• ২৪ জানুয়ারি ২০১৯ ১৮:২৭:০২
  • ২২ আগস্ট ২০১৯ ২৩:৩০:২২
অন্যকে জানাতে পারেন: Facebook Twitter Google+ LinkedIn Save to Facebook প্রিন্ট করুন
বিজ্ঞাপন

ভিক্ষা নয়, তৃতীয় লিঙ্গের নীলা-আঁখিরা এখন কাজ করেন

বামদিক থেকে সুমনা, নীলা ও আঁখি

কোন এক বিশেষ প্রযোজনে যেতে হয় সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটোকের সামনে গাড়ি থেকে নামতেই এক চিৎকার কানে এসে লাগলো ‘আইডি কার্ড গলার মধ্যে ঝুলিয়ে নিন, আইডি কার্ড ছাড়া কাউকে ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হবে না’। তাকিয়ে দেখি এক হিজড়া (আমাদের ভাষায়) আর সরকার যাদের স্বীকৃতি দিয়েছে তৃতীয় লিঙ্গের । রাস্তার এপার থেকে তাকিয়ে দেখি সে একা নয় আরো দু’জন আছে তার মত তৃতীয় লিঙ্গের। এই দৃশ্য দেখে আমি খানিকটা অবাক হয়ে গেলাম।

অবাক হলেও খুব ভালো লাগছিলো এই দৃশ্যটি দেখে। কারণ আমরা যারা এই শহরে পথ চলি আমারা শুধু একটি ছবি দেখে অভ্যস্ত যে, হিজড়ারা চলন্ত বাসে উঠে বা দোকানে দোকানে ঘুরে ভিক্ষা করছে। কিন্তু আমার সামনের এই ঘটনাটি ছিল তার একদম ব্যাতিক্রম।

তৎক্ষণাত মনটা চাচ্ছিলো তাদের সাথে গিয়ে কথা বলি কিন্তু সময়ের অভাবে তা পারিনি আবার একটু হালকা সঙ্কোচ বোধও কাজ করছিলো। কিন্তু যেতে যেতে ভাবলাম, না! তাদের সাথে অবশ্যই কথা বলবো। সেই ভাবনা থেকে সাহস নিয়ে দুপুরের খাবার বিরতিতে খাবার খেয়ে সবাই যখন চা-সিগারেট আর আড্ডাতে ব্যস্ত আমি তখন গেলাম তাদের সাথে কথা বলতে। সেখানে গিয়ে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলে তারা প্রথমে রাজি না হলেও প্রশাসনের অনুমতির পর হাসি মুখে রাজি হয় কথা বলার জন্য।

আমি বললাম, চলেন তাহলে একটু বসে কথা বলি? তাদের মধ্যে একজন বললো চলেন ওখানে বসি। প্রধান ফটোকের পাশে এক ছোট চালার মত বসার স্থান। সেখানে বসেই কথা হলো তাদের সাথে প্রথমেই নাম দিয়ে শুরু করি। নাম জিজ্ঞাস করতেই একজন বলল –আমি আঁখি সে নীলা আর ওর নাম সুমনা।

কথায় কথায় নীলা বলেন, বাড়ি ছেড়েছি আজ প্রায় ২০ বছর। আমার গ্রামের বাড়ি যশোর জেলায়। ঢাকায় প্রথমে এসে অন্যদের মত দোকানে দোকানে ভিক্ষা করতাম। কিন্তু এসব করতে আমার ভালো লাগতো না। তাই আমি পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সবখানে শুধু অপমান আর লাঞ্চনার শিকার হয়েছি। সবাই আমাদের নিয়ে হাসি- তামাশা করতো। এখানে আসার আগে গার্মেন্টসে কাজ করতাম কিন্তু সেখানেও একই অবস্থা স্বাধীনভাবে চলতে পারতাম না।

কিভাবে এখানে চাকরি পেলেন এমন প্রশ্নে আঁখি পাশ থেকে উত্তর দিলেন, হঠাৎ করে একদিন আমাদের গুরু মা আমাদেরকে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের শিক্ষক সাকিনা আক্তার ম্যাডামের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি তৃতীয় লিঙ্গের মধ্যে যারা যৌন কর্মী তাদের জন্য কাজ করতেন। ম্যাডামেই আমাদের এখানে এই চাকরি করার প্রস্তাব দেন, আর আমরাও রাজি হয়ে যাই। এর পর রেজিস্টার স্যার আমাদের ইন্টারভিউ নেয়ার পর চাকরিটা হয়।

আঁখি ও সুমনা প্রায় ১০ বছর আগে বাড়ি থেকে চলে এসেছেন। আঁখির গ্রামের বাড়ি বরিশাল আর সুমনার টাঙ্গাইলে। ঢাকাতে কাজের মাধ্যেমেই তাদের তিন জনের পরিচয় এবং বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

আঁখি বলেন, আমরা যখন ভিক্ষা করতাম তখন পরিবারের বা গ্রামের সবাই আমাদের অবহেলা আর ঘৃণা করতো। কিন্তু এখন বাসার লোকসহ প্রতিবেশিরা আমাদের ভালবাসে উৎসাহ দেয়। বলে, না তোমরা এবার ভালো কাজ করতেছো। আগে ভিক্ষা করে ত্রিশ হাজার টাকা আয় করতাম প্রতিমাসে। কিন্তু এখন কম পেলেও অনেক সম্মান পাই। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া।

এরপর নীলা ও আঁখি দু’জনেই বলেন, এখন মাঝে মাঝেই মাকে দেখতে বাড়িতে যাই। প্রতিমাসে মাকে টাকা পাঠাই। এখন খুব ভালো লাগে। এখানে আমরা স্বাধীনভাবে চলতে পারি। আমাদের পছন্দ মত পোশাক পড়তে পারি, সাজতে পারি। কেউ কিছু বলে না।

সুমনা চুপচাপ সব শুনছিলো। তাকে প্রশ্ন করতেই বললেন, আমার মা-বাবা বেঁচে নেই। গ্রামে ভাই-ভাবি ও তাদের ছেলে মেয়ে আছে, তাদের সাথে দেখা করতে যাই। গেলে সবাই অনেক খুশি হয়।

নীলা যোগ করেন, এখন আমরা মাথা তুলে চলাফেরা করতে পারি। কারণ আমার আর সবার মত পরিশ্রম করে খাই, কারো কাছে হাত পাতি না।

আজকের এই অবস্থার জন্য সাকিনা আক্তার ম্যাডাম, রেজিস্টার স্যার ও ড. জাফরুল্লা চৌধুরী স্যারের কাছে আমরা ঋণী। ওনারা আমাদের সুযোগ না দিলে আমরা আজ এভাবে সম্মান নিয়ে চলতে পারতাম না। আমাদের ওই ভিক্ষাই করতে হতো। আর রেজিস্টার স্যার আমাদের পিতার মত । ওনার কাছে আমরা সবকিছু খুলে বলতে পারি। যা আমরা আমাদের মা- বাবার কাছেও বলতে পারি না।

গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার মোঃ দেলোয়ার হোসেনের কাছে গেলে তার অনুপস্থিতিতে এই বিষয়ে কথা হয় সহকারি রেজিস্টার আবু মোহাম্মদ মোকাম্মেল এর সাথে।

তিনি জানান, গত চার মাস ধরে তারা এখানে নিরাপত্তা কর্মী হিসেবে কাজ করছে। তাদেরকে আমরা নিয়োগ দিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছি নিরাপত্তা এবং ছাত্র, শিক্ষক ও অভিবাবকদের সাথে কি আচরণ করতে হবে তা নিয়ে। তারপর থেকে তারা তাদের দায়িত্ব সফল ভাবেই পালন করছে। তারা এই চার মাসে যথেষ্ট যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে। তারা খুব সৎ ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করছে। কোন প্রকার অবহেলা করেনি।

তিনি আরো জানান, তাদের নিষ্ঠা দেখে আমাদের রেজিস্টার স্যার তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দিয়ে আমাদের এখানেই আরো ভালো কোন জায়গায় তাদের চাকরীর ব্যবস্থা করার কথা ভাবছেন। আর তাদের বেতন অন্য নারী- পুরুষ নিরাপত্তা কর্মী যারা আছেন তাদের থেকে বেশী এবং তারা এটার যোগ্য।

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
Page rendered in: 0.1656 seconds.