ও ফুল হাতা গেঞ্জি পরে বেরিয়ে আসেন একটি লোক। সুরুজ মাস্টার দাঁড়িয়ে সালাম দেয়ার আগেই লোকটা সালাম দেয়। সালামের উত্তর দিতেই এসআই রজব আলী সুরুজ মাস্টারকে ঠিকই চিনতে পারে। নুয়ে পড়ে পায়ে হাত দিয়ে পদধুলি নেয় দারোগা রজব আলী। তারপর বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, স্যার আপনি? আমি রজব আলী খন্দকার, রেজা খন্দকারের ছেলে। আপনার স্কুলের ছাত্র ছিলাম স্যার। বাবা এখানে শিক্ষা অফিসে চাকুরী করতেন।
সুরুজ মাস্টার ভালো করে তাকিয়ে দেখে চিনতে পেরে চোখ থেকে চশমাটা খুলে অশ্রু মুছে আর আশির্বাদ করে বলে, তোমরা আছো বলে আজও বাঁচতে গর্ববোধ হয়। আমি গর্ব করে তোমাদের কথা সকলকে বলি।
রজব আলী ব্যস্ত হয়ে ভিতরে গিয়ে নিজে নাস্তা নিয়ে আসে। খেতে বলে আবার ভিতরে যেতে চাইলে সুরুজ মাস্টার থামতে বলেন। এবার একটু গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করে আমার ছেলে ফিরোজকে কি কারনে অ্যারেস্ট করেছো? মাদক ব্যবসায়ী ছমিরনের মামলার সিজার লিস্টের সাক্ষী হয়ে কি ফিরোজ খুব অন্যায় করেছে? তোমাদেরকে আমি এই শিক্ষা দিয়েছিলাম?
লজ্জায় লাল হয়ে যায় রজব আলী দারোগা। বুঝতে আর বাকি থাকেনা কি ঘটেছে। সামছুর মুখে দুইটা থাপ্পড় দিয়ে জিজ্ঞেস করে "ফিরোজ ইয়াবা ব্যবসায়ী না?" আজ এই মামলায় তোকে আমি জেলে পাঠাবো। মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে ফোন দেয় থানার ডিউটি অফিসারকে। বাসায় ফোর্স পাঠাতে বলে।
অবস্থা বিবেচনায় থমকে যায় সুরুজ মাস্টার। দারোগা রজব আলী করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে বাল্য শিক্ষকের নিকট। কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অনুরোধ করেন, স্যার আপনি নাস্তা খাবেন না। ফিরোজকে নিয়ে একসাথে নাস্তা খাবেন।
থানা থেকে দুইজন পুলিশ এলে সামছুকে তাদের নিকট তুলে দিয়ে নির্দেশ দেয়, সামছুকে হাজতে রেখে ফিরোজকে সম্মানের সাথে নিয়ে আসার জন্য।
সুরুজ মাস্টার চোখের জল আটকাতে পারে না। রজব আলীকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করে। ফিরোজকে নিয়ে পুলিশ আসে। ফিরোজ ও রজবকে একসাথে বুকে জড়িয়ে ধরে সুরুজ মাস্টার। সকলের চোখে অশ্রু, ভিতর থেকে ছুটে আসে রজব দারোগার স্ত্রী। দর্শক দুইজন পুলিশ সহ মোট তিনজন। এবার বিদায় নিতে চায় সুরুজ মিয়া। কিন্তু রজব আলী দারোগা বাঁধ সাধেন। নাস্তা না খেয়ে যাওয়া যাবেনা।
বাসায় গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে তারপর নাস্তা খাওয়ার ইচ্ছা জানালে রজব আলী দারোগা তাকে ক্ষমা করার নিদর্শনের জন্য হলেও নাস্তা খেয়ে যেতে অনুরোধ জানান। এবারের অনুরোধ ফেলতে পারেন না সুরুজ মাস্টার। নাস্তা খেয়ে বিদায় নিয়ে ছেলে ফিরোজকে সহ থানা থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় থানা হাজত থেকে চিৎকার শুনতে পায় "সুরুজ স্যার আমাকে ক্ষমা করে দেন। আমি আর জীবনে এরকম কাজ করবোনা। জীবনের শেষ সুযোগটা দিন ভাল হওয়ার।"
শব্দগুলো সুরুজ মাস্টারের কানে বাজতে থাকে অনেক সময়। আনমনে সামছুকে বলে যায় "জীবনে এরকম অনেক মানুষের জীবনকে ধ্বংস করেছো, এবার নিজের অনুশোচনায় নিজেকে ধ্বংস করো"।