ছবি : সংগৃহীত
অদৃশ্য সুতোর টান
‘এই সময়ের বুকে ক্ষত জমে আছে/ শহরের বুকে ক্ষত জমে আছে/ কিছু দেখি, কিছু দেখতে পাই না...’ মৌসুমী ভৌমিকের একটি গান। গানটি শুনলেই আমি কেমন যেন হয়ে যাই আর একটু পর পর বুকের ভেতর থেকে গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। সকাল থেকেই গানটা শুনছি। আজ শুক্রবার, অফিস নেই। মাঝে মাঝে ছেলেমানুষের মতো মনে হয়, প্রতিদিন কেন শুক্রবার নয়? ঘরে থাকতে যে ভালো লাগে তা-ও নয়, ঘরে যে-সময়টা আমি থাকি বা থাকতে হয় তার বেশির ভাগ সময়ই ঘুমোতে যাওয়ার সময়, আমি ঘুমিয়ে থাকি; যখন জেগে থাকি, যতটুকু সময়, ঠিক বুঝতে পারি না, তখন আমার কেমন যেন লাগে! এই অসুখের নাম কি আমি জানি না!
কেন আমার কেমন যেন লাগে, যার কোনো মাথামুণ্ডু নেই। এই অসুখ কি জগতে আমার একার? আর কেউ জর্জরিত নয় এই জটিল যন্ত্রনায়? এক এক সময় ইচ্ছে হয় নিজেকে একটা আছাড় মারি কিংবা নিক্ষেপ করি অসহনীয় নরক-যন্ত্রণায়। ভাবি, এমন একটা ক্যাপসুল পাওয়া যেত যেটা এক ঢোক পানির সাথে খেয়ে নিতাম আর নিমিষেই সেরে যেত সমস্ত যন্ত্রণা। এই যে কেমন যেন লাগে, কেনো এমন হয়? নিজের জন্য প্রায়ই শোক হয়, কখনো-বা করুণা। করুণার পাত্র আমি? না শোকের? শোক তো মৃত মানুষের জন্য, এ-ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ যে, মরে যাইনি, আর করুণার পাত্র হওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না; এ আমার ভাবালুতা ছাড়া আর কিছুই নয়। অসহনীয় বিতৃষ্ণায় এ-রকম অনেক ভাবনা উড়িয়ে দিলেও একটা ভাবনা প্রতিমুহূর্তে আমাকে খোঁচা মারে; আমার মেজ মামা খুবই অপমানজনক ও নির্মম একটা কথা বলতেন আমাকে, চোখেমুখে তাচ্ছিল্যের ভাব ফুটিয়ে তুলে বলতেন যে, এই পৃথিবীতে বাস করার যোগ্যতা আমার নেই, আমার আত্মহত্যা করা উচিৎ। অনেক ভেবেও এ-কথার মানে আজো আমি খুঁজে পাইনি। অথচ এই মামাই আমাকে খুব পছন্দ করতেন, সম্ভবত এখনো করেন; তিনি মনে করেন আমি খুব ভালো মানুষ, আমারো তাই মনে হয়। কিন্তু তাঁর ‘মনে হওয়াকে’ সব সময় আমি সন্দেহের চোখে দেখে আসছি।
মামার কথা মনে এলেই তার দেখান একটা খেলা এবং খেলাটা খেলতে না পারায় আমার চেহারায় ফুটে ওঠা চরম অসহায়ত্ব দেখতে পাই। মামা একটা খেলা দেখাতেন আমাদের, যার নাম ছিল-তিনি বলতেন নয়ছয় রঙের খেলা। আর এমন ভাব ধরতেন যে, সারা দুনিয়া যেন তাঁর হাতের মুঠোয়। আমার এখনো মনে আছে, আমরা অনেকেই, ছোট ছোট এবং বড় বাচ্চারা তাঁর পেছনে পেছনে ঘুরতাম, খেলাটা শিখে নেয়ার জন্য। কিন্তু মামা কিছুতেই শেখাতেন না, বলতেন যে, এই খেলা কেউ কাউকে শেখাতে পারে না। বিস্ময়জাগা চোখে আমরা দেখতাম, ইংলিশ হরফে একটা নয় বা ছয়, সম্ভবত কাঠ দিয়ে বানানো ছিল; চোখ বুঝে মন্তর পড়ে সেই নয় বা ছয়ের উপর ফুঁ দিয়ে কেমন করে যেন নয়কে ছয় এবং ছয়কে নয় বানিয়ে ফেলতেন। এখন বুঝতে পারি, খেলাটা কত সহজ ছিল। নয় বা ছয়ের নিচের দিকটা উপরের দিকে ধরলে একরকম দেখাত-ছয় বা নয়ের মতো; আবার উপরের দিকটা নিচের দিকে ধরলে দেখাত নয় বা ছয়ের মতো। খেলাটা আমি বুঝলাম, কিন্তু বড় অসময়ে এসে। অসময় কি আসলে বলা যায়? হয়তো বলা যায়, হয়তো বলা যায় না। যেকোনো বয়সইে হয়তো এ-খেলা খেলা যায়; হয়তো আমিই ভাবছি যে, আমার বয়স হয়ে গেছে, এ-খেলার বয়স আমি অনেক আগেই পার হয়ে এসেছি। হয়তো এসব না ভাবলেও চলে, খেললেই হয়; কিন্তু এখন যে আমার মন সায় দেয় না।
গান বেজে চলছে। আমার মনের চোখে একটা ইঁদুরের গর্ত। একদিন স্বপ্নে দেখি ইঁদুরের গর্তে ঢুকে ঘাপটি মেরে বড় অসহায় ও অপরাধীর মতো আমি বসে আছি। নিজেকে নিয়ে এমন অদ্ভূত ও বিভৎস দৃশ্য, অথচ সেই থেকে আমার মন একটা ইঁদুরের গর্ত খুঁজে বেড়ায়; আমার সমস্ত মন ও ভাবনা জুড়ে ইঁদুরের গর্ত। কিন্তু শহরে ইঁদুরের গর্ত হয়তো সেই পাগলটাকে খুঁজে বেড়ানোর মতোই, যা কোনোদিন পাওয়া যাবে না। সেই পাগলটাও কি ইঁদুরের গর্ত খুঁজে বেড়াত? খুঁজে খুঁজে হয়রান হতো? যেখানেই সে আগাছা দেখত, স্কুলে যাওয়া-আসার সময় আমরা দেখতাম, আগাছা উপড়ে ফেলতে ফেলতে কী যেন খুঁজতো আর বিড়বিড় করে বলত, জঞ্জালে ভরে গেছে দেশটা।
এটা ঠিক যে অনেক কিছু ভাবা যায়, আকাশ-কুসুম অনেক স্বপ্নও দেখা যায়; তবে আমি মোটেই রসিকতা করছি না; অপরের সঙ্গে রসিকতার চেয়ে নিজের সঙ্গে রসিকতা করা বেশ কঠিন ও নির্মম। কিংবা কেবল ভাবনার ভেলায় ভেসে বেড়ানো নয়, মন থেকেই বলছি। কিছুক্ষণ পরেই হয়তো আমার স্ত্রী এসে জানতে চাইবে আজ আমার প্রোগ্রাম কী? যদিও সে জানে অফিসের বাইরে আমার কোনো প্রোগ্রাম থাকে না, আর কথাটা বলেই সে আমার উত্তর দেয়ার সময় না দিয়েই বলবে, শুক্রবার আমার কী কী করা উচিৎ এবং তার মতে আমি যে পারিবারিক দায়িত্ব-সচেতন নই সে-কথা স্মরণ করিয়ে দেবে; ছেলেমেয়েরা হয়তো এসেই বলবে আজ ওরা কোথায় যেতে চায়, আমাকে ছাড়াই যে ওরা ওদের মাকে নিয়ে শিল্পকলা, বসুন্ধরা বা স্টার কাবাবে যেতে পারে তা ওদের মায়ের মতো ওরাও বুঝতে চাইবে না।
কিছুক্ষণের জন্যও একা থেকেও একা থাকতে আমি পারি না; গানটি একসময় পরিবর্তন করতে হল, না হয় আমার স্ত্রী এসে আমার মুখের দিকে এমনভাবে তাকাবে যে, আমার সুস্থতা নিয়ে তার আশঙ্কা ফুটে উঠবে সেই চাহনিতে। চাইলেই একই সময়ে গানটি আমি বারবার শুনতে পারি না। চাইলেই হয়তো যেকোনো কিছু করা যায় না, সবকিছু হয়তো মানানসই এর একটা ব্যাপার আছে। একবার আমি বৃষ্টিতে ভেজার কথা বললে, দেখি ছোট মেয়েটা লাফিয়ে ওঠে, কিন্তু ওর মায়ের এক ধমক খেয়ে চুপসে যায়। বৃষ্টিতে ভিজলে ওদের জ্বর হবে এই কথাটাও আমি বুঝতে পারি না ভেবে সে অবাক হয় এবং মেয়েটাকে আমার কাছ থেকে একরকম ছিনিয়ে নেয়ার মতো করে ধরে নিয়ে ওর পড়ার টেবিলে বসিয়ে দেয়। আর আমি যে ছুটির দিনে ওদের পড়ার টেবিলে একটু বসতে পারি, যেতে যেতে এই সুযোগে তা-ই নিয়ে অভিযোগ করে যায়। রুম থেকে ওরা চলে গেলে আমি একাই ছাদে উঠি, কিছুক্ষণ পরে দেখি আমার স্ত্রীকে, দেখে কিছুটা অপরাধবোধ হয় আমার; বলি যে, স্যরি, তোমাকে ডাকা হয় নি, আমি ভাবছিলাম তুমি আসবে না। তখন সে বলল, তোমার কি একটু বুদ্ধিসুদ্ধি হবে না? তোমাকে নিয়ে আমি আর পারি না! এই বয়সে কেউ বৃষ্টিতে ভেজে?
এক শুভদিন দেখে পারিবারিকভাবে আমাদের বিয়ে হয়। এর আগে তিন-চার বছর ধরে পরস্পরের জানাশোনা। সে-সময়টা ছিল একেবারেই অন্যরকম, আমাদের আকাশে সব সময় রঙধনু ছিল, আমাদের জানালায় কোকিল ডেকে যেত বারমাস, বারমাস আমাদের বাগানে বসন্তের ফুল ফুটত, আমাদের চোখের আলো বসন্তের রঙে রঙিন ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে, সময়টা ছিল সম্ভবত ফার্স্ট ইয়ারের শেষের দিকে বা সেকেন্ড ইয়ারের প্রথম দিকে, ক্লাসমেট ছিলাম আমরা। আস্তে আস্তে যখন ঘনিষ্ঠতা হতে শুরু হয় আমাদের, তখন একদিন শহীদ হয়ে গেলাম ওর প্রেমে; যখন জানলাম যে, ছোট থাকতে ছায়ানটে ও রবীন্দ্র সংগীত শিখত। একসময়, তখন আমি গ্রামে, নাইনে কী টেনে পড়ি; আশপাশের আরো দু’চার জনের মতো তখন আমারও মনে হতো রবীন্দ্র সংগীত তো মানুষ শোনে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে, শুনলেই ঘুম পায়। রফিক ভাইর কাছে যখন প্রথম শুনি ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে/ তবে একলা চল রে/ তবে একলা চল একলা চল/ একলা চল রে...’ গানটি সেদিন আমার অন্তরেও বেজে ওঠে, আবার এ-ও মনে হচ্ছিল যে, রবীন্দ্র সংগীত শুনলে নিশ্চয়ই ঘুম পায়, এই একটি গানই ভালো। কিন্তু এরপর থেকে রবীন্দ্র সংগীতের অনুরাগী হয়ে উঠি এবং রফিক ভাইর সঙ্গে আমার খাতির হয়ে যায়। রফিক ভাই, আমাদের গ্রামের এক বড় ভাই, সে ছিল একটু অদ্ভুত ধরণের। তাকে আমরা পছন্দ না করলেও, পছন্দ করার ভাব দেখাতাম। কারণ, যখন সে বাড়িতে থাকত না, তখন আমরা প্রায়ই তার খোঁজে যেতাম এবং তার ছোট বোনকে দেখে আসতাম। বিষয়টা সম্ভবত অন্য কেউ বুঝতে পারেনি, কিন্তু যার উদ্দেশ্যে যেতাম, সেই পরীর মতো মেয়েটি, আমরা কোনোদিন পরী দেখিনি, কিন্তু আমাদের মনে হত মেয়েটি পরীর মতো সুন্দর, সে ঠিকই বুঝতে পারত। আমরা লক্ষ্য করতাম, মনে মনে সে হাসত এবং হাসিটি লুকাতে শত চেষ্টাতেও ব্যর্থ হত, না জানি তার স্বর্গীয় হাসিটি লুকানোর কোনো লক্ষণই দেখা যেত না।
জনশ্রুতি আছে, চোরের সাত দিন আর গৃহস্থের একদিন, সেই একদিন মেয়েটি বলে যে, ভাইয়া আছে। রফিক ভাই বাড়িতে নেই, এ কথা বলে যে আমাদের উৎসাহিত করেছে, আমরা ক্ষুদ্ধ ও অসহায় চোখে তার দিকে তাকাই। রফিক ভাই এসে আমাদেরকে ঘরের ভেতরে নিয়ে যায় এবং দেশ ও রাজনীতি নিয়ে নানা রকম গল্প জুড়ে দেয়, রাজনৈতিক দল ও নেতাদের বদনাম আর দেশের জন্য হাহাকার। আমাদের মনের অবস্থা ছিল পাগলের ফাঁদে আটকে পড়ার মতো। সেদিনই তার কাছে প্রথম রবীন্দ্র সংগীত শুনি। বিভিন্ন ধরনের গান সে শোনে, আগে থেকেই তা আমাদের জানা ছিল। যেমন পুরানো দিনের বাংলা গান, রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল সংগীত, কীর্তন। কীর্তন শোনার ফলে তার মাদ্রাসা-শিক্ষক বাবার গালাগালি আর আক্ষেপের শেষ নেই, গালাগালির ভাগিদার রফিক ভাইয়ের মাকেও হতে হয়; তবু সে কীর্তন শোনে।
কয়েকদিন আগে একদিন হয়েছে কী, আসলে প্রায়ই এরকম হয়, দুপুর বেলা একটু তন্দ্রার ভেতরে, বলা যায় জেগে থেকেই অদ্ভূত এক স্বপ্ন দেখি। অফিসে লাঞ্চের পরে আমি আমার চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুঝে ১০ মিনিটের জন্য রেস্ট নিচ্ছি; কোনো কোনো দিন একটু ঝিমুনি আসে এবং প্রচণ্ড ক্লান্তি আমাকে চেপে ধরে, কাজের চাপই হয়তো এর কারণ। তবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না সেদিন এমন কেন হলো, ঘুমে ঢুলে পড়তে পড়তে ভয়াবহ ও অদ্ভূত এক স্বপ্ন দেখি। আমাদের ঘরের পেছনে একটা ডোবা ছিল, কোমড়-সমান পানি, অনেক বছর হয় ভরাট করা হয়েছে; স্বপ্নে সেই ডোবার মাঝখানে গভীর পানিতে আমি তলিয়ে যাচ্ছি আর দু’হাত বাড়িয়ে বাঁচার জন্য লোকজনকে ডাকছি। কুলে অজস্র মানুষের ভীড়, তাদের কেউ আমার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। মনে হচ্ছে নিজেদের মধ্যে কী যেন বলাবলি করছে, কিছু একটা নিয়ে দর কষাকষি করছে যেন, আমার চিৎকার কারো মাথায় ঢুকছে না কিংবা আমার দিকে তাকানোর তাদের সময় নেই। আবার এরকম মনে হলো যে, না, আমাকে দেখছে, কিন্তু কেবল চোখ মেলে দেখে যাওয়া ছাড়া তাদের আর কিছুই করার নেই। আবার মনে হলো, এমনও হতে পারে, কেউ আমাকে মানুষ বলেই গণ্য করছে না, ভাবছে, তুমিও একটা মানুষ তেলাপোকাও একটা পাখি! কিন্তু স্রেফ একটা কীটও যদি ভাবে, আমার মন হিসেব কষে, তাহলেও তো তোলার কথা, এর জন্য তো সহৃদয় মানুষ হওয়ার প্রয়োজন নেই। তলিয়ে যেতে যেতে দু’হাত উপরে তুলে প্রতিবারই শেষ বারের মতো আমি কাউকে ডাকছি আর আরো তলিয়ে যেতে যেতে দেখছি যে, আমাকে তোলার কেউ নেই এই আমি ছাড়া। ভীড়ের কাউকেই আমি চিনতে পারি না, একবার মনে হয় সবাই আমার অনেক দিনের চেনা, ঐ তো আমার দুই বাল্যবন্ধু সুজন ও মানিক, পাশের বাড়ির আব্দুর রব চাচা, রফিক ভাই, মেজ মামাকেও দেখা যাচ্ছে, মিনু নামের সেই মেয়েটি... আরো অনেকেই। পরক্ষণে আবার কাউকে চিনতে পারি না, প্রত্যেকের চেহারা অদ্ভূত ও বিভৎস দেখায়। ভীড়ের মধ্যে আমি আমার মাকে খুঁজতে থাকি, কেন জানি মনে হয় যে, মা ছাড়া কেউ আমাকে তুলতে পারবে না, কারো সেই যোগ্যতা নেই।
এক একদিন গভীর রাতে আমার ঘুম ভেঙে যায়। অন্ধকার হাতড়িয়ে খুব সতর্কতার সাথে আস্তে আস্তে বিছানা ছেড়ে, আমার স্ত্রী যাতে জেগে না যায় এবং কেন এত রাতে জানালার ধারে দাঁড়ানোর শখ হলো এই কৈফিয়ত দিতে না হয়, পা টিপে টিপে আমি জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়াই, দাঁড়িয়ে মধ্য রাতের নিরব ও নিস্তব্ধ অন্ধকার দেখি, অন্ধকার দেখতে যেন আমার খুব ভালো লাগে। কিছুক্ষণ পর পর বাইরে থেকে হঠাৎ গাড়ির শব্দ ভেসে আসে আর পরক্ষণেই মিলিয়ে যায়। দেখতে পাই, নিস্তব্ধ অন্ধকার ভেদ করে কয়েকটি লাইটের আলো দ্রুত গতিতে একদিকে ছুঁটে গেল; সবকিছু ছেড়ে, সবকিছু ফেলে। আমার কেন জানি খুবই নিঃস্ব ও অসহায় বোধ হতে থাকে এবং এমনি করে আমারও একদিকে চলে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আমি জানি না, ঠিক বুঝে উঠতে পারি না যে, কোথায় যেতে ইচ্ছে করে? এই না জানা-বোঝার গোলকধাঁধায় একটা ইঁদুরের গর্তের চিত্র ভেসে উঠে মনের গভীরে; ভাবি, একটা ইঁদুরের গর্ত নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে, এ তো সোনার হরিণ নয়।
কোনো কোনোদিন রাত্রে তো ঘুমই হয় না, একটা ইঁদুরের গর্তে আটকে থাকে দু’চোখ কিংবা আমার দু’চোখের ভেতরে একটা ইঁদুরের গর্ত। একদিন ওকে খোঁচা দিই-বলি যে, এই জীবন লইয়া আমি কী করিব? আমার স্ত্রী ভাবে আমি বুঝি তার শাড়ি-গয়না, বাচ্চাদের বাংলা মিডিয়াম থেকে ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করানোর ফলে দ্বিগুণ খরচ, প্রতিমাসে ব্যাংকে লোন পরিশোধ করা (লোন নিয়ে কেনা ফ্লাটে আমরা আগামী মাসেই উঠব), এর মধ্যেই আবার এই লোন পরিশোধ হলেই আরেকটা লোন নিয়ে গাড়ি কেনার কথা বলছে সে এবং বাচ্চাদের দিয়ে বলিয়ে নিচ্ছে; এইসব ভেবে ভেবে আমি হয়রান হচ্ছি, অর্থাৎ এসব নিয়ে আমি ভাবছি-এই ভেবে আমার স্ত্রী মনে মনে খুশি হয় এবং খুব উদ্বিগ্ন হওয়ার ভাব দেখিয়ে অনেক ভালোবাসর কথা শোনায়। আমি ভাবছিলাম গ্রামে নিশ্চয়ই ইঁদুরের গর্ত আছে, ধানক্ষেতে অনেক ইঁদুরের গর্ত হয়, এছাড়াও অন্য কোথাও নিশ্চয়ই হয়। গ্রামে গেলে হতো, অনেক দিন গ্রামে যাওয়া হয় না, কত বছর হবে তা হিসেব করে বের না করলে বলা মুশকিল। মা-বাবা যখন ছিল তখন বছরে দুই ঈদে যেতাম, এখন গেলে সহজেই একটা ইঁদুরের গর্ত খুঁজে পাওয়া যেত। আমার বড় ভাই থাকে গ্রামে।
কখনো মনে হয় যে, ইদুরের গর্ত পেলেও কি আমার ভাবনা কোনোদিন বাস্তবে রূপান্তরিত হবে? ঘাপটি মেরে ইঁদুরের গর্তে আমি বসে থাকতে পারব? কিংবা শুয়ে বা এক কোণায় দাঁড়িয়ে? কাউকে না জানিয়ে এবং লোকচক্ষুর আড়ালে ইঁদুরের গর্তে ঢুকলেও কেউ কী আমাকে দেখতে পাবে না? কেউ আমার খোঁজ পাবে না? চাইলে খাঁটের নিচেও তো আমি থাকতে পারি না, তাহলে নিশ্চিত যে, আমাকে নিয়ে বাসায় হৈ চৈ পড়ে যাবে। খাঁটের নিচ থেকে আমি বের হতে না চাইলে এবং আমার স্ত্রী আমাকে বের করতে ব্যর্থ হলে, আমাদের সব আত্মীয়স্বজন ডেকে আনা হবে এবং আমাকে জোর করে বের করে এনে আমার দিকে সন্দেহ ও বিভ্রান্তিকর চোখে সবাই তাকাবে। আমার সব কথা তাদের কাছে খুবই অস্বাভাবিক মনে হবে, আমার কোনো কথাই তারা বুঝতে পারবে না এবং আমাকে নিয়ে পারিবারিক মিটিং বসবে আর মিটিংয়ে সর্বসম্মতভাবে এই সিদ্ধান্ত হবে যে, পাবনায় যাওয়ার আগেই আমাকে সাইকিয়াট্রি দেখনো দরকার। আমি সাইক্রিয়াট্রির কাছে যেতে না চাইলে সবার সন্দেহ আরো বেড়ে যাবে এবং জোর করে আমাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হবে।
মাঝে মাঝে ছেলেটাকে সাইকিয়াট্রি দেখানোর কথা ওঠে। ওকে নিয়ে ওর মায়ের উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার শেষ নেই, প্রায়ই তার মাথা খারাপ হয় অথবা নিজেই নিজের মাথা খারাপ করে, তারপর সে বাসার সবার মাথা খারাপ করে ফেলে। ঘুমের মধ্যে ছেলেটা হাত-পা ছুঁড়ে লাথি আর ঘুষি মারে, একদিন ওর মায়ের নাকেও একটা ঘুষি লাগে, মাথার বালিশ আর কোল বালিশ যে সকালে একটাও বিছানায় দেখা যায় না, মেঝেতে পড়ে থাকে, এ তো প্রতিদিনকার ব্যাপার, মাঝে মাঝে ও নিজেও খাট থেকে পড়ে ব্যথা পায়, রাতে বিড়বিড় করে কী সব বলেও। দিনের বেলায় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শূন্যে হাত-পা ছুঁড়ে লাথি আর ঘুষি মারে এবং মুখে অস্পষ্ট ‘ডিসুম ডুসুম’ শব্দ করে, অনেকটা কার্টুন ছবির মতো। আমার একবার মনে হল, আসলে প্রায়ই মনে হয়, ছেলেটাকে ডেকে বলি, কিন্তু বলতে গিয়েও বলা হয় না, কখনো বলা হয় না যে, স্বপ্নে ও কোনোদিন সরষেক্ষেত দেখেছে? সরষেক্ষেতের ভেতর দিয়ে কোনোদিন হেঁটে গিয়েছে? নদী দেখেছে? বিলের ধারে কাশবন দেখেছে? বিলে শাপলা ফুল ফুটে থাকতে দেখেছে? সাদা শাপলা? লাল শাপলা? স্কুলে যাওয়ার পথে শাপলা তুলতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছে? এসব কিছুই আমার বলা হয় না। ওর ক্রিকেট খেলায় অনেক আগ্রহ দেখে, একদিন ওকে ব্যাট ও বল কিনে দিতে চাইলাম; শুনে, আমার মাথায় ভূত চেপেছে বলে ওর মা জানাল যে, ও তো পিসিতে ক্রিকেট খেলে, এখন আবার ব্যাট বল কিনে দিয়ে ছেলেকে ক্রিকেটার বানাও, আর পড়াশুনা গোল্লায় যাক! পিসিতে ক্রিকেট কীভাবে খেলে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে আরো অনেক বিষয়ের মতো এটিও আমি চেপে যাই বা বলা হয় না।
নিজের ভেতরে অনেক কিছু চেপে রাখা, এটি আমার অভ্যাসে পরিণত বা গা সওয়া হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে মনে হয় কারো সঙ্গে কথাই বলব না, কিন্তু তা আর হয়ে ওঠে না বা হয় না। আমি আমার মতো থাকতে চাই, যদিও এই আমার মতো করে থাকাও কখনো হয় না, থাকা যায় না। না চাইলেও আমাকে কথা বলতে হয় এবং অনেকের সঙ্গে মিশতে হয়। সেই পাগলটা কি ঠিক তার মতো করে থাকতে পারত? ঠিক নিজের মতো করে কেউ থাকতে পারে? গানটি আমি আবার প্লে করে দিলাম, ‘এই সময়ের বুকে ক্ষত জমে আছে/ শহরের বুকে ক্ষত জমে আছে/ কিছু দেখি, কিছু দেখতে পাই না...’
সেই পাগলটা, আর দশজনের মতোই দেখতে, তবু কারো মতো নয়; আমাদের মতোই তার চোখ, তবু অন্যরকম যেন; আমাদের মতোই হাঁটা-চলা, তবু কেমন যেন তার হাঁটা-চলা। আমাদের চেনাজানা কারো সঙ্গেই তার মিল নেই, আবার আমাদেরই যেন অতি পরিচিত একজন মানুষ। আজও আমার চোখে সেই মুখটি ভেসে ওঠে আর হাহাকার করে ওঠে বুকের ভেতরটা। আমি তাকে খুঁজে ফিরি, যখন আমি আমার এই রুমের জানালার ধারে দাঁড়াই এবং আমি আমার ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে তার মুখ খুঁজে বেড়াই; যখন অফিস বা বাইরে কোথাও বের হই তখন খুঁজে বেড়াই বাসে যেতে যেতে, বাসের ভেতরে এবং জানালার বাইরে; যখন রিক্সায় উঠি, চারদিকে তাকিয়ে খুঁজতে থাকি তাকে; ফুটপাতে হাঁটার সময়ে পথিকের ভিড়ে খুঁজে বেড়াই।
রাত্রি কী দিবালোকে হাতে একটি জ্বলন্ত হারিকেন নিয়ে উদাস দৃষ্টিতে পাগলটা হাঁটত, আর ভাঙা ভাঙা গলায় চিৎকার করে বলত, আমি একজন সৎ মানুষ খুঁজছি, আমি একজন সৎ মানুষ খুঁজছি...। পাগল সম্প্রদায়কে আমরা যেমন জানি, সে ঠিক তেমন ছিল না; তাকে কখনো আমোদ-ফূর্তি করতে দেখা যেত না, আবার বদমেজাজী স্বভাবেরও ছিল না, শান্ত ও ধীরস্থির এবং সব সময় কেমন মনমরা চেহারায় দেখা যেত; কেউ কিছু বললেও বা খেপালেও তার কোন প্রতিকার দেখাত না, নির্বিকার চোখে তাকিয়ে থাকত কেবল। তার সম্পর্কে কেউ কিছুই জানত না, তবে এমন জনশ্রæতি প্রচলিত ছিল যে, পাগলটা ভাটির দেশ থেকে এসেছে।
দূরে কোন মানুষ আসতে দেখতে পেলে ঝুঁকে পরে হাতের হারিকেনটা উঁচু করে ধরত; যতক্ষণ না স্পষ্ট দেখা যায়, ততক্ষণ সে অত্যন্ত মনযোগের সঙ্গে দেখত; দেখত বললে সম্ভবত ভুল হবে, আসলে নিরীক্ষণ করত-কে আসছে? যেন লক্ষ বছর ধরে সে তারই প্রতিক্ষায় আছে, আর লক্ষ বছর ধরে বুকের ভেতর সযতেœ লালন করে আসা পরম সাধের স্বপ্ন পূরণ হতে চলছে আজ। কিন্তু সেই দূরের মানুষটি যতই কাছাকাছি আসত, দেখতে দেখতে ততই ম্লান হয়ে যেত তার চেহারা, চিরদিনের জন্য কোন আপনজন হরিয়ে ফেলার বেদনার একটা চাপা কষ্ট দেখা যেত চোখেমুখে; যা আমি তখন, সেই ছেলেবেলায়ও বুঝতে পারতাম।
হঠাৎ আমার বুক কেঁপে উঠে-এমন করে দরজা নক করার শব্দ, ওপাশে যেন আগুন লেগেছে। উঠে গিয়ে আমি দরজা খুললে, দেখি আমার স্ত্রী দাঁড়িয়ে। দরজা খুলতেই জ্বলে উঠে সে, ক্রোধ ভরা চোখে বলে, কতক্ষণ ধরে নক করছি! কী করছিলে! আর দরজা লক করে দেয়ার-বা কী দরকার? তুমি তো দেখছি দিন দিন মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছ! বলতে বলতে ভেতরে ঢুকে।
আমার মনে হল, কী লাভ কথা বাড়িয়ে! কথায় কথা বাড়ে। আমার ভালোলাগা মন্দলাগার ওপর তো আর জগৎ চলে না। আমি আবার ফিরে এলাম আমার জগতে। গানটি বেজে চলছে, ‘এই সময়ের বুকে ক্ষত জমে আছে/ শহরের বুকে ক্ষত জমে আছে/ তোমারও বুকে ক্ষত জমে আছে/ কিছু দেখি, কিছু দেখতে পাই না...’ আমার মনে হল, মাঝে মাঝেই এরকম মনে হয় যে, আমার বুকেও কি ক্ষত জমে আছে? সেই পাগলটার বুকে ক্ষত জমে ছিল? আমার স্ত্রীর বুকে? সবার বুকেই বুঝি ক্ষত জমে আছে, যে-কারো মুখের দিকে তাকালেই আমার তা-ই মনে হয়। আর মনে হয় যে, সবাই তাদের ক্ষত ঢাকার জন্য সারা জীবন অভিনয় করে যায়; যার ফলে কিছু ক্ষত দেখা যায়, আর কিছু দেখা যায় না, এবং অনেক ক্ষত আছে, যা আমরা চিনতে পারি না।