আজ (১৫ই মার্চ) নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে জুমার নামাজের সময় মসজিদে ঢুকে এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়ে প্রায় অর্ধশতাধিক নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এ নিয়ে নিন্দা জানানোর ভাষা সত্যি সত্যি আপনার মতো আমারও জানা নেই। প্রথমেই তাই বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।
সেই সাথে মানুষের জীবন নিয়ে এমন নৃশংস উন্মত্ততাকারী যে কত বড় সন্ত্রাসী মানসিকতার অধিকারী তা মনে হয়, না বললেও চলে। যেহেতু কোনো গোষ্ঠী এখন অবধি এ হামলার দায় স্বীকার করেনি, ফলে আমরা প্রাথমিকভাবে ধরে নিতে পারি যে এটা ব্যক্তির নিজস্ব প্রতিহিংসাজনিত চিন্তারই প্রতিফলন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এর পেছনে হত্যাকারী, সন্ত্রাসীর মোটিভ কি? কেন সে এ ঘটনা ঘটাতে উদ্বুদ্ধ হলো? এটা বিশ্লেষণ করাটা তাই ভীষণ জরুরি। কারণ এটা বিশ্লেষণ করলেই হত্যাকাণ্ডের স্বরূপ উন্মোচন করতে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না।
ক্রাইস্টচার্চে হামলাকারী তার এ ঘৃণিত হত্যাকাণ্ড সরাসরি ফেসবুকে লাইভ করেছে। আর পত্রিকান্তরে জানলাম হামলা করার আগে সে নাকি ৯৪ পৃষ্ঠার একটি ঘোষণাপত্র ছড়িয়েছে। তাতে নিজেকে ব্রিন্টন ট্যারান্ট বলে পরিচয় দিয়ে হামলার কারণ তুলে ধরেছে। সেই ঘোষণাপত্রে সে 'সন্ত্রাসী হামলায় হাজার হাজার ইউরোপীয়ানের প্রাণহানির' প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞার কথা উল্লেখ করেছে।
ওই ঘোষণাপত্রেই হামলার উদ্দেশ্য নিয়ে হামলাকারী যুবক বলেছে 'আমাদের ভূমি কখনই তাদের ভূমি নয়। যতদিন পর্যন্ত শেতাঙ্গরা বেঁচে থাকবে ততদিন পর্যন্ত অমাদের বাসভূমি আমাদের। তারা কখনই আমাদের ভূমি দখল বা আমাদের মানুষদের ভূমি ত্যাগ করাতে পারবে না।'
তার মানে তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? দাঁড়াচ্ছে এই যে, এ হত্যার পেছনে ‘জাতিগত’ অন্ধ উস্কানি কাজ করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খেয়াল করলে দেখবেন যে পুরো ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া এবং আমেরিকাতে জাতিগত এবং ধর্মীয় উগ্রবাদ বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে; যেটা এশিয়ার সীমিত এলাকায় একসময় সীমাবদ্ধ ছিলো। এদিকে ব্রেক্সিট ইস্যুতেও উগ্র ধ্যানধারনার বহি:প্রকাশ আমরা দেখতে পেয়েছি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী যে অর্থনৈতিক ধ্যানধারনা থেকে ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে ভাতৃত্ববোধের ভিত্তিস্বরুপ ইউরোপীয় কয়লা ও ইস্পাত সম্প্রদায় (European Coal and Steel Community) গঠিত হয় সেটাকেই তো ইউরোপীয় ফেডারেশনের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রায় ৭০ বছর পরে ব্রেক্সিট ইস্যুতেও সেই অর্থনৈতিক বিষয়কে সামনে এনেই গোটা ব্রিটেনজুড়ে প্রচার প্রচারণা চালানো হলো।
ফলত: ইইউ ছাড়ার প্রশ্নে ব্রিটেনের জনগণের মধ্যে একটা ইতিবাচক মনোভাব গড়ে উঠলো। যার ফলাফল আমরা ব্রেক্সিট প্রশ্নে দেখতে পাই। এখন দেখা যাচ্ছে এসব প্রচারণা ছিলো মিথ্যে। ব্রেক্সিট ইস্যুতে তাই ব্রিটেন দ্বিধাবিভক্ত। তাদের এখন ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ অবস্থা।
আর আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট তো ক্ষমতায় এসেছেনই “আমেরিকা ফার্স্ট” নামক উগ্র প্রচারণা চালিয়ে। তাতে ক্রাইস্টচার্চে হামলাকারী তরুণের মতো অসংখ্য সাদা চামড়ার তরুণেরা নিজেদেরকেই সেই “ফার্স্ট” তত্ত্বের প্রচারণায় সামিল হয়েছে। ফলে সাদা চামড়ার মানুষদের ভেতরে একটা উগ্র জাতীয়তাবোধ আবার নতুন করে জন্ম নিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া থেকে আগত সাদা চামড়ার তরুণ না হয়ে তাই এ হামলাকারী ইউরোপ, আমেরিকা থেকে আসলেও তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। যেহেতু অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের নাগরিকরা বিনা ভিসায় এক দেশ হতে আরেক দেশে যাতায়াত এবং চাকরি করার সুযোগ পায় ফলে উগ্র সাদা চামড়ার তরুণ এ কাজটি সহজেই করতে পেরেছে। অর্থাৎ জাতিগত উন্মাদনার ফলেই এ তরুণটি এমন জঘণ্য ঘটনা ঘটানোর সাহস করেছে বা করতে উৎসাহিত হয়েছে।
সম্প্রতি কাশ্মিরের পুলওয়ামায় নিহত প্রায় অর্ধশতাধিক ভারতীয় জোয়ানের মৃত্যুর পেছনে পাকিস্তানভিত্তিক যে জঙ্গীগোষ্ঠী জইশ-ই-মোহাম্মদ জড়িত তারাও তো ধর্মীয় জাতিগত উগ্রতায় বিশ্বাসী। আর এটাকে কেন্দ্র করে সমগ্র ভারতে কাশ্মিরি জনগণের উপরে যে হামলা হয়েছে সেটাও উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মীয় চিন্তারই ফসল। সিরিয়া এবং ইয়েমেনেও যে ভয়াবহ আক্রমন সৌদি জোট চালিয়েছে এবং এখনও চালাচ্ছে তাও উগ্র ধর্মীয় জাতিগত ধ্যানধারনা থেকেই। আমাদের দেশে কক্সবাজার, ব্রাক্ষণবাড়িয়া, অভয়নগর, গাইবান্ধা এবং রংপুরে ঘটে যাওয়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলার পেছনেও এ জাতিগত এবং ধর্মীয় উগ্রপন্থাই দায়ী। ফলে এটা সহজেই বলা যায় যে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে যত হামলা হয়েছে বা হচ্ছে বা আগামীতে হবে সে সবগুলোর মূলেই ধর্মীয় এবং জাতিগত উগ্র সাম্প্রদায়িক ধ্যান ধারনাই প্রাধান্য পাবে।
চিন্তাজগত যখন উগ্রতায় ডুবে যায় তখন হামলা, আক্রমন এবং হিংসা বাড়বেই। বাড়বে উগ্র মতবাদও। আর এ উগ্রতা মূলত জাতিগত এবং ধর্মীয় কট্টরপন্থার হাত ধরেই আশ্রয় পায়। পায় প্রশ্রয়ও। অবশ্যই তার সাথে যুক্ত আছে নোংরা রাজনীতিও। তাই উগ্রতা নামক বিষবৃক্ষের কাছে সময়ে সময়ে মানবতাবোধ চরমভাবে মার খেয়ে যাচ্ছে। যদিও শেষাবধি মানবতাবোধ-ই জয়ী হবে বলে আমার স্থির বিশ্বাস। কারণ অশুভ কাজের পরিণতি কখনোই ভালো হয় না।
ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে নিন্দা করার চেয়ে আমার মনে হয় এখনই ধর্মীয় এবং জাতিগত- এ দুই উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তিকে নির্মূলে ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ নেয়া উচিত। কারণ উগ্রবাদ এখন অব্দি প্রাথমিক স্টেজেই আছে। ফলে এটাকে রুখে দেয়ার সুযোগ এখনও আমাদের হাতে যথেষ্টই আছে বলে আমি মনে করি। তাই বাস্তবতা মাথায় রেখে আগামী প্রজন্মকে নিরাপদ পৃথিবী উপহার দেয়ার লক্ষ্যে সর্বজনীন মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ ব্যক্তি, সংগঠন, ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে এখনই এগিয়ে আসতে হবে। না হলে আরো কত যে প্রাণহানি হবে, রক্ত ঝরবে তা চিন্তা করতেই কষ্ট হয়! নিদারুণ কষ্ট হয়!
লেখক : চিকিৎসক ও শিক্ষক। সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, এনাম মেডিকেল কলেজ।