• ০৪ অক্টোবর ২০১৯ ২২:৩৬:১৫
  • ০৪ অক্টোবর ২০১৯ ২২:৩৬:১৫
অন্যকে জানাতে পারেন: Facebook Twitter Google+ LinkedIn Save to Facebook প্রিন্ট করুন
বিজ্ঞাপন

বায়েজিদ বোস্তামী'র গল্প

ছবি : লেখক

ফেরার


‘চুতমারানির ব্যাটারা!' হাঁপাতে হাঁপাতে গালি দ্যায় বটে জুয়েল, কিন্তু সে গালি নিজের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না।

সন্ধ্যা ঘনিয়েছে অনেক আগেই। কৃষ্ণপক্ষ। গাঢ় অন্ধকার জমে আছে দুই ধারে সদ্য-শীষ আসা কোমর ছুঁইছুঁই ধানখেতে। সামান্য ভেজাভাব রয়ে যাওয়া নালাতেই টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে সে। না, আর ধরা পড়বার সম্ভাবনা নেই। এক দৌড়ে কিলোটাক চলে এসেছে। পেছনে তাড়া করে-আসা দলটার চিল্লাচিল্লি অন্তত আধা কিলো দূরে। জনা পনেরোর দল তো হবেই; আন্ডাবাচ্চা, জোয়ান-বুড়ো মিলে। ‘শালারা ডেইলি দিন এইদোন দল বান্ধি দাবাড় দিব্যার জোশ পায় ক্যামোন করি!' বিড়বিড় করতে থাকে জুয়েল। আপনমনেই। এবারে গলায় জোর আসে কিছুটা। নিরাপদ দূরত্বে চলে এসেছে বুঝতে পেরে।

দলটা আর এগোয়নি। শল্লার এই পাথার যাকে বলে নিধুয়া। লোকের বসত থেকে বেশ দূরে। এতো দূর অবধি আসবার সাহস হয়নি হল্লাপার্টির। এবার হেসে ফেলে সে। ‘মুরগির কইলজা নিয়া থাকিস। ফির খুনিয়াক দাবড়াইস। যা যা বাড়িত যায়া মায়ের কোলোত বসি থাকেক, মাউগের শ্যায়ার তলোত সন্দে থাকেক, শালারা মোর!'

দিনের বেলাটা আড়াজঙ্গল, বিল-পাথার, বন্ধ শ্যালোঘর ইত্যাদিতেই কাটছে গত দশ দিন। য্যানো মানুষ না সে, একটা বাঘডাঁশ কি বেজি! এছাড়া আর উপায় কি!

আজকের কথাই ধরা যাক। মাগরিবের আযান পড়লে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে শরাফত মিয়াজির বাঁশঝাড়ের আশ্রয় থেকে বের হয়ে হাঁটতে শুরু করেছিলো সে। সারাদিন পেটে কিছু পড়েনি। মায়ের আসার কথা বিউটিদের বাড়িতে। মা নিশ্চয়ই খাবার-টাবারও কিছু আনবে সাথে। খাবারের কথা মনে হতেই পেটের ভেতর য্যানো আগুন লেগে যায়। কপালগুণে বাঁশঝাড়ের পাশের ক্ষেতের কিনারে পেঁপেগাছের সারির গাছগুলোর পেঁপে একটা-দুটো কিছুটা পেকেছিলো। সেই আধাপাকা পেঁপেই ছিঁড়ে, দাঁতে খোসা চেঁছে, বিচিসমেতই বলা চলে, পেটে চালান করেছে। তার মেয়াদ আর কতোক্ষণ!

শরাফত মিয়াজির বাঁশঝাড়, খেত পেরিয়ে উঠোনে পৌঁছেছে কেবল, এরমধ্যেই নজরে পড়ে গেলো। কার? মিয়াজি বাড়ির বছর কামলা হবিবরের। এই ব্যাটার মাগরিবের ওয়াক্তেই গোয়ালঘরের কোনায় পাতা চৌকিতে শুয়ে নাক ডাকবার কথা। সেই প্রস্তুতিই চলছিলো নিশ্চয়ই। বাড়ির ভেতর থেকে পাকানো পোয়ালের বিঁড়ে নিয়ে আসছিলো। গোয়ালে ধোঁয়া দিয়ে মশারি ফেলবে। পুরুষেরা বাজারঘাটে। বাচ্চারা উচ্চস্বরে পড়া মুখস্থ করছে। বাড়ির বউয়েরা রান্নাঘরে। হবিবরের সাথে পারফেক্ট টাইমিংটাই গোল বাঁধালো।

‘কেটা?' জুয়েলকে উঠান পার হতে দেখে উঁচুস্বরেই হাঁক ছাড়ে হবিবর। মুশকিল হচ্ছে মিয়াজি বাড়িই পাড়ার শেষ বাড়ি। অর্থাৎ এই বাড়ির উঠান দিয়ে বাড়ির লোক ছাড়া অন্য কারও যাবার কথা নয় রাস্তার দিকে। ফলে একরকম অনিবার্য এই ডাক। জবাব দ্যায় না জুয়েল। বরং পেছায় খানিক। এবারে হবিবর ভড়কে যায়। এবং গলার স্বর আরেক প্রস্থ চড়ে তার —কেটা? কথা কন না ক্যা!'

জুয়েল দ্রুত পেছাতে পেছাতে উল্টোদিকে ঘুরে দৌড় দেওয়ার উপক্রম করতেই চেল্লাতে শুরু করে হবিবর।

‘জুয়েল! জুয়েল বারাইছে! কায় কোনটে আছেন, আইসো।'

ব্যস! আর দেখার অপেক্ষায় থাকে না জুয়েল। উঠানের সীমানা ছাড়াতে না ছাড়াতেই আশেপাশের বাড়ি থেকে জোয়ান-বুড়োর দলের ধুপধাপ পা ফেলে ছুটে আসার আওয়াজ কানে আসে।

জুয়েলকে সন্ধ্যা পার হলেই দেখতে পাওয়ার রব এ কয়েক দিনে সান্ধ্যবিনোদন হিশাবে দাঁড়িয়েছে গ্রামে। প্রতি সন্ধ্যাতেই গ্রামের কোনও না কোনও দিকে তাকে দ্যাখা যাবেই। ফলে, লোকেরাও সম্ভবত রেডিই থাকে। বের হতে খুব একটা সময় নেয় না।

খেত পার হওয়ার সময় তার আশেপাশে চার্জার টর্চের আলো পড়তে দ্যাখে। নিশ্চয়ই তাহের ব্যাপারির টর্চের আলো। ব্যাপারির মেজো ব্যাটা সিঙ্গাপুর থাকে। গতমাসে জুয়েলই তো বাজার থেকে এই টর্চ নিয়ে এসে দিয়েছিলো ব্যাপারিকে। পাশের গ্রামের মিন্টু সিঙ্গাপুর থেকে বয়ে এনেছে ব্যাপারির মেজোব্যাটার দেওয়া টর্চ। রাগেদুঃখে দৌড়াতে দৌড়াতেই কলাগাছের গোড়ার উঁচু ঢিবিতে লাথি কষায় জুয়েল।

গ্রামে হাঁস, মুরগি, কবুতর মুখে পলায়নরত বাঘডাঁশ কি শিয়াল দ্যাখা দিলে এরকমই লাঠিসোটা, হারিকেন-টর্চ হাতে তাড়া করে লোকে। দুই-একটা কুকুরও জুটে যায়। যেমন আজও জুটেছিলো কিছু। জুয়েল নিজেও এই দলে ছিলো কতোদিন। সেই উত্তেজনা, দৌড়, শিরায় ও ধমনীতে দ্রুত বহমান খুনের উচ্ছ্বাস ও খুনের বাসনা সব মনে পড়ে। আজকে নিজের পরিবর্তিত ভূমিকায় অসহায় আর ক্লান্ত বোধ করে সে। ধরা পড়বার হাত থেকে বেঁচে গিয়ে শুরুর যে তেজ এসেছিলো তা কমে আসে ক্রমে। নালায় শুয়ে অগণন তারার দিকে তাকিয়ে থাকে সে। একটা তারা খসে দক্ষিণে। নিজেকে খসে যাওয়া তারাটির মতোন দলছুট লাগে।

হ্যাঁ, সেও খুনী। খুন করেই ফেরার হয়েছে।

কতোইবা বয়স তার! নয়ে বাপ মরলো। তারপর টানা সাত বছর জমির সর্দারের বাড়িতে ফুটফরমাশ আর রাখালির কাজ।  মাথার ওপর ছাদ আর পেটে ভাত এই তো জুটতো সেখানে। ভর বছর কাজের বিনিময়ে যে টাকা পেতো তা দিয়ে দীর্ঘদিন রোগে ভুগে মরা বাপের বন্ধকী বাড়িভিটে ফেরাতে হয়তো এক জীবন কেটে যেতো। এরপর ঢাকার ডেমরায় রিকশা গ্যারেজে বছর ছয়েক মিস্তিরির সাগরেদি শেষে গ্রামে ফেরার দুই বছর। এই তো বয়সের হিসাব!

খুব সহসাই সর্দার বাড়ি ছাড়তো যে এমন সম্ভাবনা ছিলো না। বিধবা মা বাপের গ্রামে ফিরে দূর সম্পর্কের ভাই জমির সর্দারের বাড়িতে ওঠেন জুয়েলকে নিয়ে। মা লেগে যান ঝিয়ের কাজে, জুয়েল ফুটফরমাশ-রাখালিতে।

ষোলোর কিশোর জুয়েল এক ভোররাতে মায়ের থাকার ঘর তথা সর্দারদের রান্নাঘর থেকে জমির মামুর ছোটো ভাই ছমির মামুকে বের হতে দেখে সকালেই টাউনের দিকে রওনা দেয়। সন্ধ্যা নাগাদ ঢাকা। মায়ের বয়স, তাদের পতিত অবস্থা ইত্যাদি বাস্তবতার অংক মেলানোর মন তার ছিলো না। তারপর ঢাকার এদিক-সেদিক ঘুরতে ঘুরতে ডেমরার গ্যারাজে রিকশামিস্তিরির সাগরেদি জুটে যায়।

তো, কামকাজ মন্দ শেখেনি সে।

গ্রামে ফিরে রিকশা-ভ্যানেরই ছোটোখাটো একটা গ্যারেজে মিস্তিরি হিসাবে ঢোকে। গ্যারেজ মালিক বাতেনের ব্যবসায়ে মূলধন-সংকটে আধাআধি বখরার একটা পার্টনারশিপেও যায় সে। অটোরিকশা-ভ্যানের পার্টস-ব্যাটারি কিনে এনে নিজেরাই সাজিয়ে বেচে, গ্যারেজ থেকেই কিংবা আশেপাশের হাটে নিয়ে গিয়ে। মাসে দশটা রিকশা-ভ্যান বেচতে পারলেও আয়রোজগার খুব একটা খারাপ না।

মুশকিল হলো অন্য জায়গায়। বছর-ছয় মাস যেতে না যেতেই সে আবিষ্কার করে যে তার পার্টনার বাতেন কেবল নয়া রিকশা-ভ্যানেরই কারবারি না। অন্য কারবারও আছে। রাত-বিরেতে রিকশা-ভ্যান নিয়ে আসে অচেনা লোকেরা। দরদাম হয়। লেনদেন হয়। রাতেই পার্টস আলাদা করা হয়। সেইসব রিকশা-ভ্যান ভ্যানিশড হয়ে পার্টস আকারে জমা থাকে। শুরুতে মানতে একটু কষ্ট হয়। ঢাকায়ও এসব দেখেছে সে। কিন্তু নিজের ব্যবসায় অন্তত সৎ থাকতে চেয়েছে। আধাযুগের উপার্জনের সঞ্চয় সিংহভাগ এই ব্যবসায়ে ঢালার পর পেছনোর সাহস করে উঠতে পারে না। ঝামেলা নাই তেমন। থানার সাথে বন্দোবস্ত আছে। মাসোহারা দিলেই চলে।

ইদানিং বাপের বন্ধকী বাড়িভিটে ছাড়িয়ে নিয়ে মাকে সমেতই থাকে সে। নিজ বাড়িতে। মায়ের সেই অপরাধ আর মনে রাখেনি। নিজেদের বাড়িতে হাঁস-মুরগি-ছাগল-গরু-লাউ-শিম-আম-কাঁঠাল আর বন্ধকী চাষের জমির ধানে ভালো ঘর-গেরস্তি এখন তাদের। কাঁচা পয়সাও মন্দ আসে না। যথারীতি বিয়ের জোর সম্ভাবনাও দ্যাখা দিয়েছে। কথাবার্তা একরকম ঠিকঠাক হয়েই আছে। একই গ্রামের মেয়ে বিউটি। নিজে প্রাইমারি ইশকুলের পাট চুকাতে না-পারলেও সম্ভাব্য পাত্রী বিউটি এসএসসি পাশ দিয়েছে। দূরের কলেজে ভর্তি করানোর হ্যাপায় যায়নি বিউটির বাপ। ‘বেটি মানুষ ইশকুল পাশ দিছে তাই ম্যালা। এতো পড়াশুনা দিয়া কী হইবে। সেই তো শ্বশুরবাড়ি যায়া হাঁড়ি ঠ্যালা নাগবেই!'—বিউটির বাপের দোহাই এই। তিনটি কন্যা আর দুই পুত্র, বুড়ো মা নিয়ে ছয়জনের সংসার টানা মুদি-দোকানির থেকে এর বেশি আশা করাও অবশ্য ঠিক হয় না। বিউটিই বড়ো সন্তান। তাকে কলেজে দিলে বাকিদের ইশকুলও হয় না। জুয়েলের দিকে নজর রাখছেন আব্দুল মজিদ। থিতু হয় কিনা দেখছেন। ঢাকা-ফেরত পাখির সাথে হুটহাট মেয়ের বিয়ে দিয়ে ফ্যাসাদে পড়তে চান না। হিসেবী মানুষ!

ফলে, এখন বছর দুই-তিন অপেক্ষা শুধু! বিউটির বাপের পরীক্ষায় পাশ সে করবে নিশ্চয়ই। বিউটির পরীক্ষায় অবশ্য পাশ-ফেলের কিছু বোঝে না সে। ‘তা নারীর মনের মতিগতি কি এ্যাতো সহজে বোজা যায়!' এই ভেবে সান্ত্বনা দ্যায় নিজেকে জুয়েল। বিউটির পাল্লা যে তার দিকে হেলে আছে সেটা বোঝে না, এমন বলদ তো আর নয়, তা সে যতোই ফোর পাশ হোক!

ব্যবসাটা আরেকটু বাড়লেই নিশ্চয়ই এসব আর করবে না, এরকমই ভাবনা তার। মাঝপথে ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে, পুঁজি হারিয়ে পথে বসতে চায় না সে। টাকার যে সুসার, সে রাস্তাটা হঠাৎ বন্ধ করে দিয়ে সুখী জীবনের ছবিটাতে কালি ঢেলে দিতে ভয় করে তার!

রাত বেশ গভীর হয়েছে এরমধ্যে। তারাদের ফাঁকে একটা ক্ষয়া চাঁদ উঠে এগিয়েছে খানিক। চৈত্রমাসের শেষ প্রায়। ঝড়বাদলের সম্ভাবনা নেই দেখে খুশিই হয় জুয়েল। খিদেটা আবার চাগিয়ে উঠেছে। কয়টা বাজলো! সিমফোনি অ্যান্ড্রয়েড সেট একটা কিনেছিলো মাস কয়েক হলো। সময় দ্যাখার কাজও ফোনেই চলতো। গান শোনো, ছবি তোলো ইচ্ছা মতোন। বিউটির সাথে দ্যাখা হলে প্রত্যেকবারই আপত্তি সত্ত্বেও ছবি নিয়েছে সে। শুরুতে গাইগুঁই করলেও, রঙঢঙ কম করে না বিউটি ছবি নেবার সময়। বিউটির ছবি সমেত সাধের অ্যান্ড্রয়েড ফোনটা কই এখন!

বানিয়ারহাট থেকে ফিরছিলো তারা। চাইনিজ অটোরিকশায়। বাতেন এবং সে। দুইখানা রিকশা দুইজনে চালিয়ে নিয়ে গেছিলো যাওয়ার সময়। দাম ভালো পায়নি। চালানই ওঠেনি বলতে গেলে। হেল্পার সমেত তিনজনের দিন চারেকের কামলার দাম পাবে না একদমই। লাভ দূরস্থান! গত এক সপ্তাহে কারবারও হয়নি। ভোটের মওসুম। পুলিশের চাপ আছে। সতর্কই থেকেছে তারা।

হাটশেষে কিছু সদাইপাতি করতে-মিলতে, চা-সিগারেট খেতে খেতে দশটা বাজলো। মোড় পর্যন্ত এসে চলতি অটো বা ভ্যান কিছু মিললো না। অযথা আধাঘন্টাটাক অপেক্ষা করলে রাত বাড়ে খালি। এই একটা অটোই রাজি হলো আসতে। রিজার্ভ নিতে হলো। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। আরও দুশো টাকা গচ্চা!

বানিয়ার হাট ছাড়ার পর মির্জাপুরের কাছে কিলোখানেক জায়গা ফাঁকা। আশেপাশের পাথারে সবজির আবাদ। পটল, ঢ্যাঁড়স, ঝিঙা, চিচিঙ্গার খেতের পর খেত। ভিটেলি জমি এদিকের। কেবল ধানচাষের পেছনে পড়ে থাকে না এদিকের লোকেরা। ধানে আর কয় পয়সা আসে! সবজি চাষে খরচ যেমন লাভও তেমন।

‘ভাই, এ্যাকনা থামাওরে। মুতিম।' বাতেন বলে ওঠে হঠাৎ-ই।

‘তোমার ফির এ্যাটে আসি মুতে ধরিল। মুতি উঠপ্যার পান নাই হাট থাকি।' বিরক্তি ঝরে অটোওয়ালার স্বরে। ভীতিও কি কিছুটা! সাজোয়ান চেহারা। বয়স জুয়েলের কাছাকাছিই হবে। গলাটা বসে গেছে ছোকরার। সারাদিন যাত্রী ডাকাডাকির খেসারত নিশ্চয়ই!

বাতেন কিছু বলে না। অটো স্লো হতেই নেমে পড়ে। জুয়েল এই অবসরে একটা সিগারেট ধরায়। ‘আইজ আর বিউটিক জাগনা পাওয়া যাবার নয়। যাইতে যাইতে তো বারোটা পার হয়া যাইবে। ততোক্ষণে নিন যাইবে বিউটি' ভাবতে থাকে। একজোড়া বাঙ্গি কিনেছে। রাতেই, একটু ঘুরপথ হলেও, একটা দিয়ে যেতো বিউটিদের বাড়িতে। তা আর হচ্ছে না।

সিগারেট অর্ধেকটা টেনে অটোওয়ালার দিকে বাড়ায় জুয়েল, ‘নে, ভাই। টানেক।' অটোওয়ালা নিঃশব্দে সিগারেট নেয়। টানতে থাকে। খুশি হয় না। মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে মোতামুতি বা সিগারেট টানা কোনওটাই পছন্দের কাজ না তার। বিশেষত রাত এগারোটা পার হয়ে গেছে যখন। আর জায়গাটাও ফাঁকা। নানান অঘটন ঘটে আকছার। গত মাসেই তো একজনের অটো ছিনতাই হলো। এইখানেই। তারপর ভোটের মওসুম। কী ঘটে না ঘটে, দিকদিশা আছে নাকি!

বাতেন ফিরে আসে। দুজনেই ঘাড় ঘুরিয়ে দ্যাখে। কিন্তু এতো আস্তে হাঁটছে ক্যানো।

‘তাড়াতাড়ি আইসো। রাইত ম্যালা হইছে! ঘাটাখান আবার ফিরা নাগবে মোক।' বসে যাওয়া গলায় তাড়া দ্যায় অটোওয়ালা।

বাতেন অটোর দিকে আসে। ধীরেসুস্থেই। যাত্রীসীটের দিকে না এসে সামনে যাচ্ছে ক্যানো! ড্রাইভার তার সিটেই। আচমকা ড্রাইভারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বাতেন।

‘কী করিস, কী করিস! এ বাতেন!' জুয়েল এগিয়ে যায়।

ততোক্ষণে অটোওয়ালা, বাতেন দুইজনই গড়াগড়ি খাচ্ছে ডানদিকের ধুলায়। হেঁচড়েপাচড়ে ওঠে বাতেন। তার হাতে ছুরি। অটোওয়ালাও উঠে পড়েছে। বাতেনের হাত মুচড়ে দ্যায়। ছুরি খসে পড়ে।

জুয়েল কাকে ধরবে স্থির করতে পারে না। বরং ছুরিটা সরাতে নেয়। এবার অটোওয়ালা বাতেনকে ছেড়ে তার দিকে এগোয়। একটা ঘুঁষি চালায় ডান কান বরাবর। ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে মাথাটা। হাতের মুঠিতে তখনো ছুরিটা। টাল খেতে গিয়ে সামলে নেয় নিজেকে জুয়েল। বুক পকেট থেকে ফোন পড়ে যায়। ততোক্ষণে বাতেন জাপটে ধরেছে অটোওয়ালাকে। কী ভেবে ছোট্টো, ধারালো ছুরিটা অটোওয়ালার বুক বরাবর বসিয়ে দ্যায় জুয়েল।

সে-রাতে আর বাড়ি ফেরে না ওরা। মাইল দশেক হেঁটে গিয়ে বিনোদপুরে বাতেনের ছোটো ভায়রার বাড়ি যখন পৌঁছায় তখন ভোর প্রায়। এরকম একটা ঘটনার পরেও ঘুম পায় ওদের। বেলা পর্যন্ত ঘুমায়। ঘুম থেকে উঠে গোসল সারে। খায়। এরইমধ্যে ঘটনাটা জানিয়েও রাখে ভায়রাকে। দিন দুই বিনোদপুরেই কাটে। তৃতীয় দিনে লোকমুখে অই রাতের ঘটনার পল্লবিত বিবরণ বিনোদপুরের বাজারে শুনে বিনোদপুর ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয় বাতেন। ঝুঁকি সত্ত্বেও বাড়ি ফেরে সে। তার ধারণা ছিলো তাদেরকে ট্রেস করতে পারবে না কেউ। সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হয় বাড়িতে থাকবার পয়লা রাতেই যখন তাকে অ্যারেস্ট করে পুলিশ।

জুয়েল শুরু থেকেই গা ঢাকা দিয়ে থাকায় অ্যারেস্ট এড়াতে পারে। এবং তারপরই শুরু হয় এই গ্রামের লোকেদের সান্ধ্যবিনোদন।

এরকম লাস্ট ঘটেছিলো দুই যুগেরও বেশি সময় আগে। সেবার হুজুগ ওঠে 'থ্যালথ্যালা' দেখতে পাবার। সে এক অদ্ভুত ভয়, উত্তেজনা আর গল্পের সময় গেছে বটে আশেপাশের গ্রামগুলোতে। প্রতিরাতেই কোথাও না কোথাও সেই অদ্ভুত প্রাণী কিংবা ভূত আবির্ভূত হওয়ার কথা শোনা যায়। তার শরীর থলথলে, নরোম। নোখেরও অস্তিত্বের কথা প্রচারিত হতে থাকে, প্রমাণ হিসাবে কেউ কেউ, বিশেষত নারীরা, নোখের আঁচড়ের নমুনাও হাজির করেন এরকমও শোনা যায়। আরও নানাবিধ গালগল্প ছড়িয়ে পড়ে। পাড়ায়-পাড়ায় ভীত, উদ্বিগ্ন, কৌতূহলী, কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকেরা 'থ্যালথ্যালা'র সন্ধানে নামে প্রতি সন্ধ্যায়। দলবেঁধে ছুটে যায় যেদিকে 'থ্যালথ্যালা' রব ওঠে। কোথাও পায় না। আসলে কখনোই পাওয়া যায় না তাকে। এই গল্পের রেশ অবশ্য বেশ কয়েক বছর থেকে যায়। লোকমুখে ঘোরে। জুয়েলও সেই গল্প শুনে বড়ো হয়েছে। ধানখেতের আইলে শুয়ে জুয়েল অনুভব করে নিজের থ্যালথ্যালা হয়ে ওঠাকে!

গ্রামে ঢুকে প্রথম রাতে সে বিউটির সাথে দ্যাখা করার চেষ্টা করে। স্বাভাবিকভাবেই। যথারীতি বিউটির জানালায় গিয়ে সংকেত দ্যায়। বিউটি বাড়ির পেছনে চলে আসে। ঘটনাটা তাকে যথাসম্ভব বুঝিয়ে বলে জুয়েল। কিন্তু বিউটি বার বার এক কথাই বলে, ‘তোরা একটা জ্যাঁতা মানুষক খুন করনেন!' এই কথার জবাব দিতে পারে না জুয়েল। বিউটি বাড়ির ভেতরে চলে যায়। ফিরে আসবার সময় সে শুনতে পায় মা-মেয়েতে চাপা গলায় তর্ক চলছে। একজন খুনিকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেননি বিউটির মা-ও।

দ্বিতীয় রাতে আবার বিউটির জানালায় টোকা দ্যায় জুয়েল। অন্তত বিউটির কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা হারালে চলবে না! আজ অভিসারিকার হাত ধরে ফেলে জুয়েল। ‘মুই পুলিশের কাছে ধরা দিয়া জেলত পইচবার চাও না, বিউটি। পলামো হামরা। য্যাটে কেউ চিনবার নয়, স্যাটে যায়া থাকমো।' মরীয়া শোনায় জুয়েলের স্বর।

নিঃশব্দে চোখের পানি মোছে বিউটি। নিকটে কোথাও প্যাঁচা ডাকে গম্ভীর স্বরে। বাদুড়ের চেঁচামেচি শোনা যায়।

‘কাইল আবার আসিম। মাওক খবর দেইস এ্যাকনা। এডি হয়া নে। পরশু-ই এলাকা ছাড়মো।' ঘরের দিকে এগোতে এগোতে শোনে বিউটি।

পরদিন সকালে ধানখেত দেখতে এসেছিলো সেকেন্দার মিয়া। সে-ই আবিষ্কার করে কর্দমাক্ত  নালায় নিদ্রারত জুয়েলকে। চৈত্র সকালের সূর্যের দাপট তার ঘুমে একটুও ব্যাঘাত ঘটাতে পারছে না।

শেষরাতের আকস্মিক ঝড়বৃষ্টির সাথে আসা বজ্র ফেরার জুয়েলকে জেল কিংবা জনতার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। চিরতরে।

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
Page rendered in: 0.1562 seconds.