ছবি: বাংলা
বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশ। দেশে শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেলেও বেকারত্বের অভিশাপে জর্জরিত তরুণ সমাজ। পড়াশুনা শেষের পথে বা গ্রাজুয়েশন শেষকরা ছেলে/মেয়েটির কাছে সবচেয়ে বিভীষিকাময় শব্দ হচ্ছে ‘চাকুরী’। মোটকথা উপার্জনটা আসবে কোথা থেকে। এখন তো আর ছাত্র অবস্থার মত পকেট মানির ভাবনা ভাবলে চলবে না। প্রতিষ্ঠিত হতে গেলে এখন দরকার ভাল আয়ের উৎস। চাকুরী থেকেই কেবল আয় সম্ভব এমন ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে আত্মকর্মসংস্থান এর দিকে মনোযোগ দেয়া মানুষের কথা বলবো আজ।
মৌসুমী মোশাররফ মৌ এবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পরীক্ষা দিয়েছেন। তার ছোট ভাই মারুফ বিন মোশাররফ ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ অধ্যয়নরত। একজনের পড়াশুনা শেষ এবং আরেকজনের শেষের দিকে। পছন্দসই চাকরি না পেয়ে দুই ভাই-বোন সিদ্ধান্ত নিলেন, নিজের মেধা ও পরিশ্রম অন্যের জন্য নয় বরং নিজেদের জন্য খরচ করবেন। যেন মেধা ও পরিশ্রমের সুফল নিজেরাই ভোগ করতে পারেন।
নিজেদের ভাবনাকে কর্মে রুপ দিতে দুইজনের সময় লাগে মাত্র তিন মাস। মিরপুর এলাকায় দোকানের একটি ছোট জায়গা খুঁজতে খুঁজতে পেয়েও যায় তারা। এইবার আশেপাশের দোকান যাচাই এবং উক্ত জায়গায় একটি সার্ভে চালানোর পর তারা সিদ্ধান্ত নেয় বার্গার চেইন খোলার। বাবা-মাকে রাজি করানো খুব কষ্ট কারণ তাদের ধারণা বার্গার কে খাবে?ভাতের হোটেল বা বিরিয়ানী না কেন?মারুফ বলছিলেন, “জায়গার সন্ধান করা ছিল প্রথম চ্যালেঞ্জ আর বাবা মাকে রাজি করানো তার চেয়েও কঠিন।” কারণ তারা বর্তমান বাজার বা টিনেজারদের চাহিদা সম্পর্কে অবগত ছিলেন না।
নিজের সিদ্ধান্তে অটুট ছিলেন মৌ। রেস্টুরেন্ট শুরুর আগে নামকরা বার্গারের শপ গুলোতে তারা সার্ভে করেছে। তাদের খাবারের টেস্ট গুলো দেখেছে। মারুফের কথা ছিল তারা নতুন কিছু আনতে চায় তাই তারা সবগুলো ব্রান্ড ঘুরে দেখেছে।
দোকানের জন্য জায়গা পাওয়া গেল। মিরপুর ১ নম্বর, সনি হলের পেছনে রাইনখোলা মোড়ের মসজিদ মার্কেটে। এবারে নাম আর ডেকোরেশনের পালা। কি হবে মূলমন্ত্র? এখন খাবারের পাশাপাশি মানুষ পরিবেশও চায়। মৌ ও মারুফের খুব পছন্দ হলিউডের সিনেমা ‘পাইরেটস অফ দ্যা ক্যারিবিয়ান’ সিরিজ। ইচ্ছা ছিল তাদের বার্গারশপটি হবে পাইরেটি আবহে। একটা নামও ঠিক করলেন মারুফ। টরটুগা। টরটুগা হলো ক্যারিবিও দ্বীপপুঞ্জের একটি এলাকা যেখানে সবাই খাবার ও বিনোদনের জন্য যায়। মারুফ মনে করেন, খাবার একটি স্বস্তি ও আনন্দের বিষয়। সেই থিম থেকে নাম প্রস্তাব করেন টরটুগা। বড় বোনেরও খুব পছন্দ হলো নামটা।
বাবা-মাকে বোঝালেন দুই ভাই-বোন। এখন কী চলছে, কোনটা ট্রেন্ড। আর বললেন সন্তানদের উপর আস্থা রাখতে। বাবা-মা আস্থা রাখলেন বটে; তবে এটাই প্রথম ও শেষ সুযোগ, এমনটাও বলে দিতে দ্বিধা করলেন না। মারুফ বলছিলেন, “মাথায় সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে নেমেছিলাম মাঠে এখন আমার গোলপোস্ট আমার খুব কাছে, শুধু কিছু কৌশল মেনে চললেই নিশ্চিত গোল।” আর মৌ বলছিলেন, ‘‘আত্নবিশ্বাস আর পরিশ্রম হচ্ছে সাফল্য রেসিপির দুইটি প্রধান ইনগ্রিডিয়েন্স, আপনি কাজে লাগালেই হলো।”
দোকান নেয়া আর সাজানোর মাঝখানেই সবচেয়ে বড় কাজটি সম্পন্ন করতে এই দুই ভাইবোনের খুব ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। তা হল, একজন ভালো শেফ। নিজেরা তো চাকরি খুঁজলেনই না বরং খুঁজতে শুরু করলেন চাকরি প্রার্থী। ওয়েটার, শেফ, ম্যানেজারসহ বিভিন্ন পদে পাঁচজন লোক নিয়োগ দিলেন।
লোক নিয়োগ দেওয়ার অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে মৌসুমী মোশাররফ মৌ বলেন, “চাকরি পাওয়া যেমন কঠিন। চাকরি দেওয়াও তেমন কঠিন।” মানে সঠিক লোক খুঁজে পাওয়া যায় না। আমি হাজার খুঁজেও পছন্দসই শেফ পাই না। বাধ্য হয়ে বিডি জবস এ সার্কুলার দিতে হলো। এছাড়া মারুফ তো সারাক্ষণ কিচেনে পড়ে থাকে। রান্না দেখে দেখে এখন ও নিজেই শেফদের চেয়ে ভালো বার্গার বানায়। কাস্টমারের ভিড় থাকলে দোকানের মালিক মারুফ ট্রে হাতে হয়ে যান ওয়েটার।’
মাত্র এক মাসের মধ্যেই তারা বুঝে ফেললেন কাস্টমার কী চায়। নির্ধারণ করলেন টার্গেটেড কাস্টমার। সেভাবেই মডিফাই করলেন খাবারের মেন্যু। খাবারের কোয়ালিটিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিলেন। সেই সাথে চলল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অল্পস্বল্প করে বিজ্ঞাপন দেওয়া। যত দিন যায় বাড়ে কাস্টমারের ভিড়। একজন খেয়ে যায়। বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আসে। ছুটির দিনগুলোতে পরিবার-পরিজন নিয়ে আসেন অনেকে। অনলাইন সেবাদাতা দুই প্রতিষ্ঠান ‘হাংরিনাকি ডটকম’ থেকে আসতে শুরু করে হোম ডেলিভারি অর্ডার। এক কাস্টমার তো সাত কিলো দূর থেকে সাইকেল চালিয়ে চলে আসে স্পেশাল মেন্যুর লোভে। অনেকে খেয়ে দেয়ে জিজ্ঞেস করে, আপনাদের আর কোনো শাখা আছে?
শুরুতে বাবা-মা নাখোশ থাকলেও এখন তারাও মাঝে মাঝে আসেন বার্গার খেতে। গর্ব করে বলেন ছেলে মেদের কাজের কথা। মারুফ বলছিলেন, “এখন স্বপ্ন দেখি টরটুগা হবে বার্গার ব্র্যান্ড, আমাদের ইচ্ছা আমরা খুব শিঘ্রই লোনের ব্যবস্থা করে এর আরো শাখা খুলবো।” তাদের এই আত্নবিশ্বাস জাগিয়েছে তাদের কাস্টমার। এরা বার্গার খেয়ে খুব তৃপ্ত। মৌ বলছিলেন, “আমরা কাস্টমারদের সকল সাজেশন মনোযোগ দিয়ে শুনি এবং তা বিবেচনাতেও রাখি। কেননা এই সম্পূর্ণ সার্ভিসটা তাদের জন্য। তাদের কথা বিবেচনায় রাখলে আরো ভাল কিছু সম্ভব।” এছাড়া এখানকার বিশেষত্ব হলো ৭০ ভাগ রেসিপি নিজেদের আবিষ্কৃত। মারুফ নানান পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে, উপাদান বাড়িয়ে কমিয়ে এসব রেসিপি বানায়।
কেন আসবেন টরটুগায়, এর বিশেষত্ব কি?
বার্গার গুলো ইন্টারন্যাশনাল মেজারম্যান্ট মেইন্টেইন করে করা হয়। প্যাটির মাংসের সাথে মশলা ছাড়া আর কোন কিছুই ব্যবহার করা হয় না। ডালাস বীগ ফ্যাটী নামে একটা বার্গার এখানে আছে যার প্যাটীর মাঝখানে মোজারেলা চীজ ব্যবহার করার ফলে অন্যরকম একটি জুসি স্বাদ পাওয়া যায়। এছাড়া বার্গার সস টি হাউস স্প্যাশাল মাস্টার্ড সস।
টরটুগা স্পেশাল নামে একটি বার্গার আছে যা ঝুরি মাংস দিতে তৈরী করা। টোকিওর একটি বিখ্যাত রেসিপি মেইন্টেইন করে বার্গারে বাঙালীয়ানা আনার জন্য এই রেসিপির সাথে ৬ রকমের মরিচের ঝাল সস ব্যবহার করা হয়। যা ঝাল প্রেমিদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে। এছাড়া মোহিতো আর ফ্রাইস গুলো বার্গারের সাথে এনে দেয় নতুন মাত্রা।
কত টাকায় পাবেন?
১৩০ টাকা থেকে শুরু করে ৩৫০ টাকার মধ্যে ক্রেতারা তাদের পছন্দ এবং চাহিদা অনুযায়ী বার্গার কিনতে পারবেন। বর্গারে গরুর মাংসের ৮টা রেসিপি রয়েছে এবং চিকেনের থাকছে ৬টা। এছাড়া রাইস প্লেটার রয়েছে ৩টি।
শেষ কথা:
দুই ভাই-বোন জানালেন এই ব্যবসায় যেমন আশার আলো আছে তেমনি অন্ধকার দিকও আছে। যদি প্রজেক্টটা কোন কারণে ফেল করতো তাহলে আর উঠে দাঁড়ানো কষ্টকর ছিল। ঝুঁকি থাকবেই ,তা মাথায় নিয়েই কাজ করতে হবে।যেমনঃ স্টাফদের ধরে রাখা, বাজারে নানান রকমের দালাল তাই বিবেচনা করে কাঁচামাল কেনা, এলাকার মধ্যে একধরনের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারকারী মানুষজনের প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া ইত্যাদি। তবু সব বাঁধা পেরিয়ে এগিয়ে যাওয়াটার মধ্যে আনন্দ অনেক।
বাজারে পাওয়া ‘অল দ্যা সিক্রেট অফ সাক্সেস’ বই এর মধ্যে থেকে বের হয়ে কঠোর পরিশ্রমের মানসিকতা নিয়ে কাজে ঝাঁপ দিলেই মিলবে সাফল্য। মজা করে বলছিলেন মৌ। নতুন যারা এ ধরণের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তায় আসতে চান তাদের উদ্দেশ্যে মৌ-মারুফের পরামর্শ, আগে পার্সোনাল সার্ভের মাধ্যমে বাজার ও স্থানীয়দের রুচি বুঝতে হবে। মোটামুটি সাত লাখ টাকা হলে এমন একটি বার্গার চেইন দেওয়া সম্ভব।
ভিডিও: