ছবি : সংগৃহীত
‘স্কুলে যেতে আমার ভালো লাগে না। এতো এতো পড়া দেয়, এতো লেখা দেয়, আমার ভালো লাগে না। আবার একটুতেই বকা দেয়।’ রেদওয়ানকে প্রশ্ন করতেই এভাবে অবলীলায় বলে চলে নিজের মনের কথা গুলো। পুরো নাম রেদওয়ান রহমান, রাজধানীর দীন কে.জি এন্ড জুনিয়র হাই স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র। ছাত্র হিসেবে খারাপ না স্কুলে তার অবস্থান চতুর্থ। কিন্তু ভালো ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও পড়তে বা স্কুলে যেতে তার ভালো লাগে না।
তার ভালো লাগে খেলতে আর ছবি আঁকতে। সকাল ৮ টায় ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে পড়া, স্কুল, ছবি আঁকার প্রাইভেট, কোচিং, আরবি শিক্ষক আবার পড়া এরপর খেয়ে ঘুম, ছোট্ট রেদওয়ানের সময় নেই। শুধু রেদওয়ান নয় একই অবস্থা কমবেশি সব শিশুদের। রাজধানীর ৬টি স্কুলে শিশু শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে একই চিত্র পাওয়া গেছে।
শিশুদের এমন উত্তরের কারণ খোঁজ করতে গিয়ে হাতে আসে তাদের সিলেবাস ও একাডেমিক কারিকুলাম। সেখানে দেখা যায়, শিশু শ্রেণি বা কেজি, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে একজন ছাত্রের মোট বই সর্বনিম্ন ৭টি।
সিলেবাস অনুসারে, সরকার নির্ধারিত বইয়ের পাশাপাশি এসব শিশুদের ইংরেজি ও বাংলা উভয় বিষয়ে পড়তে হয় ভাষা, ব্যাকারণ, বর্ণ, শব্দ, পদ, বচন ইত্যাদির সংজ্ঞা, লিঙ্গ পরিবর্তন। এছাড়াও লিখতে হয় এক কথায় প্রকাশ, অনুবাদ, ভাব-সম্প্রসারণ ও অনুচ্ছেদ (রচনা)। প্রথম শ্রেণিতেই পড়তে হচ্ছে নামতা ও জ্যামিতি (বৃত্ত, রেখা, ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ,কোণ)।
সাধারণ জ্ঞান বিষয়ে পড়তে হয়, বাংলাদেশের প্রথম, বৃহত্তম, দীর্ঘতম, উচ্চতম,ক্ষুদ্রতম, শীতলতম, উষ্ণতম, বাংলাদেশের স্থাপত্য ও ভাষ্কর্য এবং জনসংখ্যা উপজাতি ও নৃ-গোষ্ঠী বিষয়ে পড়তে হয়। এছাড়াও বিভিন্ন দেশে, রাজধানী ও মুদ্রা ( এশিয়া, ইউরোপ, উত্তর-দক্ষিণ আমেরিকা) ও সার্ক পড়তে হয়।
ধর্ম শিক্ষায় বিভিন্ন সূরা পড়তে হয়। এছাড়াও কম্পিউটারের ইতিহাস এর জনক, সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট, মনিটর, মাউস, ডিস্ক, ভাইরাস, নেটওর্য়াক ইত্যাদি সম্পর্কে পড়তে হয়।
আবার প্রথম, দ্বিতীয় ও বার্ষিক পরীক্ষা ছাড়াও বছরব্যাপী রয়েছে বিভিন্ন ক্লাস ও টিউটেরিয়াল পরীক্ষা। আর নর্থ লাইন এসোসিয়েটস লিমিটেড আলাদা করে বছর শেষে প্রথম শ্রেণি ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে বৃত্তি পরীক্ষা নেয়।
রাজধানী কয়েকটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ রংপুরের কিন্ডারগার্টেন স্কুল গুলোর সংগঠন নর্থ লাইন এসোসিয়েটস লিমিটেড’র কেজি হতে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত সিলেবাসে এমন সব চিত্র উঠে আসে।
ছোট ছোট শিশুদের পাঠের এই বিষয় গুলো কতটা মঙ্গলজনক? তাদের মানসিক বিকাশের দিক এই বিষয় গুলো কতটা ফলদায়ক? নাকি আমরা আমাদের নিজের অজান্তেই তাদের শিশুবৃত্তিকে ধ্বংস করছি? যা একজন শিশুর মানসিক বিকাশ রুদ্ধ করে দিয়ে শিক্ষাকে বোঝা বানিয়ে তাদের নিজেস্ব চিন্তার শক্তিকেই ধ্বংস করছে। যার মধ্যে দিয়ে তৈরী হচ্ছে বাস্তব জ্ঞানহীন মুখস্তবিদ্যা নির্ভর একদল জাতি! এই সব প্রশ্নে উত্তর খুঁজতে বাংলা কথা বলে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তি সাংবাদিক, গবেষক ও শিক্ষাবিদ আবুল মোমেন ও শিক্ষাবিদ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ এর সাথে।
এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বাংলা’কে বলেন, ‘এগুলো আসলে টু মাচ... টু মাচ! বাচ্চাদেরকে আনন্দের মধ্যে খেলার ছলে শিক্ষা দিতে হবে। ওরা যাতে এটাকে বোঝা (বার্ডেন) মনে করতে না পারে। আনন্দের সাথে। যেমন- একটা হাত তালি দিলো এটা এক, দুইটা হাত তালি দিলো এটা দুই। কিংবা বল, লাল রং এর একটা বল, নীল রঙের দুইটা বল, সবুজ রঙের তিনটা বল। ওই জিনিস দেখে সে অংকের ১-২-৩ শিখবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘ওদের উপরে যদি আমরা বোঝা চাপিয়ে দেই তাহলে সারা জীবন শিক্ষার প্রতি ওদের অনীহা চলে আসবে। এটা (শিক্ষা) তার কাছে অপছন্দের জিনিস হবে। এটা আমরা বুঝি না, আমরা শিশুদের অনেক অনেক তথ্য দিতে চাই। আনন্দের বালাই সেখানে নাই। এরা (শিশুরা) মনে করে এটা তাকে কষ্টদের জন্য দেয়া হচ্ছে।
ড. কায়কোবাদ আরো বলেন, ‘শিশুরা খেলাধুলা করবে। খেলাধুলার মাধ্যমে তার পৃথিবীর সাথে পরিচিত হবে, বিভিন্ন রঙের সাথে পরিচিত হবে, গাছের সাথে পরিচিত হবে। এর মাধ্যমে শিশুদের মনে কৌতুহলের সৃষ্টি হবে সব গাছের পাতা এক রকম না। তাদের শিশু মনে কৌতুহল জাগবে কেন এক রকম হয়, কেন ভিন্ন রকম হয়। আমরা যদি ওদের উপর চাপ প্রয়োগ করি কত গুলো স্বরবর্ণ, কতগুলো ব্যাঞ্জন বর্ণ এটা হলো না। আমাদের দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি? আসলে আমরা কোথাও নাই। এই বৃত্ত থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।’
শিশুদের পড়নোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘শিশুদের পড়ালেখাটা হবে খেলার ছলে, আনন্দের সাথে। এখানে যেন নিরানন্দ না হয়, এটা যাতে তার বোঝা হয়ে না দাঁড়ায়। এমনকি তার ব্যাগটাও। একটা উন্নত দেশে বই বোঝাই করে ব্যাগ বাসায় নিয়ে যেতে দেয় না। বই থাকে স্কুলে। বাসা আনবে গল্পের বই। আমার মনে হয় চাপ শুধু শিশুদের উপর নয় উপর ক্লাসেও এই রকম চাপ আছে। আমরা বাচ্চাদের কোথায় নিয়ে যেতে যাচ্ছি? না, এরা হঠাৎ করে বিজ্ঞানী হয়ে যাচ্ছে না।’
এমন শিক্ষার প্রভাব সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘শিশুদের উপর বোঝা চাপিয়ে দিলে পড়ালেখার প্রতি রীতিমত অনাগ্রহ জন্মে যায়। এটা শিশু করবে না, এটা নিরানন্দের কাজ। অনেক শিশু দেখবেন স্কুলে যেতে চায় না। মানে স্কুলটা আনন্দের জায়গা না। আমরা জানি আমাদের সম্পদের স্বল্পতা আছে, উন্নত দেশে অনেক অনেক কিছু থাকে। এখন আমাদের একটা পথ বের করতে হবে। অন্তত তারা যাতে পড়ালেখার প্রতি অনাগ্রহ তৈরী না হয় তার জন্য চেষ্টা করতে হবে।’
এ সময় হতাশা প্রকাশ করে এই শিক্ষাবিদ বলেন, ‘আমরা বিনিয়োগ করি খুবেই কম, যা চাহিদা তার তিন ভাগের এক ভাগ মাত্র। এ থেকে বুঝতে হবে শিক্ষার প্রতি আমাদের যথেষ্ট অনাগ্রহ আছে। আমরা বুঝতে পারছি না যে, আমাদের একমাত্র উদ্বৃত্ত হলো মানুষ। এদেরকে যদি আমরা জনসম্পদে রুপান্তর করতে পারি তখনই কেবল আমাদের দেশে অগ্রগতি লাভ করবে। তা ছাড়া অগ্রগতি আসবে না।’
এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ আবুল মোমেন বাংলা’কে বলেন, ‘এখন এমন স্কুল তো নানাজন নানাভাবে দিচ্ছে। দেওয়ার সুযোগটা আছে বলেই দিচ্ছে। যেহুত ছাত্র সংখ্যা অনেক দেশে, সবাই সরকারি স্কুলে যেতে চায় না সেখানেও মান নেই, সঠিকভাবে পড়াশুনা হচ্ছে না। ফলে প্রস্তুতি ছাড়া, শিক্ষা সম্পর্কে ধারনা ছাড়া, শিশুশিক্ষা সম্পর্কে কোনো রকম পড়াশোনা না করেই একেকজন একেকটা স্কুল খুলে বসেছে। সেটা দিয়ে তো আসলে সঠিক শিক্ষাটা হবে না। এগুলো, মানে তাদের (শিশুদের) বয়সোচিত মান হওয়া উচিত, সেটার চেয়ে অনেক বেশি হচ্ছে। অবার তারা কেনো এ বয়সে এতো কিছু লিখতে হবে, জানতে হবে। ওরা তো ওদের মত করে শিখবে, কাজ হচ্ছে ওদের সেই সুযোগটা করে দেয়া।’
তিনি আরো বলেন, ‘যে কেউ ইচ্ছা হলেই একটা স্কুল খুলে বসেছে। তাদের কি প্রস্তুতি আছে, তাদের কি পড়াশুনা আছে। এটা দেখার কেউ নাই। ফলে স্কুলগুলোর মানে কোন সমতা থাকছে না। শ্রেণিগুলোতে কি ধরনের পড়াশুনা হওয়া উচিত তা সম্পর্কে কোথাও কোনো গাইড লাইন নাই।’
এ ধরনের শিক্ষায় শিশুদের কি উপকার হতে পারে? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘না, এগুলো ওদের মনে থাকবে না, এরা যুক্তিযুক্ত (লজিকাল) কিছু করছে না। এরা মুখস্ত করছে আর কি, ফাইনালে গিয়ে মুখস্তবিদ্যার দিকে যাচ্ছে। তাতে করে ওদের চিন্তা করার শক্তি, যুক্তি দিয়ে কথা বলার দক্ষতা এগুলো তৈরী হয় না। ক্ষতি হচ্ছে।’
এর থেকে উত্তরণের করণীয় বিষয়ে দীর্ঘ কাল ধরে শিশু শিক্ষা নিয়ে কাজ করা এই শিক্ষাবিদ বলেন, ‘সরকারের দিক থেকে কিছু করণীয় ছিলো আর কি। যদি আমরা মেনে নেই (অ্যালাও করি) যে এরকম প্রি-প্রাইমারী স্কুল হবে। তার প্রাথমিক, কিভাবে তাহলে সেগুলো, কোন বয়সে কি ধরণের পড়াশুনা করা উচিত এটার জন্য একটা দিক নির্দেশনা (গাইড লাইট) থাকা উচিত।’
আবুল মোমেন আরো বলেন, ‘আর একটা হচ্ছে, স্কুল প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রেও যারা করবে তাদের যোগ্যতারও একটা প্রমাণ দিতে হবে। যে কেউ ইচ্ছা করলেই একটা স্কুল দিয়ে দিলাম, এই প্রবণতা থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে। এ রকম মাদ্রসা দেওয়াও বন্ধ করতে হবে, এ রকম স্কুল দেওয়াও বন্ধ করতে হবে। কারণ প্রস্তুতি ছাড়া কিছু হয় না।’
এ বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. এ এফ এম মনজুর কাদির বাংলা’কে বলেন, ‘আমাদের সেই সক্ষমতা নেই এখন, যে চাইলেই আমরা তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো। আসলে আমরা যেটা দেখি, তারা আমাদের সিলেবাসের বই গুলো পড়াচ্ছে কি না বা স্বাধীনতার বিরোধী কিছু পড়াচ্ছে কি না।’
তিনি আরো বলেন, ‘আর কোনো বাবা-মা যদি চায় তাদের ছেলে-মেয়েকে সে সব স্কুলে পড়াবে সেটা তাদের ব্যাপার। এখানে আমাদের কিছু করার নেই। বাবা-মাকেই তার সন্তানের ভাল-মন্দটা বুঝতে হবে। এখন বাবা-মা যদি মনে করেন সন্তান বেশি বেশি জানলেই ভাল, তাহলে কি বলবেন? অভিভাবকদেরকেও এই বিষয়ে সচেতন হতে হবে, না হলে ক্ষতি হবে।’
এই কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমাদের কোনো সুযোগ নেই। তবে আমার চিন্তাভাবনা করছি কিভাবে বেসকারি বা কিন্ডারগার্টেন স্কুল গুলোর কারিকুলমা বা সিলেবাস নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সেটা নিয়ে কাজ করছি।’