• ২৩ আগস্ট ২০১৯ ২২:৩০:৩৬
  • ২৩ আগস্ট ২০১৯ ২২:৩০:৩৬
অন্যকে জানাতে পারেন: Facebook Twitter Google+ LinkedIn Save to Facebook প্রিন্ট করুন
বিজ্ঞাপন

সাঈদ বিলাস এর গল্প

ঊনমানুষ

বাতাসের মায়রে বাপ! গাছের একটা পাতাও নড়ে না। রইদের ত্যাজে গা পুড়ে যাচ্ছে! ব্রিজের উপর ভাসমান হকাররা সবে দোকান খোলা শুরু করেছে,দুই একজন কারবারও শুরু করে দিয়েছে-‘দেড়শোর মাল একশো লন, দেড়শোর মাল একশো,দেড়শোর মাল একশো’- বইলা তালে তালে আওয়াজ দিচ্ছে। ব্রিজের নীচেই উত্তর দিকে ট্রেনের দুইটা বাতিল বগি ঠায় খাড়ায়া আছে না জানি কত শত দিনের সাক্ষ্য লইয়া! কয়েকজন টোকাই ডান্ডি খেয়ে চিৎ হয়ে পড়ে আছে; আর কয়েকজন গাঞ্জায় বুদ হয়ে বগিতে হেলান দিয়ে গান ধরেছে – ‘আমি মাল খাব, টাল হবো, তাতে কার বাপের কী’! চারিদিকে গাঞ্জার ম ম গন্ধে রোদকেও মেয়ে লোকের শরীর ভেবে গায়ে মেখে নিচ্ছে কেউ কেউ। ব্রিজের ওপর শয়ে শয়ে মানুষের চলাচল শুরু হয়ে গ্যাছে। খালি ছুটছে, কারো থামবার জো নাই, মাঝে মাঝে অবশ্য দুই একজন থামছে টুকিটাকি দরকারি জিনিস কিনবে বলে। কেউ কারো দিকে তাকায় না আর তাকালেও সন্দেহ, আতঙ্ক, অবিশ্বাস কিংবা উদ্ভট দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। কিন্তু যা থেমে নাই, তা হলো এদের ছুটে চলা। কে ছুটছে না! ছুটা শ্রমিক থেকে শুরু করে গার্মেন্টস শ্রমিক, ছাত্র, শিক্ষক, চাকুরিজীবী, পকেটমার, শিল্পপতি, দালাল, বড় চোর-ছোট চোর, ভবঘুরে সবাই ছুটছে। কিন্তু ক্যানো এতো ছুটছে? কোথায় ছুটছে? কিসে তাড়া করছে সবাইকে?

হঠাৎ হঠাৎ বিকট আওয়াজ কানে বাজে, বোঝা যায় বড় বড় কন্টেইনার খালাস হচ্ছে ডিপোতে। মানুষও খালাস হচ্ছে নাকি! আড়াই-তিন কোটির দু’পেয়ে প্রাণীর এই শহরে সবাই খালাস হচ্ছে নাকি! হচ্ছে বৈকি! এই যেমন সেলাই মেশিনের সাথে গার্মেন্টস শ্রমিক, প্যাডেলের সাথে রিক্সা-ভ্যানওয়ালা অথবা পোড়া ডিজেলের সাথে বাস-ট্রাক-লেগুনা শ্রমিকরা খালাস হচ্ছে কিংবা আমলে নেয়া যায় নর্দমার গুয়ের সাথে মেথর, রাস্তার ধূলাবালির সাথে ঝাড়ুদার অথবা ভাতের জন্য মাইরের সাথে বাসার কাজের লোকের খালাস হওয়া বা ক্ষুধার সাথে বেশ্যার শরীরের খালাস হওয়া? আচ্ছা সবার ভালোবাসা কী তাহলে এই ক্ষুধা বা শরীরের সাথেই?

রইদের ত্যাজে আসলেই গোয়া ফাটতেছে। সারি সারি রিক্সা দাঁড়ায়া আছে স্টেশনের বাইরে, ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছে রিক্সাওয়ালারা। ট্রেন আসলেই হুড়মুড়িয়ে যাত্রীরা আসবে। নানা রঙ্গের, নানা ঢঙ্গের, নানা সাইজের, নানান শ্রেণি-পেশার, চাকুরীচ্যূত বা চাকুরীহীন বেকার, ঘর খোয়ানো বা ঘর খ্যাদানো এই রকম হরেক কিসিমের মাইনষের একটা করে ঢল নামে কিছুক্ষণ পর পর। কারো হাতে ইয়া বড় বড় ব্যাগ, তো কেউ মনে হয় বাড়িশুদ্ধ তুলে নিয়ে আসে ব্যাগে! তারপর কুলি দিয়ে মাল টানায় আর দেনদরবার করার সময় অনেকেরেই লেগে যায় কুলির সাথে একচোট। মারামারিও লাগে মাঝেমাঝে। তারপর এই ছোটলোকের বাচ্চাগুলো কত খারাপ, দেশের জন্য এরা কত ক্ষতিকর এই বিষয়ে ভাষণ দিতে দিতে গজরাইতে গজরাইতে বের হয়ে যায় ভদ্রলোকেরা! কেউ কেউ আসে খালি হাতে, কেউবা ট্রেন থেকে নেমে বের হওয়ার রাস্তা খুঁজে পায় না; আতঙ্কিত চোখে তাকায় চারিদিকে, তারপর যথারীতি ধরা খায় টিটির কাছে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে লুঙ্গির ট্যাকে কিংবা শাড়ীর ভাজে যে কয়টা টাকা গোঁজা থাকে, শহরে আসার খাজনা হিসেবে ওইসব মহাপরাক্রমশালী টিটির হাতে কিংবা রেল পুলিশের হাতে অথবা তারই সমগোত্রীয় কোনো বাটপারের (যে হয়তোবা একসময় তারই মতো এরকম খাজনা দিয়েছিলো) হাতে দিয়ে আরো আতঙ্কিত হয়ে এই শহরের রাস্তায় নেমে পড়ে। এই শহর গিলে খাওয়া শুরু করে তাদের!

কোনো এক ভ্যাপসা গরমের রাতে ট্রেন থেকে নেমে পড়ে মোকলেচ আর আসমা। গন্তব্য টিটিপাড়া বস্তি। এলাকার আসলামের সাথে কথা হয়েছে মোকলেচের; বস্তিতে গিয়ে আজকে রাতটা থেকেই কালকে থেকে রিক্সা নিয়ে নেমে পড়বে, আসলাম সব ব্যবস্থা করে রেখেছে। কিন্তু স্টেশন থেকে নেমে কিছু ঠাওর করতে পারে না মোকলেচ, আসলাম অবশ্য বাড়িতে বলেছিলো স্টেশন থেকে নেমে একটু হাঁটলে, জিজ্ঞেস করলে যে কেউ দেখায়া দিবে। শালা, আসলাম এখন ফোনও ধরছে না। এখন এতো রাতে আসমাকে নিয়ে মোকলেচ কি করবে? স্টেশনের বাইরে ওরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, আশেপাশেই কয়েকটা মাস্তান গোছের লোক ঘোরাফেরা করছে। এইবার মোকলেচের ভয় লাগা শুরু করে। মোকলেচ করে কী, সামনে এক দোকানদারকে জিজ্ঞেস করে আসমাকে নিয়ে টিটি পাড়ার দিকে রওনা দেয়। ল্যাম্পপোস্টের নিয়ন আলোর সাথে সাথে চাঁদটাও রওনা দেয় ওদের সাথে। কিছুদূর যেতেই কমলাপুর কনটেইনার ডিপোর মুখে চারজন ঘিরে ধরে ওদেরকে। ভয়ে আসমা চিৎকার দেয়, কিন্তু তার চিৎকার বোবা গোঙানির মতো বাতাসে মিলিয়ে যায়। একটু দূরেই একটা পুলিশ ভ্যান দাঁড়ায়া আছে। দু’জন পুলিশ মনের সুখে সিগারেট টানছে, যেনো সিগারেট টানার থেকে বড় কোনো কাজ দুনিয়ায় নাই! এর মধ্যেই দু’জন আসমার মুখ চেপে ধরে আর দু’জন মোকলেচকে ধরে, মোকলেচ গায়ের সব জোর দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করে ওদের। কিন্তু সে পেরে উঠবে ক্যানো ওদের সাথে, ওই দুইজন মোকলেচকে আচ্ছামতো পিটিয়ে,মাথা ফাটিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই হাওয়া হয়ে যায়। মোকলেচ আসমারে খোঁজে! আহা আসমা! কিন্তু আসমা কই? মোকলেচ দ্যাখে, বাড়ির পাশে ঘাটে বাঁধা নৌকা, মাছ ধরতে যাবে ছেলেকে নিয়ে, কিন্তু ছেলেটা ঠাডায় পড়ে মরলো! আহা, মাছ, কত মাছ! বাজারে বিকোবে? ছেলেটা একটা ব্যাগ কিনবে; কত শখ ছিলো পড়বে স্কুলে? জমিখান খেয়ে নিলো নদী আর ভিটেছাড়া করলো জামাল হারামজাদা! নিজের ভাইয়ের মতো দেখতো মোকলেচ ওরে। সেই হারামজাদারই কিনা নজর পড়লো ওর বাড়ির দিকে! চেয়ারম্যানের সাথে মিলা বুদ্ধি কইরা খেদায়া দিলো নিজের ভিটে থেকে।

কালুর জায়গায় শুয়ে থাকার অপরাধে, এক লাথি খেয়ে উল্টে চিৎ হয়ে মাথায় হাত দেয় মোকলেচ, চেয়ে দ্যাখে পাঠার মতোন শরীর নিয়া একজন খাড়ায়া আছে। এখনও ভোরের আলো ফোটে নাই, মোকলেচ আসমার কথা জিগায় কালুরে। কালু একটা বিশ্রী হাসি দেয়, বলে আসমার কথা ভুলে যেতে। ওরে আর পাওয়া যাবে না।

এরপর থেকেই মোকলেচরে পাওয়া যায় কালুর সাথে, ডান্ডি খাইতেছে মনের সুখে। রাস্তার মাঝে আইল্যাণ্ডে বইসা মোকলেচ আর কালু ডান্ডি খায় আর ঝিম মেরে বসে থাকে। কালু এক নাগাড়ে প্যাচাল পাড়তে থাকে আর মোকলেচ চুপচাপ শোনে। কালুর আলাপের ধরনটা শোনা যায়, ’কি করুম,ঠাওরাতে পারি না,মামা! চল যাই দেহি দূরে ওই কুইত্তাগুলা মারা খাইয়া হুইয়া আছে, অগো লগে ঘেউ ঘেউ কইরে আহি। মাইনষের প্যাচাল হোনার চাইয়া হ্যাগো ঘেউ ঘেউ অনেক ভালা, মামা।‘ মোকলেচ মাথা নাড়ে শুধু। কালু বলে যায়, ‘গেরামে যহন আছিলাম, তহন বড় বট গাছটার নিচে ম্যালাদিন কুইত্তাটার সাথে হুইয়া থাকছি মামা; দ্যাকছি মাইনষের থাইকা কুইত্তা বেশি বুঝনেওয়ালা, বেশি আপন। সঙ্গী আছিলো ওই কুইত্তাটাই। কিন্তু একদিন ওইটারেও মাইরা ফ্যালাইলো কিছু জাউরা পোলাপান। তারপর একদিন স্রেফ উধাও হইলাম। এলাকা ছাইড়া দিলাম; আমি কেডা? আমার তো কেউ নাই। হেরপর থিকা যে হাঁটছি তো হাঁটছিই; মইদ্যে মইদ্যে ক্লান্ত হইয়া রাস্তা ঘাটে হুইয়া পড়তাম। মাইনষের ফেলায় দেওয়া খাবার খাইয়াই আমার দিন শ্যাষ,মানুষের কিল ঘুষি লাত্থি না খাইলে ঘুম হয় না। আগে গেরামের মানুষ ভিক্ষা দিত, ওইগুলাও এখন বদের হাড্ডি হইছে, কুইত্তার মতো খেদায় দ্যায়। বড় বাজারে গিয়া উঠলাম। সেইখানে রাইতে ব্যাপারির পুটকি মারা খাইতে খাইতে আর ধন চুষতে চুষতে মাইনষের ওপর ঘেন্না ধরে গ্যাছে। রাইতে পুটকি মারার সময় হালার কী যত্ন আর দিনের বেলায় ভাত চাইলে, ট্যাকা চাইলে লাত্থি। ট্যাকা থাকলে বান্দীর বাচ্চার পুটকি দিয়া ট্যাকা ঢুকায়া কইতাম, নে ট্যাকার পুটকি মার খানকির বাচ্চা! হেরপর থিকা বাজারের মাথায় রাইতে ঘুমাইতাম, মাঝে মাঝে বাল চুলকাইতাম, রাতে আর এক মাতারির ছাওয়াল আইসা বইসা থাকতো, কখন গোয়া মারবো। মনে হয় আমার গোয়া গনিমতের মাল, যেমন খুশি তেমন মারা যায়। এই গোয়া মারামারির অত্যাচারেই একদিন বিনা টিকিটে টেরেনে চইড়া বইলাম। আইলাম ঢাহায়; এইহানে আইয়া মনে কর, দেহি পরছি মাইনকা চিপায়। আওগে তো মারা খাইয়া তাও প্যাটে কিছু ঢুকত, এইহানে হালারা খালি গোয়া মারে, তাও মিছা কথা কইয়া, ফইন্নির পো’রা ট্যাকা দিবি না, এইটা কওয়ারও সাহস নাই। মাগনা গোয়া মারতে চায়। কোনো ফইন্নির পুত, মাতারির বাচ্চা খাবার দ্যায় না, কামও দ্যায় না। তাই অহন খালি ডান্ডি খাই আর বিচরাই কহন মাইনষের পুটকি মারবো।‘ মোকলেচ শুধু চুপচাপ শোনে। তারপর ঝিম মাইরা থাকে দুইজন। দুপুরবেলায় যায় ডাস্টবিনে ফেলে দেয়া খাবার কুড়ায়া খেতে।

এভাবেই ওদের দু’জনের দিন কেটে যায়। ডান্ডি, ডাস্টবিনের খাবার, গাঞ্জা আর কিল-ঘুষি! এইতো জীবন!মাঝে মাঝে গাঞ্জার টাকার ভাগ নিয়ে স্থানীয় গডফাদার-পুলিশ-নেতাদের সাথে কালুদের ভয়ঙ্কর ক্যাচাল লাগে। পরিণতিতে দুই একটা লাশও পাওয়া যায় রেল লাইনের আশেপাশে। 

অনেক দিন পর, একদিন সকালে খিলগাঁও রেল লাইনের পাশে কালুর ছোপ ছোপ রক্তে ভেজা লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। কালুকে কে মেরেছে বা কীভাবে মরেছে তা অবশ্য জানা যায় না। জানে শুধু পিঁপড়া আর মাছিরা, আর জানে কালুর লাশ ঘিরে থাকা কুত্তারা। এই শহরে আর একটা বেওয়ারিশ লাশ বাড়ে শুধু। কেউ কি কোথাও কাঁদে?

এখন, মাঝে মাঝে মোকলেচকে দেখা যায়, স্টেশনের আশেপাশে আধা ন্যাংটা হয়ে ঘুরে বেড়ায় আর হঠাৎ হঠাৎ মানুষের কাছে গিয়ে চিৎকার দিয়ে বলে, ‘ট্যাকা দে খানকির বাচ্চা’। আসমার খবর অবশ্য পাওয়া যায় না। কেউ জানে না সে কোথায়?

জানে শুধু এ বিবর্ণ শহর!

সংশ্লিষ্ট বিষয়

গল্প সাঈদ বিলাস

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
Page rendered in: 0.1477 seconds.