• ১৭ আগস্ট ২০১৯ ১৬:১০:১৫
  • ১৭ আগস্ট ২০১৯ ১৬:৫৭:৪৭
অন্যকে জানাতে পারেন: Facebook Twitter Google+ LinkedIn Save to Facebook প্রিন্ট করুন
বিজ্ঞাপন

উন্নয়ন না স্বাধীনতা? : কাশ্মীর এবং অন্যান্য...

ছবি: আলজাজিরা


মাহা মির্জা :


‌ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মম অন্যায়গুলো হয়েছিল উন্নয়নের নামে। উন্নয়ন, সভ্যতা, আর বাণিজ্যের নামে কত মানুষ তার শেষ সম্বল হারিয়েছে, কত মানুষ স্বাধীন থেকে পরাধীন হয়েছে! কাশ্মীরে ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল হলো, সবাই বুঝলো কাশ্মীরের আজাদীর আকাঙ্খাকে নিয়ন্ত্রণ করাই এর উদ্দেশ্যে। কিন্তু নাম হলো উন্নয়নের। 

মোদী বললো কাশ্মীরে বিনিয়োগ হবে, ইকো-ট্যুরিজম হবে, ইন্ডাস্ট্রি হবে। আম্বানি বললো, কাশ্মীরের উন্নয়নকে মাথায় রেখে রিলায়েন্সের 'স্পেশাল টাস্ক ফোর্স' হবে। তাতো হবেই। বহু কোম্পানির বিলবোর্ড দাঁড়িয়ে যাবে ভ্যালিতে। জমি অধিগ্রহণও শুরু হবে। আম্বানির বিনিয়োগ আসবে, রিলায়েন্স আসবে, অন্য প্রদেশ থেকে হুহু করে বাইরের লোক আসবে। কিন্তু এইসব ভিড়ভাট্টায় কাশ্মীরের বেকার ছেলেমেয়েরা চাকরি পাবে? এই বিনিয়োগে শেষপর্যন্ত আম্বানির হোটেলের নৈশগার্ড হবে নাতো কাশ্মীরের জমি হারা কৃষক? এইতো মূলধারার উন্নয়নের ভাষা।

ভারতের নিয়ামগিরিতে যেমন বক্সাইট খনি ছিল, হাজার কোটি টাকার বাণিজ্যের গন্ধ ছিল। ‘ভেদান্তা রিসোর্স’ এলো মাইনিং করতে, ডংরিয়া আদিবাসীরা বলেছিলো, তারা মাইনিং চায় না, উন্নয়ন চায় না, চাকরি চায় না। তারা তাদের মতো বন পাহাড়ে গাইছাগল চড়িয়ে, আলু আর সিম খেয়ে বাঁচতে চায়। শেষপর্যন্ত জঙ্গলের মানুষের প্রতিরোধের মুখে পিছু হটেছিলো কোম্পানি। ২০১৩ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সেই ঐতিহাসিক রায়টি দিলো, নিয়ামগিরির বক্সাইটের পাহাড়গুলো ডংরিয়ার আদিবাসীদের মাঝে ফিরিয়ে দেয়া হোক। 

তারও অনেক আগে উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে মুন্ডাদের জঙ্গল নদী পাহাড় কেড়ে নিয়েছিল ব্রিটিশ রাজের 'ফরেস্ট আপিস'। বলেছিলো মুন্ডারা অশিক্ষিত, অসভ্য, পাহাড়ে উন্নতি নেই, সভ্যতা নেই। তাই জঙ্গল কেটে আধুনিক চাষবাস হবে। মুন্ডাদের উন্নতি হবে। জঙ্গলের গাই-বলদ চড়ানো মানুষ, জঙ্গলের কাঠ-পাতা-মধু সংগ্রহ করা মানুষ হারিয়ে ফেললো জঙ্গলের অধিকার। তখন মুন্ডাদের 'ভগবান' বিরসা মুন্ডা লড়াই করেছিল অরণ্যের অধিকারের জন্য।

মহাশ্বেতা দেবী লিখে গিয়েছেন: ‘জঙ্গলের অধিকার কৃষ্ণ-ভারতের আদি অধিকার। যখন সাদা মানুষের দেশ সমুদ্রের অতলে ঘুমুচ্ছিলো, তখন থেকেই কৃষ্ণ ভারতের কালো মানুষেরা জঙ্গলকে মা বলে জানে।’ কিন্তু কোম্পানি তো বোঝে না মুন্ডা, খাড়িয়া, কোল, ওঁরাওদের বন পাহাড়ের সভ্যতা। তাই ‘অসভ্য’দের ‘সভ্য’ বানাতে চায় মাইনিং কোম্পানি। কিন্তু কে অসভ্য আর কে সভ্য সেই প্রশ্নের উত্তর দেবে কে?

তারও অনেক আগে ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে কলম্বাস খুঁজে পেয়েছিলো আমেরিকা, নতুন ‘সভ্যতা’র গোড়াপত্তন করতে হত্যা করলো কয়েক লাখ নেটিভকে। তারা স্বর্ণের খোঁজে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিতো। মেয়েদের উঠিয়ে আনতো। নেটিভদের হাতে পায়ে লোহার শিকল পরিয়ে দাস বানাতো। কলম্বাস তার জার্নালে লিখেছিলেন, 'Let us in the name of the Holy Trinity go on sending all the slaves that can be sold’। 

স্প্যানিয়ার্ডদের হাত থেকে বাঁচতে আরাওয়াক নেটিভরা কাসাভার বিষ খেয়ে দলে দলে আত্মহত্যা করতো। অথচ আমরা ছোটবেলায় পড়েছি, কলম্বাস এক দুঃসাহসী অভিযাত্রী ছিল, আমেরিকায় পৌঁছে 'জংলী' নেটিভদের বনে বাঁদাড়ে সভ্যতা এনেছিল কলম্বাস!

গত কয়েক বছর ধরে আমেরিকায় নতুন ধরণের এক প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। তারা ‘কলম্বাস ডে’ পালন করতে অস্বীকার করে। বরং মনে করিয়ে দেয়, কলম্বাস কখনোই হিরো ছিলো না, ছিল আদ্যোপান্ত এক খুনী। এই প্রতিবাদটুকুর কারণে তথাকথিত সভ্যতা এবং উন্নয়নের থিওরি কিছুটা হলেও প্রশ্নের মুখে পড়ে।

কলম্বাসেরও আরও দুশো বছর পরে কালো মানুষদের দাস বানিয়ে উত্তর ভার্জিনিয়ায় গড়ে উঠেছিল আখ, তামাক আর তুলাশিল্প। মিসিসিপি আর লুইজিয়ানার দিগন্ত ছোঁয়া তুলার ক্ষেতগুলোতে বিনা বেতনে খেটে যেত কালো মানুষেরা। সাদারা চাবুক মারতো কালোদের আর বলতো, আফ্রিকার জংলীগুলো এমনিতেই রোগে, শোকে, আর বুনো জন্তুর আক্রমণে মরে যায়, বরং দাসরা খেতে পায় আমেরিকায়, থাকার জায়গা পায়। 

আমেরিকান সিনেটর জন ক্যালাহুন দাস প্রথার পক্ষে লিখেছিলেন, ‘Never before has the black race of Central Africa attained a condition so civilized and so improved, not only physically, but morally and intellectually’। এভাবেই দাসপ্রথার সাফাই গাইতে ব্যবহৃত হতো কালো মানুষের ‘উন্নতি’র যুক্তি। আর এভাবেই কালো মানুষের ঘামে গড়ে উঠেছিল সাদা মানুষের তুলা তামাকের অপ্রতিরোধ্য অর্থনীতি।

ব্রিটিশ কলোনিগুলোর পক্ষেও ছিল সেই একই উন্নয়নের বার্তা। ব্রিটিশরা ভারতে রেল লাইন করেছে, পোস্টাল সার্ভিস এনেছে, টেলিগ্রাফ এনেছে, ইংরেজি শিক্ষার প্রসার করেছে। অথচ ভারতীয় অর্থনীতিবিদ উৎসা পাটনায়েক হিসাব করে দেখালো, ভারত থেকে দুশো বছরে ৪৫ ট্রিলিয়ন ডলারের সম্পদ চুরি করেছিল ব্রিটিশ সরকার। ভারতবর্ষ থেকে জাহাজে করে আনা লোহা, কয়লা, আর তুলার উপর ভিত্তি করেই ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটেনের শিল্প বিপ্লবের সূচনা।

তবে এক অঞ্চলের সম্পদ লুটে আরেক অঞ্চলের উন্নয়নের সেই 'কলোনিয়াল' অর্থনীতির মডেল কলোনিগুলোর স্বাধীনতার পরেও তো চলমান ছিল। 

ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়েছিল, কিন্তু পূর্ববাংলার পাট বিক্রির টাকায় গড়ে উঠলো পশ্চিমের তিলোত্তমা ইসলামাবাদ। পাকিস্তানের ‘গোল্ডেন এরা অফ ডেভেলপমেন্ট’। পাকিস্তানের জিডিপি বাড়লো, পূর্ব বাংলাতেও তাই। কিন্তু ওটা কি উন্নয়ন ছিল? ইতিহাস সাক্ষী, পরাধীন মানুষ কি ‘উন্নয়নে’র স্বপ্ন দেখে?

এরপর স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতেও একই ধরণের ‘উন্নয়নে’র আয়োজন আমরা দেখি। ২০১৫ সালে চুনারুঘাটে চা শ্রমিকদের জমি কেড়ে নিয়ে প্রশাসন বললো, ইকোনোমিক জোন হবে, উন্নয়ন হবে, লোকালদের চাকরি হবে। সাজেক থেকে জুম্মদের সরিয়ে, সুয়ালোক থেকে ম্রো-দের উচ্ছেদ করে বলা হলো ট্যুরিজম হবে, ‘শান্তি, সম্প্রীতি, আর উন্নয়ন’ হবে। রামপালের দুর্গাপুর গ্রাম থেকে ২ হাজার হিন্দু পরিবারকে উচ্ছেদ করে তারা বললো খুলনার মানুষ, বাগেরহাটের মানুষ উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাবে। কেউ প্রশ্ন করলো না, উন্নয়ন যদি করবেই তবে খুলনার বহু বছরের পুরোনো পাটকলগুলোকে একে একে ধ্বংস করা হলো কেন? কেন ধুলায় লুটিয়ে রইলো সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসীম সম্ভাবনাময় রাষ্ট্রীয় শিল্প কারখানাগুলো?

আসলে উন্নয়নতো এভাবে হয় না। এক অঞ্চলের সম্পদ লুটে আরেক অঞ্চলের উন্নয়ন তো সেই 'কলোনিয়াল' সময়ের উন্নয়ন। কাশ্মীরের মানুষকে কাশ্মীরেই সংখ্যালঘু বানিয়ে মোদি আর আম্বানির ‘স্পেশাল টাস্ক ফোর্স’ তো সেই ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রহসনের উন্নয়ন।

বেগমখান চা বাগানের এক নারী শ্রমিকের আর্তনাদ এখনো আমার কানে বাজে। ইকোনোমিক জোনের নামে তার ফসলি জমিটুকু কেড়ে নেয়ার প্রতিবাদ করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘এই যে আমরা ফসল ফলাই, এতে কি উন্নয়ন হয় না? নতুন করে আমাদের আর কোন উন্নয়নের দরকার নেই।’

‌লেখক: গবেষক, লেখক ও এক্টিভিস্ট।

সংশ্লিষ্ট বিষয়

কাশ্মীর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
Page rendered in: 0.1520 seconds.