ছবি : সংগৃহীত
আনিস রায়হান :
কাশ্মীরে কী হয়েছে? জবাবে একদল বলছেন, ভারত সরকার ৫ আগস্ট ২০১৯ কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নিয়েছে। ফলে কাশ্মীর এখন থেকে কেন্দ্রীয় শাসনের অধীন থাকবে এবং সেখানে ভারতের যেকোনো এলাকার লোক এসে জমি কিনতে, থাকতে, কাজ করতে পারবে।
এভাবে ভারত সরকারের পরিকল্পনা সফল হলে কাশ্মীরিদের স্বকীয়তা ও অধিকার সংকুচিত হবে। ধীরে ধীরে তারা সামাজিক ও আর্থিকভাবে আগের চেয়ে দুর্বল ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।
অন্যদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, কাশ্মীরের জন্য এটা একটা নতুন যুগের সূচনা, এর মধ্য দিয়ে বহু বছরের কষ্ট থেকে তারা মুক্ত হবে। তার দল বিজেপির নেতা ও কর্মীরাও মনে করেন, কাশ্মীর দীর্ঘদিন ধরে গোলযোগের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছে। এখন তার অবসান ঘটতে চলেছে। কাশ্মীরে এখন ব্যাপক উন্নয়ন হবে। ভূস্বর্গ হিসেবে খ্যাত কাশ্মীর ভারতের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখবে। বিশ্বের কাছে ভারত হয়ে উঠবে আরো আকর্ষণীয় ও উপভোগ্য।
ভারতের ও বিশ্বের প্রথম সারির সংবাদ মাধ্যমগুলো জানিয়েছে, উপরের দুই মতের কোনোটিই বেঠিক নয়। তারা বলেছে, কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা রদ করা নিয়ে ভারতে 'মিশ্র প্রতিক্রিয়া' দেখা গেছে। কেউ কেউ এর পক্ষ নিয়ে আনন্দ, উল্লাস ও মিষ্টি বিতরণ করেছে। আবার কেউ কেউ এই পদক্ষেপের সমালোচনা করে ক্ষোভ জানিয়েছে। এভাবে বিশ্ববিবেক বা জাতির বিবেক হিসেবে পরিচিত সংবাদ মাধ্যমগুলো 'ভারসাম্য' রক্ষা করে চলেছে। অবশ্য কাশ্মীর উপত্যকাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা সংক্রান্ত তথ্যে পরিপূর্ণ নানা খবরও প্রচার করা হয়েছে।
কিন্তু কাশ্মীরি জনগণ দীর্ঘদিন ধরেই ভারতীয় শাসনযন্ত্রের নির্মম নিপীড়নের শিকার। খুন, গুম, গ্রেপ্তার, অত্যাচার, গুলি, টিয়ার গ্যাস সেখানকার জনগোষ্ঠীর জীবনের অংশ হয়ে গেছে। তথ্য-উপাত্ত বলছে, ওই এলাকা বিশ্বের সবচেয়ে সামরিকীকৃত এলাকা। তিন দশকে সেখানকার প্রায় ৫০ হাজার মানুষ খুন বা গুমের শিকার হয়েছেন। এই আগুনের লাভার ওপর দাঁড়িয়েই ভারত সরকার সেখানে এমন কিছু পরিবর্তন আনল, যার মাধ্যমে কাশ্মীরিদের আরো সহজে দমন করা যেতে পারে। এই সত্যটি প্রচার পেল না, বরং বলা হলো 'মিশ্র প্রতিক্রিয়া'র কথা।
২.
মোদি ও বিজেপিপন্থীদের যে ভাষ্য তার সপক্ষেই দাঁড়িয়েছে ভারতের মূলধারার গণমাধ্যম ও আদালত। সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি অরুণ মিশ্রর নেতৃত্বাধীন ডিভিশন বেঞ্চে মামলাটির শুনানি চলাকালে বিচারপতিরা জানিয়ে দেন, জম্মু-কাশ্মীরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে সরকারের ওপরই ভরসা করতে হবে। কার্যত ভারতের সরকার, গণমাধ্যম ও আদালত মিলে আইনের শাসনই প্রতিষ্ঠা করেছে। এরকম আইনের শাসন পৃথিবীর সব দেশেই আছে। আইনের কথা বলে, জনগণকে নিপীড়ন, শাসকশ্রেণীর স্বার্থোদ্ধার, সব বুর্জোয়া দেশেই চর্চিত।
কাশ্মীরিদের সঙ্গে এটাই ঘটছে। ভারত রাষ্ট্র ও তার শাসকশ্রেণি কাশ্মীরের ওপর পূর্ণ দখল প্রতিষ্ঠায় সেখানকার জনগণের ওপর এক মরণ কামড় বসিয়েছে। এতে করে কাশ্মীরীরা খুব বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, কেবল ভারত রাষ্ট্র থেকে নয়, গোটা বিশ্বের কথিত বিবেক ও নীতি নির্ধারকদের কাছ থেকেও। এটা অবশ্য খুব খারাপ কিছু নয়। এই যে মিডিয়া, আদালত, রাষ্ট্র, গণতন্ত্র, বড় দেশ ও বিশ্বসংস্থার চেহারাটা আবারো উন্মোচিত হলো, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ এক আশার দিক। ভারত রাষ্ট্র থেকে কাশ্মীরিরা আলাদা হতেই চায়। এখন বিশ্ববিবেক ও নীতি নির্ধারকদের প্রকৃত চেহারাটা আমলে নিতে পারলে এসব থেকে পৃথক হয়ে নিজেদের পথটা কেটে এগোতে পারবে। যা কিনা বাদবাকি বিশ্বের নিপীড়িতদেরও পথ দেখাতে পারে।
৩.
ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিনিয়োগকারীদের উৎসাহ দেখিয়েছেন কাশ্মীরে লগ্নি করতে। ইতোমধ্যে বিজেপির ঘনিষ্ঠ ও ভারতের সবচেয়ে বিত্তশালী ব্যবসায়ী মুকেশ আম্বানি সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছে অচিরেই তারা কাশ্মীরে বিশাল অঙ্কের লগ্নি করবে। এসব ঘোষণা থেকে পরিষ্কার যে, বিজেপি কেন এই খেলায় নেমেছে। লাদাখকে কাশ্মীর থেকে আলাদা করার পেছনেও এই চিন্তা কাজ করেছে। লাদাখের জনসংখ্যা ও জনপদ সীমিত হলেও এটা গুরুত্বপূর্ণ যে, এলাকাটা আয়তনে বিশাল ও পর্যটন ব্যবসার উর্বর ক্ষেত্র। কেন্দ্রীয় শাসন বসালে মাত্র লাখ তিনেক জনগোষ্ঠীর লাদাখে পর্যটন ব্যবসার বিস্তার ঘটানোর পাশাপাশি সেখানকার প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করে কেন্দ্রে পাচারের ব্যবস্থাটাও সহজে করা যায়।
বিজেপির পরিকল্পনার মর্মার্থ খুবই পরিষ্কার। তারা কাশ্মীরের প্রকৃতি বদলে দিতে চায়। এখানকার ঐক্যবদ্ধ, প্রতিবাদী সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের তারা দুর্বল ও বিচ্ছিন্ন সম্প্রদায়ে পরিণত করতে চায়। হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্বকে তীব্রতা দিয়ে ও কাজে লাগিয়ে তারা কাশ্মীরের ভূমি ও সম্পদের ওপর ভারতরাষ্ট্রের সুবিধাভোগী শ্রেণিটির অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এজন্য আইন করে তারা কাশ্মীরে জমি কেনার ব্যবস্থা করেছে। ক্রমান্বয়ে এখানে বহিরাগতদের সংখ্যা বাড়ানো হবে। তিব্বতে যে চীনের মূল ভূখণ্ডের বাসিন্দাদের আবাস ও ব্যবসা বাড়ানো হয়েছে, বিজেপিকে সেটাই পথ দেখাচ্ছে।
জানা যাচ্ছে, জম্মু ও কাশ্মীরে মোতায়েন প্রায় ৫ লাখ ভারতীয় সৈন্যের অনেকেই সেখানে জমি কিনেছে। কাশ্মীরের পর্যটন ব্যবসা ও স্থানীয় শিল্পবাণিজ্য থেকে মুনাফার আকাঙ্ক্ষা তাদের ঝুঁকি নিতে উদ্বুদ্ধ করছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকারের প্রণোদনা। তবে এটা দ্রুতই প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো পেতে চলেছে। ভারত সরকার ঘোষণা দিয়েছে, অক্টোবরে সেখানে একটি আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলনের আয়োজন করা হবে।
এছাড়া বর্তমান পরিস্থিতিতে বিজেপি চাইবে, কাশ্মীরে নতুন রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠা ঘটাতে। নবীন প্রজন্মের সমঝোতাপন্থী রাজনীতিবিদদের তুলে এনে তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নতুন একটা আঞ্চলিক শক্তি গড়ে তুলতে চাইবে। এভাবে কাশ্মীরকে আরো নানাভাবে বিভক্ত করে ফেলা হবে।
৪.
কাশ্মীরি জনগণের ইতিহাস যারা জানেন, তারা আন্দাজ করবেন যে, বিজেপির এসব পরিকল্পনা খড়কুটোর মতো ভেসে যাওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল। কাশ্মীরিরা দিনের পর দিন ভারতীয় বাহিনীর নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনা করে আসছেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকে তারা দ্রুতই সংগঠিত হবেন এবং আন্দোলন গড়ে তুলবেন। এ দফায় রাষ্ট্রীয় অবরোধের শুরু থেকেই দেখা গেছে এই প্রতিরোধের নমুনা। সুযোগ পেলেই কাশ্মীরিরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করছেন, আন্দোলন সংগঠিত করার চেষ্টা করছেন। এই সংগ্রাম কবে পরিণতি পাবে, তা বলা মুশকিল হলেও এটা আন্দাজ করা যায় যে, কাশ্মীর পৃথক হওয়া কিংবা কাশ্মীরিদের কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো সমাধান না আসা পর্যন্ত ভারতের কেন্দ্রে যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক, তাদের অন্তবিহীন এক যুদ্ধের মধ্যে থাকতে হবে।
ভারতের জনগণ দিনের পর দিন এসব অনাচার মেনে নেবে, তার নিশ্চয়তা তাদের কে দেবে! ইতিমধ্যে নাগাল্যান্ডে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলিত হয়েছে। ভারতের বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী কাশ্মীরিদের অবস্থা দেখে নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে। ফলে বিজেপি সরকারের 'কাশ্মীর জয়' ভারতের শাসকশ্রেণির জন্য বুমেরাং হতে পারে, খুলে দিতে পারে এই অঞ্চলের নিপীড়িত জাতি ও জনগণের মুক্তির চির আকাঙ্ক্ষিত পথ।
লেখক: সাংবাদিক ও সংগঠক