ছবি : প্রতীকী
সোয়াদুজ্জামান সোয়াদ :
আটচল্লিশ বছর বয়সি সোহান মিয়া হাসিমুখে বাজার থেকে ফিরছিল । ৫৪ টাকায় অনেক বড় একটা পাংগাস মাছ কিনতে পারায় খুশিতে ধেই ধেই করে নাছতে ইচ্ছা করছে। সোহান মিয়ার ছেলে রাসেল আসছে বহুদিন পর, ছেলেটা পাংগাস মাছের ভুনাতে অনেকগুলা ভাত খায়। পথিমধ্যে বড় রাস্তার পাশে যে মসজিদটা পরে সেখানে প্রচুর মানুষের ভীর দেখে সে থমকে যায়।
ভাবছিল বাজার শাধাই বাড়িতে দিয়ে তারপর মাগরিবের নামাজটা পড়তে মসজিদে আসবে। কিন্তু সেটা মনে হয় আর হয় না, ভিড় ঠেলে ভিতরে ঢুকল। ঢুকে দেখে খাদেম চেয়ারম্যান, রমিজ মেম্বার আর মওলানা সাহেব চেয়ারে বসে আছেন। আর কান্নাকাটি করে কি যেন বোঝাতে চাচ্ছেন রহমত হাজী। যে রহমত হাজী কারো কাছে কোনদিন হাত পাতে নি সেই হাজি সাহেব নাকি আজ কান্নাকাটি করছেন। পাশের একজন কে জিজ্ঞাসা করেন সোহান মিয়া,
কি হইছে বাজান?
আর কইয়েন না চাচা! রহমত হাজীর ছোট মাইয়্যাটারে দিনে দুপুরে ইজ্জত নষ্ট কইরা দিছে খাদেম চেয়ারম্যানের পোলায়।
ঠিক বুঝলাম না! কি কও বাজান?
খাদেম চেয়ারম্যানের পোলায় তো রাজনীতি করে। খুব দাপটে চলাফিরা করে । রহমত হাজীর ছোট মাইয়ারে না কি প্রেমের প্রস্তাব দিছিলো ! রাজি হয় নাই, তাই আইজক্যা স্কুল থেকে আসার সময় ধইরা নিয়া কাম সাইরা দিছে।
আহারে! আল্লাহ্ মাইয়্যাটা না অনেক ছোট বাজান। কি দোষ আছিলো মাইয়্যার! প্রেম পিরিতি না করছে তাই আল্লাহ্ তুমি মাইয়্যাডা রে সহ্য করার শক্তি দিও।
আরে কি যে কও চাচা! শক্তি? বাঁচবো কি না তাই সন্দেহ!
এই শুনেই ভীড় থেকে বের হয়ে অযু করলেন সোহান মিয়া দুই রাকাত নফল নামাজ পরে দোয়া করবেন মেয়েটার লাগি। সোহান মিয়া বলতে গেলে এখনও জুয়ান,ছোট বেলা হতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। গ্রামের সবার কাছেই প্রিয় মানুষ, অভাবে কারো কাছে হাত পাতেনি, কিন্তু বিপদে কাউকে ফিরিয়ে দেয়নি।
পরিবার বলতে আছে বউ আর এক ছেলে। ছেলেটা ঢাকা মেডিকেল এ পড়ে, পাঁচ বছর হল ভর্তী হয়েছে এবারে ডাক্তার হয়ে বের হবার কথা। বাপে মরছে যুদ্ধে তখন সোহান মিয়া মায়ের পেটে। সোহান জন্মের ৬ বছরের মাথায় মরল মা তারপর আর কি ছোট চাচার কাছে মানুষ। চাচার ছেলেমেয়ে না থাকায় ধানের পাইকারি ব্যাবসা টা এখন সোহান মিয়াই করেন।
মাগরিবের নামাজ শেষ। গ্রামের শীতের দিনে কেউ বেশিক্ষণ মসজিদে থাকতে চায় না।
মসজিদের ভেতরে এক কোণায় বসে জিকির করছিলেন সোহান মিয়া। হঠাৎ তিনি অস্ফুট স্বরে কান্নার আওয়াজ পেলেন। পিছনে ফিরে দেখে রহমত হাজী বসে আছেন।
"আল্লাহ তুমি আমার সাথে এমন কেন করলা? কি দোষ আছিলো আমার মাইয়াডার? ক্যান এমন হইলো? আল্লাহ ও যে মইরা যাবো। এই সমাজ যে ওরে বাঁচতে দিবো না। এত কষ্ট যে সহ্য হয় না আমার। আল্লাহ্ তুমি আমারে নিয়া নেও। কেন এত কষ্ট দিছো তুমি? ওই পোলায় যদি আমার মাইয়াডারে বিয়া না করে তাইলে আমার তো আর মরা ছাড়া উপায় থাকবো না। আল্লাহ কিছু একটা করো। আল্লাহ্!!
রহমত হাজী কাধে কারো স্পর্শ অনুভব করে। পিছনে তাকিয়ে দেখে সোহান মিয়া। দেখে আতকে উঠে সে। বুকের ভিতরে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।
আল্লাহর কাছে শক্তি চান হাজী সাহেব। আল্লাহ রে ডাকেন। সে ছাড়া আর কেউ আপনার কথা শুনবো না। আল্লাহ সব পারে।
সোহান মিয়ার কথা শুনে কিছুটা নড়েচড়ে বসলেন রহমত হাজী। মনে পড়ে হাজী সাহেব ৪২ বছর আগের কথা? আপনার জায়গায় ছিলাম আমি, আপনার মাইয়ার জায়গায় আমার মায়ে আর নরপিশাচের জায়গায় আপনি?
আপনার বাড়িতে কাজ করত আমার মায়ে। আমাকে বেধে রেখে চোখের সামনে কতই না অত্যচার করলেন মারে। চাচার বাড়িতে আইশ্যা দেখে ক্ষতবিক্ষত হয়ে মাটিতে পইরা আছে মা আর আমি বান্দা বিছানার খুটিটার সাথে। চাচা আমারে নিয়া দৌঁড়ায় গেছিলো আপনার কাছে ডাকছিলো আপনারে। দু-জনে হাতে পায়ে ধরছিলাম। আপনে কইলেন কামলার আবার ইজ্জত! থাকলেই কি নষ্ট হইলেই কি?
পরে চাচি ও আইশা হাতে পায়ে ধরল আপনে তাও বিয়া করলেন না। মানুষ জানাজানি হওয়ার আগেই মাকে নদী থাইক্যা পানি আইনা গোসল দেওয়াইল চাচী। সব মনে আছে হাজী সাব..সব। কি দোষ ছিলো?মা আপ্নার সাথে কুর্ম করতে রাজি হয় নাই সেই জন্যে? তিন দিনের দিন গলায় ফাঁস দিয়া মইরা গেল মা। আমি হইলাম ইতিম।
তারপর থেকেই আপনারে দেখলেই মনে হইতো আপনারে খুন কইরা ফালাই।গ্রামের নিরীহ মানুষ গুলারে ঠকাইয়া টাকা হইল আপনের। আর আফনে হইলেন ধর্ষক থেকে হাজী।
তারপর চোখ মুছতে মুছতে খরচের ব্যাগ হতে মসজিদ থেকে বেড়িয়ে এলো সোহান মিয়া। আর, নিজের এত দিনের পাপ মনে করে আরো জোড়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো রহমত হাজী। হয়তো সে আজ অনুতপ্ত।
সোহান মিয়া বাড়ির গেট খুলতেই বুকে জড়িয়ে ধরল ছেলে রাসেল। কিছুক্ষণ আগেই ঢাকা থেকে বাড়িতে ফিরেছে সে। ব্যাগ টা বউ রাহেলার দিকে এগিয়ে দিতেই রহমত হাজির বাড়ির দিক থেকে বিলাপ করা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসল। মেয়েটা মনে হয় ফাঁস দিলো। বাপের পাপে বলি হলো মেয়েটা। পাপ বাপকেও ছাড়ে না, ইহকালে পাপি মুক্তি পেলেও পরকালে পুরায় দুনিয়ার আগুনের চেয়ে ৮০ গুন তাপে।
লেখক : শিক্ষার্থী, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।