ছবি : বাংলা
কাকন রেজা :
দুর্ভোগকে আনন্দ মনে করার ‘থিম’টা কিন্তু চমৎকার। ঈদে বাড়ি যাবেন, পথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে আছেন। গাড়ির দীর্ঘ সারি। পাঁচ ঘণ্টার রাস্তা, লাগবে পনেরো ঘণ্টা। এতে বিরক্ত হবার কিছু নেই। আপনি হুমায়ূন আহমেদের মতো গাড়িতে বসে কল্পনায় ময়ূরাক্ষী নদীর তীরে চলে যান।
গাড়ির গরম, মানুষের কোলাহল, যাত্রার ভোগান্তি সব চলে যাবে। নিমিষেই শরীর শীতল হয়ে উঠবে। কোলাহল নয়, শুনতে পাবেন দূরাগত ঘুঘুর ডাক। তখন দুর্ভোগ রূপান্তরিত হবে আনন্দে। আপনি হয়ে উঠবেন রোগ-শোক আর মৃত্যুঞ্জয়ী। আপনি ‘হিমু’ হয়ে উঠবেন।
‘হিমু’ হয়ে উঠার কৌশলটাই এখন জানান দেয়া হচ্ছে ‘দুর্ভোগকে আনন্দ মনে করা’র মহান ‘থিমে’! বলতে গেলে এখন কল্পনার আশ্রয় নেয়া ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নেই। কল্পনায় রাতের হাতির ঝিল নিয়ে আসতে হবে। বাংলা টিভি নাটকের পুতুপুতু প্রেমকেও কল্পনায় আনতে পারেন। হয়ে যান টিভি নাটকের নায়ক। চিন্তা করুন বড়লোক বাবার, ওই যে দেশের টাকা মেরে সুইস ব্যাংকে রাখা কোনো ‘মহান’ ব্যক্তির সন্তান আপনি। দামি গাড়িতে করে ‘পশ’ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। পড়াশোনা কী করেন জানা নেই, কিন্তু সুন্দরী নায়িকার সাথে চুটিয়ে প্রেমটা করেন।
আর বয়সটা যদি একটু বেশি হয়। বয়সের জন্য গাড়ির ‘আনন্দিত দুর্ভোগে’ যদি হাঁপিয়ে উঠেন। তবে নিজেকে টিভি নায়কের বাবার চরিত্রে নিয়ে যান। মনে করুন, যে রাস্তাটি দিয়ে আপনি যাচ্ছেন, সেই উন্নয়নের মহাসড়কের আপনি ঠিকাদার। আপনার মেগা প্রজেক্টের বাজেট লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, আর বাড়ছে আপনার ব্যাংকের টাকা। আপনি বাসে নন, চড়ে আছেন মার্সিডিজে। চমৎকার ঠান্ডা এসিতে শুনছেন রবীন্দ্র সংগীত। রবীন্দ্র না শুনলেতো আবার শিল্পবোদ্ধার সম্মান হারাবেন। কী আর করবেন লালন বা শাহ আব্দুল করিম শুনতে চাইলেও জাত ধরে রাখতে আপনাকে রবি বাবু’র আশ্রয়েই যেতে হবে। কল্পনায় যদি মার্সিডিজের ঠান্ডা আর রবি বাবুর সংগীত আনতে পারেন, তবেই আপনার পথের দুর্ভোগ আনন্দে রূপান্তরিত হবে।
মনীষীরা বলেন, যার কল্পনা করার করার ক্ষমতা নেই, তার বড় মানুষ হয়ে উঠার কোনো সম্ভাবনা নেই। ‘দুর্ভোগ কে আনন্দ মনে করা’টা তারই ধারাবাহিকতা। এ জন্য আপনি যানজট বা ধীরগতিতে যখন পড়বেন, তখন স্মরণ নিতে পারেন এ জাতীয় কোনো মনীষীর। সামনে জমে থাকা গাড়ির দীর্ঘ লাইন ভুলতে অবশ্যই এমন মনীষীর জীবনীগ্রন্থ সাথে নিয়ে যাবেন। অথবা নিতে ভুলে গেলে বাসে হকারদের থেকে ‘বড় হবার সহজ উপায়’ জাতীয় চটি বই কিনেও পড়তে পারেন।
এসব পড়তে পড়তে আপনার হয়তো চোখ দুটো একটু লেগে আসবে। তখনই কল্পনায় দেখতে পাবেন, আপনি গাড়ি নয়, রয়েছেন ব্যক্তিগত জেটে। উড়ছেন। উড়ে যাচ্ছেন মরিসাসে, সমুদ্র বিহারে। বিকিনি পড়া ফর্সা রমণীরা আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছে হোটেল রিসেপশানে। আপনি ফাইভ অথবা সেভেন স্টারের শয্যায়, সাথে --। এমন সময় হয়তো জট ছেড়ে আপনার বাসটি চলতে শুরু করবে। বাসের ঝাঁকুনিতে আপনার কল্পনাটা টুঁটে যাবে, আপনি ফিরবেন কঠিন বাস্তবতায়। হাতের ঘড়ি জানান দেবে, এক ঘণ্টার রাস্তা পেরোতে আপনার লেগেছে পাঁচ ঘণ্টা। অসম্ভব বিরক্তিতে মুখ কোঁচকাবেন আপনি। ভাববেন কল্পনাটাইতো ভালো ছিলো, ‘দুর্ভোগ রূপান্তরিত হয়েছিলো আনন্দে’।
নারী হলে কল্পনায় ভাবুন, আপনি ফিল্মের নায়িকা। ঝাড়ু হাতে মানুষকে সচেতন করতে রাস্তায় নেমেছেন। টিভি ক্যামেরা ছুটছে আপনার পেছনে। প্রতিটা খবরে দেখানো হচ্ছে আপনাকে। বলা হচ্ছে, মানুষকে সচেতন করতে, ভালোবাসার ঝাড়ু হাতে পথে নেমেছেন এই খ্যাত নায়িকা। মানুষের কষ্টে তার হৃদয়স্থল উছলে উঠছে। অথবা হয়ে যান ভারতীয় কোনো টিভি সিরিয়ালের চরিত্র। কল্পনায় খুব করে প্রতিপক্ষের সাথে কোমড় বেঁধে ঝগড়ায় নেমে পড়ুন। দেখিয়ে দিন একহাত, আপনিও কম নন।
তরুণী হলে নায়কের বিপরীতে নায়িকা হয়ে যান। কল্পনায় যান ‘লং ড্রাইভে’ কিংবা ‘রং ড্রাইভে’। কোন সমস্যা নেই ‘লং’ এ ‘রং’ হতেই পারে। না হলে আপনি কিসের আধুনিকা, ‘ইয়ে’গতিশীল। স্কার্ট হাটুর উপর না উঠলে কি জাতে উঠা যায়। যায় না। মধ্যযুগের আবৃত পোশাক, কিংবা লম্বা সব সালোয়ার-কামিজ, বারো হাতের শাড়ি, ডিসগাস্টিং। যানজট অন্যার্থে ধীরগতির এই যাত্রা আপনাকে আধুনিকা ও ‘ইয়ে’শীল হতে আরেকটু এগিয়ে নিয়ে যাবে।
সুতরাং সবাই কল্পনায় থাকুন, যাত্রার দীর্ঘ সময়কে উপভোগ করতে শিখুন। শুধু পথের যাত্রা নয়, জীবনের সকল যাত্রাতেই ‘দুর্ভোগকে আনন্দ’ ভাবার কসরত করুন।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।