তাজহাট জমিদারের মনোরম প্রাসাদ। ছবি : লেখকের ফেসবুক ওয়াল থেকে
পরিমল মজুমদার :
দূর থেকে রাজহাঁসের মতো দেখতে শ্বেত পাথরের তৈরি রংপুরের তাজহাট জমিদারের মনোরম প্রাসাদ। সংবাদের পেছনে ছুটতে এখানে আসা। সাংবাদিক হওয়ার সুবাদে দর্শণার্থীদের থেকে একটু আলাদা সুবিধা পেলাম।
প্রাসাদের বন্ধ করে রাখা রঙ্গ মহল, রাণীর শয়ন, সজ্জা কক্ষ ও হাওয়া মহল খুলে দেয়া হলো খবরের উপাত্ত হিসাবে।
হাওয়া মহল হচ্ছে, প্রাসাদের চুঁড়াটা। প্রথমে আমার গন্তব্য সেখানে।
নিরাপত্তা কর্মী জং ধরা সিঁড়ির দরজার তালা খুলে ছাদে নিয়ে এলেন।
হাওয়া মহলে উঠার আগে দেখা গেলো, নীচু একটি টিনশেড আধা পাকা ঘর। দেখতে অনেকটা স্টোর রুমের মতো। তিনি জানালেন, এটা কয়েদ খানা। থমকে দাঁড়াই।
মাথা নীচু করে ছোট দরজা দিয়ে এর ভিতরে ঢুকি। অনেক অনেক দিন পর মানুষের পদচারণায় ভয় পেয়ে বাঁদুর আর চামচিকার দল, বিচিত্র শব্দ করে ঘুলঘুলি দিয়ে উড়ে চলে যায়। একটা দমকা বাতাস যেন ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো। বাইরে তখন ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা। কয়েদ খানার ভেতরটা তখন মনে হচ্ছিল তন্দুর রুটির চুল্লি। নোনা ঘাম কপাল বেয়ে চোখে ঢোকে। ঝাপসা হয়ে আসে দৃষ্টি....।
চাবুক মারার হিস্ হিস্ শব্দ আর চাপা কান্নার আওয়াজ পাই। বুকের হাড় বের হওয়া বেশ ক’জন মানুষ এসে সামনে দাঁড়ায়। এরা সবাই তাজহাটের জমিদার মান্না লাল রায়ের কয়েদি।
এদের মধ্যে এক বৃদ্ধ আমার সাথে কথা বললেন। তার নাম সুরেন। সে জানায়, কাজল নামে তার একটি মেয়ে ছিলো। সে ভালো গান গাইতে পারতো। জমিদার তাকে তার রং মহলে পাঠাতে বলেন। কিন্তু তিনি তাতে রাজী না হওয়ায়, তাকে বন্দি করা হয়েছে। দিনের পর দিন নির্মম নির্যাতনে, সেখানেই তার মৃত্যু হয়।
এক এক করে ওসমান, বদরুদ্দিন, হরিপদ, বদরু সবাই জানালেন তাদের নির্মম নির্যাতনের কাহিনী। বেশিরভাগ মানুষকে খাজনা দিতে না পারায় কয়েদ করে রাখা হয়েছে।
কথিত আছে, জমিদার মান্না রায় ছিলেন জনপ্রিয়। কিন্তু ইতিহাস অনেক সময় শাসকরা তাদের মতো লেখায়। মান্নার ক্ষেত্রেও এমনে হয় এর ব্যতিক্রম হয়নি। তা না হলে সেখানে কয়েদখানা থাকবে কেন?
আসলে এই শ্বেত শুভ্র প্রাসাদের প্রতিটি ইটে জমাট বেঁধে আছে, নিরীহ মানুষের লাল রক্ত। যা মানুষ দেখতে পায় না। দেখতে গেলে এমন উত্তপ্ত একটা দিন লাগে।
সাংবাদিক ও লেখক