ফাতেমা জোহরা। ছবি: সংগৃহীত
ফাতেমা জোহরা
আধখোলা বেদানার লাল লাল দানার উপর, কিছুটা বুড়ো মানুষের মুখের মত থোবড়ানো, হলদেটে সবুজ আর কালচে ছোপওয়ালা আমের উপর উড়ে উড়ে বসছে নীল মাছিগুলো, সুযোগ পেলেই।
গলির সামনে রিকশার টুংটাং লেগেইে আছে। ব্যস্ততায় ভরা নগর। গলির ডানপাশের মুখে রহমানীয়া বেকারি। চোখের ক্ষিধে আর জিভে জল আনা খাবার সব। ক্রিম পুরে দেওয়া রোল, বাখরখানি আর কেকের সুস্বাদু গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে কাঁচের শো কেসের চারপাশ। মাছি কি ওখানেও উড়ছে! হয়তো না।
এরপর চটপটি, চা আর বিরানীর দোকান, বদ্ধ কপাটের একটা দোকান, মেশিনারি টুলসের দোকান পেরিয়ে ডিসপেনসারি। সামনে ওষুধের আলমারি, কাঠর্বোডের পার্টিশন দেওয়া। অন্য রুমে সন্ধ্যাবেলায় ডাক্তার বসেন। ওষুধের দোকানের চারপাশে কাঁচের ফ্রেমের ভেতরে থাক থাক ভর্তি ওষুধ। একটা ডেস্কের পেছনে কম্পাউন্ডার কাম সেলসম্যান সুলায়মান বসে আছে। এই অবলোয় ওষুধ কিনতে কেউ আসে না, আসে উস্কোখুস্কো চুল, দাড়িওয়ালা কিছু মানুষ। নির্লিপ্ত উদাসীনতায় সে মাছির উড়াউড়ি দেখে, বৃদ্ধ ফল বিক্রেতার মুখের বলিরেখা গোনে, মাছি তাড়ানোর ময়লা ন্যাকড়াটার দোলায়িত ছন্দে আনমনা সময়রে প্রহরগুলো কাটায় সোলেয়মান।
ঠিক তার অপর পার্শ্বে বেঞ্চির উপর বসা ছোট একটা ছেলে। বয়স ১১-১২। বয়সের চেয়ে ভারিক্কী একটা ভাব। অনন্ত অপেক্ষার সময়টাকে হাতের মুঠোয় পুরে সে ধ্যানমগ্নতায় দেখে ওষুধের তাকে তার প্রিয় ভিটামিনের সিরাপ। সোলায়মানরে নির্লিপ্ততা, বৃদ্ধ ফল বিক্রেতার মাছি তাড়ানো ঝুলঝুলে চামড়ার হাত, লাল বেদানা, হলদে সবুজ চুপসানো আম আর ভন ভন করা নীল মাছি ছেলেটিকে আচ্ছন্ন করে আছে।
ছেলেটি রবি।
র্সূযটা আকাশের আঁচল ছেড়ে মধ্যগগনে প্রায়। ক্ষিধেটা জানান দিচ্ছে, আর কতোক্ষণ! নীল রেক্সিনের পর্দাটা ঠেলে মনটা ভেতরে ঢুকে যেতে চায়। কিন্তু অলঙ্ঘনীয় একটা প্রাচীর যেন খাড়া হয়ে থাকে সোলায়মানের মৌনতায়। খুব রাগ হয় ছেলেটির। সোলেয়মানের ওষুধ বিক্রির ব্যস্ততার এক ফাঁকে সে ঢুকে পড়ে নীল রেক্সিনের অপর পার্শ্বের আজব দুনিয়ায়।
একপাশে রোগী শোয়ার একটা খাট, মাঝখানে বেতের একটা পার্টিশন, অন্যপাশে ডাক্তারে চেয়ার, টেবিল আর খানকতক চেয়ার এলোমেলো, ছড়ানো ছিটানো। সিগারেটের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন পুরো ঘর। আধো অন্ধকার, ধোঁয়ার আবছায়ায় রবি খুঁজে নেয় তার বাবাকে। বাবা, বাবা! শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে ডাকে রবি। ঝিমুনির ঘোরে, আধখোলা চোখে সে ডাকের প্রত্যুত্তর আসে না। আবার ঝাঁকায় রবি বাবাকে। বাবা চলো, ক্ষিধে পেয়েছে। বাবার বিকার নেই, ঘোর ধরা, অবিন্যস্ত কাপড়ে ঠেস দিয়ে বসে আছে। নির্মিলিত চোখ। অভ্যস্ত রবি বুঝে যায়, তাকে আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে বাবার সম্বিত ফিরে পেতে। কৌতূহলে সে বেতের পার্টিশনের ওপাশে উঁকি দেয়। মামা, চাচার মতো কয়েকজন বসে আছে উদভ্রান্ত ভঙ্গীতে। সামনে সিরিঞ্জ, নীডল, ভাঙ্গা খয়েরি এ্যাম্পুল, ছোট একটা রাবারের দড়ি। উস্কোখুস্কো মানুষগুলোকে দেখে ভয় ভয় লাগছিল। হঠাৎ সুলায়মান এসে সামনে দাঁড়ালো। রবি ডেকে চলে। বাবা, বাবা উঠো।
ঃ ভাই, আপনাকে কতোবার বলি বাচ্চাদের এখানে আনবেন না। সুলায়মানরে গলায় উষ্মা ঝরে পড়ে।
এবার কিছুটা নড়চেড়ে বসে বাবা। ঘোলাটে চোখগুলো কষ্টে পাপড়ি মেলে।
ঃ নেন ভাই, একটু পানি দেন চোখেমুখে, সোলায়মান পানির নীল জগটা এগিয়ে দেয়। রবি বাবাকে হাত ধরে আস্তে আস্তে উঠায়। প্রচন্ড রাগ হচ্ছিলো তার, ফর্সা মুখটা তেতে লাল হয়ে উঠে। ইচ্ছে করে সোলেয়মানের মুখে একটা ঘুষি মারতে। বাবার অবস্থা দেখে অতি কষ্টে নিজেকে সামলায়।
কিছুটা ধাতস্থ এখন সোলেয়মান। চোখমুখে পানি দিয়ে কিছুটা ভদ্রস্থ, আত্মস্থ হয়ে বেরিয়ে পড়লো ছেলের হাত ধরে। নিয়ে গেল সুস্বাদু, ক্ষিধে উদ্রেককারী সেই কেক, বাখরখানির দোকানে।
ঃ বল, কি খাবি? ছেলেকে জিজ্ঞাসা করে সোলেয়মান। রবির খুব পছন্দ সন্দেশ। সন্দেশ আর কেক খেল সে। বাবা ধূমায়তি চায়ে চুমুক দিচ্ছে আস্তে আস্তে। স্টেশন রোড, কোতোয়ালি, ব্রিকফিল্ড রোড হয়ে সদরঘাট। সামনে কর্ণফুলীর অগাধ জলরাশি।
একটা বড় নৌকায় উঠলো বাপ-ছেলে। প্রখর রোদ গায়ে বিঁধছে। আনমনা ছেলেটি শুশুকের লাফ দেওয়া দেখে মুগ্ধ হয়। পাশ দিয়ে স্টিমার যাওয়ার সময় বড় বড় ঢেউগুলো দোলায় নৌকাটাকে। সেই দুলুনির সাথে নদীর ঢেউ আর সূর্যের ভালোবাসাবাসি দেখে নিজের মধ্যে ডুবে যায় আত্মমগ্ন রবি।
শিকলবাহা বিদ্যুৎকেন্দ্রের দিকে এসে নদী কিছুটা সরু হয়ে যায়। এখন দুইপাশে পাড় দেখা যায়। বুনো জংলার ফাঁকে দু’একখানা ঘর-গেরস্থিও চোখে পড়ে। চুপচাপ, নিজের ভেতর ডুবে থাকা রবি ভুলে যেতে চায় ডিসপেনসারির কালো গুমোট ঘরের সেই বিদঘুটে অভিজ্ঞতা। এক একেকজনের ইতস্তত, অবিন্যস্ত ভঙ্গির জড়ানো গলা, ঘোলাটে চোখ, সিগারেটরে ধোঁয়া, খয়েরি এ্যাম্পুল, রক্তমাখা সিরিঞ্জ।
নৌকা এগোয়। হালকা ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। ছন্দময়। সেই ছন্দে পাড়ের ঝুঁকে থাকা কেওড়া গাছের পাতা, ফল হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চায় রবি।
নৌকা এগোয় ক্রমে নদী পার হয়ে সরু খালে। দিগন্তের কাছাকাছি গিয়ে অস্পষ্ট হয়ে উঠে পেছেনের সেই ছবি। নৌকা এগোয় তার শাব্দিক তালে দ্বিপ্রহররে র্সূযকে সাথে নিয়ে।