ছবি : বাংলা
রাজীবপুর (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি :
ভেরেণ্ডা, ভেন্না, বেড়াসহ নানা নামে ডাকা হয় এই উদ্ভিদটিকে। পল্লী কবি জসিম উদ্দীন তার বিখ্যাত কবিতা আসমানিতে ভেরেণ্ডা গাছ নিয়ে লিখেছিলেন 'বাড়ি তো নয় পাখির বাসা ভেন্না পাতার ছানি একটু খানি বৃষ্টি হলে গড়িয়ে পড়ে পানি'।
ভেরেণ্ডা বিরুৎ জাতীয় বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ এর ইংরেজি নাম Castor বৈজ্ঞানিক নাম Jatropha curcas এবং Euphorbi Aceae পরিবারে অন্তর্ভূক্ত। গাছের কান্ড সবুজ ও হালকা খয়েরী দুই রঙ্গের হয় পাতা সবুজ। উচ্চতায় সাধারণত ৩ থেকে ৭ ফিট পর্যন্ত হয়। গাছের কান্ড নরম ডাল কাটলে এবং পাতা ছিঁড়লে সাদা আঁঠালো রস বের হয়। পাতা চওড়া, দেখতে অনেকটা হাতের পাঞ্জার মত। কাণ্ডের চারদিকে গোল হয়ে ছোট ছোট হলুদ ফুল হয়। এই ফুল থেকে পরবর্তী নরম কাটা যুক্ত ফল হয় ফলের রঙ্গ সবুজ। বাদামী ও কালচে রঙ্গ ধারণ করে ফল পাঁকে। পাঁকা ফল আপনা আপনি ফেঁটে বীজ পড়ে যায়, বীজ কালো চকচকে বাদামী রং মিশ্রিত।
ভেরেণ্ডা গাছ গড় আয়ু ৫০ বছর পর্যন্ত তবে আমাদের দেশে ১ থেকে দুই বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে এরপর গাছ কেটে ফেলে মানুষ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে। এই গাছের বয়স বাড়লে ফলনও বাড়ে। ভেরেণ্ডার আড়াই কেজি বীজ থেকে প্রায় এক লিটার তেল পাওয়া যায়।
ভেরেণ্ডার বীজ থেকে ভোজ্য ও ঔষধি তেল বানানে যায়। উন্নত দেশ গুলোতে ভেরেণ্ডার তেল ডিজেলের বিকল্প (বায়োডিজেল) হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আমাদের দেশে গ্রাম অঞ্চলে এর বীজ সিদ্ধ করে থেঁতলে নিয়ে পানিতে জ্বাল দিয়ে বুদবুদ উঠলে সেগুলো উঠিয়ে নিলেই তেল হয়ে যায়। এই তেল কেউ খায় আবার কেউ ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করে।
ভেরেণ্ডার রয়েছে নানাবিধ ভেষজ গুণ। এর তেল দিয়ে কবিরাজরা নানা রোগ নিরাময়ের ওষুধ তৈরি করে থাকেন। রাতকানা রোগ হলে ১০ গ্রাম ভেরেণ্ডা পাতা ঘিয়ে ভেজে সেবন করলে রোগটি থেকে সহজেই আরোগ্য লাভ করা করা যায়। প্রস্রাবের স্বল্পতার ক্ষেত্রে ২০ গ্রাম ভেরেণ্ডার মূলের রস খেলে উপকার পাওয়া যায়। বাতের ব্যথায় ১ থেকে ২ গ্রাম ভেরেণ্ডার তেল লবনের সাথে মিশিয়ে আক্রান্ত স্থানে মালিশ করলে ব্যথা কমে যায়। কোষ্টকাঠিণ্য নিরাময়ে ২ থেকে ৪ চা চামচ মূলের রস সকালে ও বিকালে পানিসহ সেবন করলে আরোগ্য হয়। অম্লশূল রোগে ৫ গ্রাম কচপাতার রস পানিতে সিদ্ধ করে ছেঁকে সেবন করলে রোগটি নিরাময় হয়।
৯০ দশক পর্যন্ত গ্রামে ছোট শিশুদের জ্বরের সময় এর ছাল গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হত এতে করে শিশুরা আর বমি করত না। শিশুদের ঠাণ্ডা লাগলে তৈল গরম করে বুকে লাগালে ঠাণ্ডা উপশম হতো বলে জানান রাজীবপুর উপজেলার সবুজ বাগ গ্রামের প্রবীণ অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক আলহাজ্ব ইউনুস আলী মাস্টার। আধুনিক চিকিৎসা সেবার ফলে এসব এখন আর ব্যাবহার হয় না বলেও জানান তিনি।
তেল তৈরি করার সময় যে খৈল পাওয়া যায় তা জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। সাবানের জন্য গ্লিসারিন ও পাওয়া যায় এর তেল থেকে। খাবারের রুচি বাড়ায় মাথায় দিলে ঠাণ্ডা অনূভুতি হয় আগুনে পোড়া বা দুর্ঘটনাজনিত শরীরের কালো দাগ মেশাতে সাহাস্য করে এই তেল। পঁচা পুকুর ডোবা নালা খাল বা বিলের জলাবদ্ধ পচা পানিতে নামার সময় জাগ দেওয়া পাট ধুঁতে এই তেল শরীরে মাখলে পানিতে চুলকানি হয় না এবং জোক ধরে না।
নানা গুণ সমৃদ্ধ এই বীজ গুলো গ্রামের দরিদ্রের জনগোষ্ঠীর মানুষ আগে সংগ্রহ করে শুকিয়ে বাজারে বিক্রি করত স্থানীয় বাজারে ধান পাট গম ব্যবসয়ীরা ওজন করে কিনতো ভেরেণ্ডার বীজ পরে এগুলো নারায়নগঞ্জের পাঠিয়ে দিত ব্যবসায়ীরা। গাছটি কমে যাওয়ায় এখন এর বীজ আর কেউ সংগ্রহ করে না।
চলতি পথের ধারে কোন পরিত্যাক্ত জায়গায় হঠাৎ দেখে মেলে এই নানা ভেষজগুণ সমৃদ্ধ এই উদ্ভিদটির।সরকাররি বা বেসরকারিভাবে যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করলে একটি অর্থকারী ঔষধি ফসল হবে ভেরে।