জাহিদ জগৎ। ছবি : কামরুন্নাহার শারমিন
জাহিদ জগৎ এর সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য আমি তার সাথে ফোনে ও ম্যাসেঞ্জারে যোগাযোগ করি। জাহিদ জগতের সাথে আগেই পরিচয় ছিল মূলত তার লেখালেখির মাধ্যমে; তিনি সময় দিতে রাজী হন। সেপ্টেম্বর মাসের কোনো এক দিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতর সন্ধ্যা নামার ঠিক আগে আগে আমরা বসে পড়ি মূলত আড্ডা দিতে। আমাদের এই আলাপটা আগে থেকে গোছানো বা কাঠামোবদ্ধ কোনো আলাপ ছিল না, আমরা মূলত একটা প্রাণবন্ত আড্ডা দিয়েছি। সেই আড্ডায় যা কিছু এসেছে, তারই লিখিত রূপ হচ্ছে এই সাক্ষাৎকারটি। ফলে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি এই আলাপটা যেভাবে হয়েছে, আলাপটাকে সেভাবেই তুলে আনতে! তাই প্রমিত ভাষার দিকে আমরা কেউই (মানে সাক্ষাৎকার গ্রহীতা ও লেখক কেউই) যেতে চাইনি। ফলে পুরো আলাপ জুড়ে আমরা যে উচ্চারণে বা যে ভঙ্গিতে কথা বলেছি, সেটারই ছোঁয়া খুঁজে পাওয়া যাবে। ইচ্ছে করেই অনেক বানান ঠিক করা হয় নাই, কেননা ওইটা আমরা ওইভাবেই আলাপ করেছি আড্ডা দেয়ার সময়। আমরা মোটামুটি ৪৫ মিনিট আড্ডা দিয়েছি। পুরোটাই তুলে দেয়া হয়েছে এখানে। আলাপটি প্রথমে লেখককে দেখানো হয়েছে, তার সম্মতিতে প্রকাশ করা হচ্ছে। যেহেতু এখানে লেখকের আলাপটাই গুরুত্বপূর্ণ, ফলে সাক্ষাৎকার গ্রহীতার নাম উল্লেখ করা হল না স্বাভাবিক কারণেই।
জাহিদ জগৎ এর সাথে আলাপ : চিন্তার কাজ ট্রেন্ডের মধ্যে হারায়া যাওয়া না : জাহিদ জগৎ
বাংলাঃ আপনার কাছে আমার প্রথম যেটা জানতে চাওয়ার বিষয় আরকি, সেটা হচ্ছে, লেখালেখিতে আসার ক্ষেত্রে আপনার প্রক্রিয়াটি কী? কেন লেখালেখিতে আসলেন?
জাহিদ জগৎঃ লেখালেখির যে জায়গাটা! সেটা ছাড়াও সবখানেই সাধারণত একখান খাড়া উত্তর চালু আছে যে, ছোটবেলা থেকেই তারা লিখতে বা সেই বিশেষ কর্ম করে আসতেছে, মানে যে কাউ'রে জিজ্ঞেস করলেই দেখবেন সে বলতেছে, “আমি ছোটবেলা থেকেই এই বিষয়ে বিরাট মাস্তান”। আমিও ওরকমই, লিখতেছি ছোটবেলা থেকেই। মানে! আসলে আমার তো ছোটবেলা নাই! চিন্তার জন্মক্ষণ থেকেই আমাকে লড়াই করে জিততে হয়েছে অভাবের মতো মহান শক্তির বিপরীতে। সামাজিকতাও কম কালারফুল না। এইসব ভাঙ্গনের মধ্য দিয়াই লেখতেছিলাম মনে অয়। কাগজে কলমে অতো বিশ্বাস তখন ছিলো না। এখনো নাই। আসলে, সাহিত্য টাহিত্য করবো এসব আমার মাথায় কোনো সময়ই ছিল না। নানা ভাঙচূড়, ভাঙ্গা-গড়ার ভেতর দিয়ে এসে যখন হচ্ছে যে আমি দেকলাম, মানে আমার সমস্ত পরাজয় নিয়ে, আমার সমস্ত ব্যর্থতা নিয়ে, যেই মানুষগুলোর সাথে আমার সবচেয়ে বেশি হৃদ্যতা হতো, সেই মানুষগুলোর জীবন যাপন! যাদের জন্য আমার মেলা কিছু করার কথা অথচ কিছুই না করতে পারার যেই ব্যর্থতা! যার ভেতর দিয়ে আমার নিজেরও বড় একটা জার্নি গেছে, এই অবস্থায় এই মানুষগুলোর কথা বা এই মানুষগুলোর সাথে আমার যা আলাপচারিতা, এই সব কিছু শুধুমাত্র নিজেরে বলতে যাইয়া শেষ পর্যন্ত মনে হল, এইটাই বোধহয় লেখালেখি। এর ভেতরেই সম্ভবত লেখার জায়গাটা তৈরি হইছে।
বাংলাঃ আচ্ছা, আপনাকে যতটুকু চিনি ব্যক্তিগতভাবে বা আপনার সম্পর্কে যা জানি আরকি, হ্যাঁ, তাতে যেটুক জানি যে আপনার জীবনটাই আসলে একটা মানে আপনার জীবনটাকেই আসলে কবিতা বলা যায় আরকি! বা একটা লেখা বলা যায়! ঠিক কোন পর্যায়ে এসে আপনার মনে হল যে আপনি যে কথাগুলো বলছেন, যে জীবনটা যাপন করছেন, যাদের ভেতর দিয়ে আপনি উঠছেন, বেড়ে উঠছেন, এটা প্রকাশ করা দরকার। বা প্রকাশের জায়গাটায় কখন আসলেন?
জাহিদ জগৎঃ আমার প্রথম প্রকাশনা তো ‘অন্নদাস’! এখন ‘অন্নদাস’টা! এটা ঠিক উপন্যাস কিনা বা অন্য কিছু বলে কিনা, এমন কোন ধারণা নিয়ে আমি লিখতে শুরু করি নাই। ঘরে ফিরে আমি যেইসব চরিত্রের ভেতর দিয়ে, (আমি মানে আমি) শেষ পর্যন্ত ঘরে ফিরতাম যখন! একটু বলে রাখি, সেই সময় আক্ষরিক অর্থে আমার কোন ঘর ছিলো না। উদ্যানে-পার্কে অথবা বস্তির কোনা-কাঞ্চি ছাড়াও দেশের নানা কোনায় যাচ্ছে-তাই কামলা খেটে দিন কাটাচ্ছিলাম। ঠিক সেই সময়েই, তাদের কথা লিখতে লিখতেই একটা সময় যেয়ে সেইটা আমার কাছে হয়ে উঠলো একটা ছবি, সিনেমা। এই সিনেমাটা খালি আমিই দেখতাম। দিনের পর দিন এই একটাই সিনেমা দেখতাম। যার শেষ আমি জানতাম না; ঠিক এই শেষ জানতাম না’র ভেতর দিয়েই আমার শেষটা জানার হাঁটাচলা শুরু অইলো, এই শেষটা জানতে ইচ্ছে করলো যখন, তখন হচ্ছে এর অবকাঠামোটা গোছানো হলো, গোছানোর পরে আমি বুঝলাম যে, এটা সম্ভবত কিছু একটা। শ্মশান ঠাকুরের সাথে যোগাযোগ ছিলো তখন প্রবল। সে প্রিন্টেড এই লেখাজোখা দেখে, মানে সেই প্রথম প্রকাশের চিন্তাটা মাথায় ঢুকিয়ে দিলো। তারপর হচ্ছে যে, আমি প্রকাশের দিকে গেলাম। সেটা ফর্মের মধ্যে নিয়ে এসে, উপন্যাসের এক ধরনের ধারণা আমার মধ্যে আছে, উপন্যাস কেমন হয়? তার প্রতিচ্ছবি দেখা যায় কিনা? গল্পের সবচেয়ে, গল্প না ঠিক উপন্যাসের, আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটা হচ্ছে এই যে, ও একটা ইমেজ ক্রিয়েট করতে পারে। আপনি...আপনি পড়া শেষ করার পরে দেখবেন যে, আপনার মাথার মধ্যে কতকগুলো ছবি প্লে করতেছে, এই ছবিগুলো আদৌ ক্রিয়েট করা যায় কিনা, যার ভেতর দিয়ে আসলে এই উপন্যাস দাঁড়ানো! তখন থেকেই আসলে প্রকাশের ইচ্ছা দাঁড়ায়া গেলো, এই ইমেজটা প্রকাশ করা যায় কিনা অথবা আমি ছাড়াও আর কারও দিয়ে দেখানো যায় কিনা।
বাংলাঃ তো আমরা নরমালি যেটা জানি যে, প্রচলিত সোসাইটি আমাদেরকে একটা জীবন নির্ধারণ করে দেয়, তো ম্যাক্সিমাম অ্যা সোসাইটির একটা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিবার আমাদেরকে সেই দিকেই হাঁটায়, হ্যাঁ নরমালি সেই দিকেই হাঁটায়, তো এই প্রচলিত হাঁটাটার ভেতরে কখন আপনি হোঁচট খেলেন? কখন আপনার মনে হল এই প্রচলিত হাঁটাটা আপনি আর হাঁটতে পারবেন না? সেটা ঠিক কোন সময়ে?
জাহিদ জগৎঃ আমি তো মনে করতে পারার পর থেকেই খুব বখাইটে, মূলত সেইখান থেকে আর কিছুই হই নি আমি, বখাইটেটাই হইছি, তখন হোঁচট খাওয়াটা মানে আমি আমার বুদ্ধির পর থেকেই আমারে হোঁচট খাইতে দেখতেছি, যেমন আমার...ক্লাস সিক্সে থাকতেই বোধহয় আমার বাপ দেশের বাইরে চলে যায়, আমার বাপ দেশের বাইরে চলে যাওয়ার পরে যেই ভাঙনটা আমি দেখলাম আমার পরিবারে! আমার ঘাড়ে তখন বিয়ে উপযুক্ত দুইটা বোন, তারপরে হচ্ছে আমার ঘরের চালা খুলে পরে যাচ্ছে আমাদের চোখের সামনে, তারপরে আমাদের জোমিজমা বইলে কিছুই নাই, এবং পরিবারের একমাত্র আয় ইনকামের লোক আমার বাপে লিবিয়াতে নিখোঁজ, সেই সময়ে মানে এটা সম্ভবত ৯৫-৯৬ (১৯৯৫-৯৬) দিকে, আমার বাবা সেই সময়ে দুই বছর ধইরে নিখোঁজ ছিলো। সংসারে চাইর-আনা পয়সা নাই, এবং সেইসময় আমার বাপের বিদেশ যাওয়ার আগেই ধার-দেনা ছিলো, বেশ বড় অঙ্কের। এই যে পাওনাদারদের আমাদের বাড়ি এসে যাচ্ছেতাই বলে যাওয়া, আমাদের দিনের পর দিন না খেয়ে স্কুল করা, মানে আমার খুবই মনে আছে, এইক্ষেত্রে আমি খানিকটা স্মৃতিই বলবো এইটারে, একদিন স্কুল থেকে এসে মানে, অ্যা..! সকালে না খায়া স্কুলে গেছি, বিকালে স্কুল থেইকা বাড়ি ফিরছি। মা খাবার দেবেন, মা উঠানে দাঁড়ায়া জিজ্ঞেস করলেন যে, “ঘরে খাবার আছে, যা খায়া নে”। আমি যায়া দেকলাম বাসনে কোন খাবার নাই। এবং মা বলতেছে যে “গামলায় সকালের পান্তা ভাত রাখছিলাম তোর জন্যে” এবং সেই কথা শুনে সাথে সাথে আমার মেজ বোন ঘর থেকে ছুটে বারান্দায় চলে আসে! বারান্দায় এসে দুই পা ছড়ায় দিয়ে মাটিতে আছারি-বিছারি দিয়ে চিৎকার শুরু করলো। কানতেছে আর বলতেছে, “আমি বিষ খায়া ফেলছি'রে ভাই, আমি তোর ভাত খায়া ফেলছি”। মানে ক্ষুধায় থাকতে না পেরে...। এমনিতেই বড় তিন বোনের পর অনেক সাধনা'র একটা মাত্র ছেলে আমি। বোনদের কোলে চড়ে থাকতে থাকতে আমি হাঁটাই শিখছি প্রায় পাঁচ বছর বয়েসে। বুঝতেছেন, আমার মেজো বোনের অবস্থা? এ... এই যে ভাঙ্গন একেবারে ভাবনার শুরু থেকে! পরিবার থেকে দেখে আসতেছি। এবং এই... আজ পর্যন্ত এই ভাঙ্গনের মধ্যেই থাকি আমি, মানে এটা য্যানো এক ধরনের জীবন প্রবাহ হয়ে উঠছে যে, আমি প্রতি নিয়ত ভাঙ্গবো এবং দাঁড়াবো। এই যে, জীবনের এই প্রবাহ দেখতেছি, এটা যে শুধুমাত্র আমার জীবনের ভাঙ্গন বা প্রবাহ বিষয়টা এমন না, এটা ঐতিহাসিক ভাঙ্গন। মানুষ মানে তার অগ্রগামী যাত্রার দিকে এতোবার এতোবার তার সভ্যতারে ভেঙ্গে চূড়মার করে দিয়ে আবার উঠে দাঁড়াইছে, এতোবার সে ধ্বংস হইছে এবং আবার দাঁড়াইছে যে আমার কাছে মনেই হইছে যে, এইটাই জীবন। এই ভাঙ্গাগড়াই তো!...
বাংলাঃ তো, মানে আমরা অ্যা আপনার ‘অন্নদাস’ নিয়েই যেহেতু আলাপ হল একটু আগে; তো আমি যতটুকু, অ্যা আপনার সম্পর্কে স্টাডি করেছি বা মানুষের কাছ থেকে জেনেছি, ‘অন্নদাস’ লেখার আগে আপনার একটা নির্দিষ্ট প্রিপারেশন আছে, সেই চরিত্রগুলোর সঙ্গে মেশার, তাদের সঙ্গে থাকার একটা অভিজ্ঞতার জায়গা আপনার আছে। এবং আমরা বাংলা সাহিত্যে যতটুকু জানি, অ্যা মানে জানা মতে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এরকম একটা এক্সপেরিমেন্ট আছে যে চরিত্রগুলোর সঙ্গে তিনি মানে যে চরিত্রগুলোকে তিনি আনতে চান ঠিক সেই চরিত্রগুলোর কাছাকাছি তিনি থাকার চেষ্টা করেছেন মানে থেকেছেন অসংখ্যবার। আরো অনেকেই করেছেন হয়তোবা। হু, তো আপনার ভেতরেও এই বিষয়টা দেখতে পাচ্ছি। এইটা আসলে ঠিক কোন ইয়ের জায়গা থেকে আপনার, চিন্তার জায়গা থেকে আপনার মনে হইছে যে, যে চরিত্রগুলো, নরমালি হয় যেটা যে ইমেজ ক্রিয়েট করি আমরা, বসে বসে কল্পনা করতে পারি একটা দৃশ্য বা একটা ইমেজ তৈরি করতে পারি। কিন্তু সেটা, সেই পথে না গিয়ে এই কষ্টসাধ্য পরিশ্রমটা যে নিজেকে ভেঙ্গে, ধরা যাক যে আপনি বস্তিতে, বস্তির চরিত্র নিয়ে আসছেন বা রাস্তায় শুয়ে থাকা মানুষগুলো যাদের চরিত্র নিয়ে আসছেন, তাদেরকে তুলে আনার জন্য আপনার তাদের সঙ্গে বসবাস করার এই আইডিয়াটা! অনেক সুচিন্তিত নাকি হঠাৎ করে এসেছে?
জাহিদ জগৎঃ না, আমি শুরুতেই বলছিলাম যে, আমি যখন প্রতিদিনের জীবনযাপনে, যেইসব চরিত্রের ভেতর দিয়ে আলাপ করি! সেই আলাপটাই মূলত আমি দেখতে চাইছি এবং সেই দেখাডারেই পরবর্তীতে স্ট্রাকচ্যারের মধ্যে ফেলে দিয়ে উপন্যাস হইছে। তার মানে হচ্ছে, যে এই সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা, যে আমি ঠিক সাহিত্যই করবো এইটা মূল বিষয় ছিল না আমার। মানুষ তো পাঠ্য! দুনিয়ার প্রত্যেকের পড়ার ভাষা আলাদা। একই পৃষ্ঠায় একজন যা পড়ে অন্যজন তা পড়ে না।
বাংলাঃ আচ্ছা।
জাহিদ জগৎঃ সে ইচ্ছা এখনো নাই। এখনো আমি যেইটা বুঝি যে, অবশ্যই দায়বদ্ধতা আছে। সেটা যদি উপন্যাস না হয়ে প্রবন্ধ হয়, সেটা যদি প্রবন্ধ না হয়ে কবিতা হয়, অথবা কবিতা না হয়ে গান, এরকম যা ইচ্ছা হোক। কিন্তু এই যে দায়বদ্ধতার যে জায়গাটা, যে আমি যেই সংকটের বা যেই সমাজের ভেতর দিয়ে জার্নি করতেছি, যাচ্ছি! সেই সমাজের সাথে আমার কথোপকথনটা কী ছিল? আপনি দেখবেন যে মানে ‘অন্নদাস’ হচ্ছে মূল চরিত্র, উপন্যাসের মূল চরিত্রের নাম অন্নদাস। সে কল্পনাপ্রসূত, সে আমি। আর সোসাইটির বাকি সব ক্যারেক্টার, উপন্যাসের সমস্ত ক্যারেক্টারই সোসাইটিতে বিদ্যমান। মালতী এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মাঠের একটা ক্যারেক্টার, তাকে অনেকেই চেনে, অ্যা ওভারব্রিজের পতিতাদের আমি চিনি, কাওরান বাজারের বস্তির লোকজনকে আমি চিনি, এই বাকি সবগুলো লোকের সাথে মূলত আমি যে আলাপটা করতে চাইছি, বা তাদেরকে যেই দিকে আমি টানতে চাইছি! যে, তারা একটা শক্তি। এই শক্তি নিয়ে মার্চ করা যায়। সোসাইটির এই ব্যারিকেড ভাঙা যায়, এই যে একটা স্বপ্ন আমার মধ্যে আছে, যে, সোসাইটির ব্যারিকেডটা আমরা ভাঙবো, এবং এই সোসাইটির অধিগ্রহণ আমরা করবো। আমরা নামানুষ, অমানুষ না। সাধারণত দেখবেন আপনি যে, এদের বা আমাদের অমানুষ বলা হচ্ছে। যারা সমাজে পিছিয়ে পড়া লোক, তাদের সোসাইটি বলে অমানুষ। অমানুষ বলে কিছু হয় না তো আসলে। পৃথিবীতে অমানুষ বলে কিছুই নাই। মানুষকে অমানুষ বলার সুযোগ নাই কোনভাবেই। হতে পারে সে খুনী, কিন্তু মানুষ। তো এইরকম পিছায়া পড়া লোকজনের যে দায়টা আমি নিলাম সেইখান থেকে যেকোনো সাহিত্যই হইতে পারে। এখন আমার ভবিষ্যতের বা আরো অন্যান্য কাজের জন্যে যে জায়গাটা আমি ভাবি, বা যেটাকে কাজ বলে মনে করি, সেটাও ঠিক এই দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে। এই দায়টা কে কিভাবে নিচ্ছে, বা নিতে চায়, সেইটা একটা ভাববার বিষয়।
বাংলাঃ আচ্ছা। তার মানে হচ্ছে, আপনার কথা থেকে যেটা পাওয়া যাচ্ছে, অ্যা ঠিক অ্যা আপনার সাহিত্য সৃষ্টি কিংবা আপনার লেখালেখি কিংবা আপনার জীবনযাপনের জায়গাটাতে অ্যা ঠিক সোসাইটির শিখিয়ে দেয়া যে ফর্মটা আমরা দেখি যে প্রাতিষ্ঠানিক একটা পড়ালেখা করে, একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে জেনে বুঝে তারপরে একটা প্রসেসে ঢোকা, তার থেকে বরং আমরা দেখতে পাচ্ছি যে আপনার প্রসেসটা হচ্ছে মানে জীবন থেকে শিখে নিয়ে তারপরে সেখানে ঢোকা। এটাই কি দাঁড়াচ্ছে?
জাহিদ জগৎঃ হ্যাঁ, ঠিক তাই। মানে জীবন থেকে শেখার যে জায়গাটা! বরাবরই একটা ব্যাপারে আমি খুবই কনসার্ন থাকি, একাডেমিক নন-একাডেমিক এখানে মূল আলোচনার বিষয় না, আলোচনাটা হচ্ছে যে, চিন্তার পদ্ধতি বা চিন্তার গতি প্রকৃতি নিয়ে। এই যে চিন্তার গতি প্রকৃতি, বিপরীতমুখি চলন বলন আছে এদের। একদিকে হচ্ছে, সোসাইটির গতি প্রকৃতির উপর দাঁড়ায়ে, তার নার্ভের স্পন্দন বুঝে ডাক্তারী কায়দায়, আর একটা হচ্ছে যে মানে একাডেমিক্যালি যে শিক্ষা বা রিসার্চ এর ভেতর দিয়ে সার্চ লাইটের মত খুঁজে নিয়ে সোসাইটির চিন্তা'রে আরও খানিকটা আগায়া দেওয়া আরকি। এখন এইখানে আমি বরাবরই বলি চিন্তার বীজ বপনের জন্যে প্রয়োজন উপযুক্ত জমি। এই জমি সাধারণ বোধ-ই, “বোধ”। যেই বোধটা প্রপারলি তৈরি না হইলে অথবা যেই বোধ ক্রিয়েট না হইলে চিন্তা সেখানে ঠিক পরিস্ফূটিত হইতে পারে না।
বাংলাঃ আপনার এই বোধ তৈরি হওয়ার পিছনে আপনি ঠিক কোন জিনিসগুলোকে জরুরি মনে করেন?
জাহিদ জগৎঃ এই ক্ষেত্রে হচ্ছে যে, মানুষই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, মানুষের এই বোধের উপর আমার চিন্তার মানে দাঁড়াইতে পারে। যদি মানুষের এই বোধ ক্রিয়েট করতে না পারি, সেইক্ষেত্রে হচ্ছে যে একটু আগে বলতেছিলেন, মানে এই ফর্মটা কেন আসলো যে মানুষের সাথে মিশে বা পরিশ্রম করে, একাডেমিক্যালি না যেয়ে মানুষের সাথে মিশে যেতে? আমি এইক্ষেত্রে পাঠ হিসেবে মানুষই নিতে চাইছি। সমাজই নিতে চাইছি। শিক্ষা বলতে আমি সোসাইটির শিক্ষাটাকেই গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে চাই। মানে, যেহেতু আমি আমার কথাটা বলতে চাইতেছি, সেইক্ষেত্রে আমার মানুষ, আমার সোসাইটির কাছে যাওয়াটা আমার জন্য জরুরি। সোসাইটি আসলেই কী? তার ল্যাঙ্গুয়েজ কী? সে কী বলতে চায়? বা মানে তার সম্মুখ অবস্থাটা কী দাঁড়াইতে পারে? সেক্ষেত্রে সোসাইটির আদৌ কোনো চিন্তা আছে কিনা? সোসাইটির চিন্তা আর মানুষের চিন্তার দূরত্ব কতখানি!
বাংলাঃ ভাষা নিয়ে আপনার চিন্তা কী? ভাষার ব্যাপারে বা বিষয়ে আপনি কী ভাবেন?
জাহিদ জগৎঃ ভাষার ব্যাপারে আমি তো খুবই মানে, আপনি আগেও খেয়াল করছেন বোধ হয়, আমি ভাষার ব্যাপারে খুবই রাফ। এক্ষেত্রে কোনো ব্যারিকেড-ই বিশেষ করে একাডেমিক কোনো ব্যারিকেড-ই আমার মধ্যে নাই। যেইখানের মানুষ, মানে যার কথা বলতেছি আমি, তার কথাটা তার ভাষায়ই বলতে চাই। যখন আমি বস্তি অথবা একটা পতিতালয়ের গল্প বলবো, তখন হচ্ছে যে, পতিতার নিজের ভাষা তৈরি হয়। এখন কী ভাষায় সে তার খদ্দের অথবা তার সোসাইটিরে ডিল করে, সেই ভাষারে আমি তার জায়গায় তার ভাষাতেই দাঁড় করায়া রাখতে চাই, এক্ষেত্রে আরোপিত ভাষার উপর আমি নির্ভরশীল না।
বাংলাঃ হ্যাঁ, এই যে আরোপিত ভাষা, আমাদের এখানে এক ধরনের চর্চা আছে যে, চাপিয়ে দেয়া, এই একটা কাঠামোর বাইরে যদি আমরা না যাই তাহলে তাকে সাহিত্যিক হিসেবে গণছি না, বা সাহিত্য হিসেবে গণছি না, এই ব্যাপারটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
জাহিদ জগৎঃ এখন, আপনি দেখবেন যে আমাদের এখানে প্রচুর বিদেশি দর্শন, বিদেশি ঠিক না মানে বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানী করা অনেক দর্শন আসতেছে, বিশেষ করে আপনি দেখবেন আমাদের ল; ল এর বাংলা করা যায় না খুব একটা, সেক্ষেত্রে ইংরেজিতেই করতে হয়, যদি বাংলায় কিছু কিছু করা যায় তার জন্য বাংলায় উপযুক্ত একাডেমিক যে ফর্ম আছে, সে শব্দগুলো সাধারণত প্রচলিত না। প্রাচীনপন্থিরা গোড়ার ভাষা বইল্যা সংস্কৃত রীতি নীতির উপর ভর দিয়া থাকতে চায়। শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্র ছাড়াও যতোটা সম্ভব ব্যাকরণেও তাই। আরও একপন্থী আছে, যারা শুদ্ধাচার্য্য। এইডা আরবী, ঐডা হিন্দি, মুছলমানের ভাষা, খ্রিস্টানের ভাষা বলে সহজে পাঠযোগ্য শব্দরে খারিজ করে দিচ্ছে তারা। আরে, সাহিত্য টাহিত্য হইলো মানুষের ঘরের খবর। এইডার জন্য এইসব লক্কর ঝক্কর কেন করতে হবে? সেইক্ষেত্রে এই ভাষার গুরুত্ব অনেক বেশি, যখন আমি সাহিত্য করতে আসছি, তখন হচ্ছে যে, এই বিদেশি ভাষা আদৌ খুব গুরুত্বপূর্ণ কিনা! অথবা প্রমিত ভাষাডাই খুব গুরুত্বপূর্ণ কিনা! সেইটা দেখার বিষয়। দরকার আর মানুষের গ্রহনযোগ্য হয়ে উটলে আমার আপত্তি নাই আর দরকার না হইলে জোর করেই কেন ঢুকাতে হবে? আমার ক্ষেত্রে, আমি যে গল্পগুলো বলতে চাই, যে জীবনের সাথে আমার কাজ করে যেতে হয়, সেই জীবনের সাথে আপাতত প্রমিতের খুব সম্পর্ক নাই। এবং জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রেও এই বিষয়টা ভাবা দরকার। আসলে, মান ভাষার সাথে প্রচলিত ভাষার সম্পর্ক কতটুক! এবং প্রচলিতের সাথে সমন্বয় করে তারে আরও সহজ আর বোধগম্য করে তোলা যায় কি না, সেইসব খুঁজে দেখা দরকার। এবং সেই খুঁজে দেখার ভেতর দিয়ে যদি সেইখানে পৌঁছাইতে পারি, তাইলে ধরেন, প্রচলিত সমাজরে একটা মান ভাষার দিকে আগায়া নিয়ে যাওয়া যায়। ভাষার ক্ষেত্রে এইসব আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হইচে।
বাংলাঃ আচ্ছা, আমাদের এখানে, সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে একটা গোষ্ঠীবদ্ধতার ধারণা বিদ্যমান আরকি।
জাহিদ জগৎঃ হ্যাঁ, হ্যাঁ।
বাংলাঃ হ্যাঁ, এটা ঐতিহাসিককাল থেকেই আমাদের এখানে সাহিত্যচর্চা এক ধরণের গোষ্ঠীবদ্ধতায় আচ্ছন্ন, এই গোষ্ঠীবদ্ধ সাহিত্যের প্যাটার্ন নিয়ে আপনি কী ভাবেন? এটা কি আদৌ সোসাইটিতে কোনো র্যাডিকেল চেঞ্জ আনতে পারে কিনা?
জাহিদ জগৎঃ এখন, র্যাডিকেল চেঞ্জের জন্যে ধরেন আমরা রাজনীতির দিকে তাকায় থাকি, বিভিন্ন সংগঠনের দিকে তাকায় থাকি, বিভিন্ন প্রগতিশীল চিন্তাবিদের দিকে তাকায় থাকি। এইক্ষেত্রে, এই যে সাহিত্যের গোষ্ঠীবদ্ধতা! এর বিরোধিতা আমি করতেছি না। সাহিত্যের দিক থেকেও অনেকখানী আগায় দেবার আছে। কিন্তু কথা হইতেছে যে, মূলত সাহিত্যের বড় গোষ্ঠী হচ্ছে তার পাঠক, বা তার মানুষ। সে আদৌ কার কথা বলতে চায় এবং কার জন্য বলতে চায়, সেইটা হচ্ছে যে, সাহিত্যের গোষ্ঠীবদ্ধতা বলে আমার মোনে হইচে। কিন্তু আমরা বরাবরই একটা ভুল পথে আগাইছি। আপনি দেখবেন যে, আমাদের এইখানে যারা গান করে, ব্যান্ড ফর্মের যে চিন্তা এইটাও ঠিক একটা সময়ে খুবই গোষ্ঠীবদ্ধ অবস্থায় ছিল, যেমন আন্ডারগ্রাউন্ড রক বা আন্ডারগ্রাউন্ড রকাররা আন্ডারগ্রাউন্ডে তাদের নির্দিষ্ট অডিয়েন্স, তারপরে যারা ইস্টেজ পারফর্ম করতে আসলো তাদের নির্দিষ্ট অডিয়েন্স। তো সাহিত্যের ক্ষেত্রে এই রকম নির্দিষ্ট জায়গা ক্রিয়েট করা মানে হচ্ছে যে তাদের নিজেদের জন্য নিজেদের খিস্তি করা আমার মনে হয়। তবে সাহিত্য আদৌ হলো কি হলো না, সেইটা নিয়ে আমার কোনো আলাপ নাই। আলাপটা হচ্ছে যে তারা এর ভেতর দিয়ে আদৌ বেনিফিটেড হচ্ছে কিনা, সাহিত্য বেনিফিটেড হচ্ছে কিনা, সেইটা গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া গোষ্ঠীর ব্যাপারে আমি খুবই অ্যালার্জেটিক, আমার কোনো ভালো সাহিত্যিক বন্ধু নাই, যদিও এই সময়কার প্রায় সবাইকেই আমি চিনি। বেশিরভাগ, ঠিক এখন দেশের তরুণ যারা সাহিত্য করতেছে, কবিতা লিখতেছে, গল্প-গান লিখতেছে, তাদের অনেকরেই আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। আমি আসলে যাদের চিনি, এই সবটুকু মিলায়ে আমার মনে হইচে যে, তারা মানে এই যে গোষ্ঠীবদ্ধ সাহিত্যিকরা! তাদের এই গণ্ডি ভেঙ্গে বের হয়ে আরও মানুষের কাছে পৌঁছানো উচিৎ। মানুষের সাথেই এই সম্পর্ক গড়ে তোলা উচিত আরও।
বাংলাঃ অ্যা, এই সময়ে, সমসাময়িক সময়ে আপনি তো লিখছেন, আরও অনেকেই লিখছেন, এদের মধ্যে কাদের লেখা মানে আপনাকে ভাবতে বাধ্য করে আসলে? কাদের লেখা আপনি পড়েন? আপনি আদৌ পড়েন কিনা অন্যদের লেখা! অ্যা প্রশ্নটা যদিও টাফ(হে হে একটু হাসি দুইজনেই)......!
জাহিদ জগৎঃ এটা আসলে একটু কঠিনই, কারণ হচ্ছে যে অনেক ছেলেমেয়ে লিখতেছে, এর মধ্যে কবিতায় খুবই ভালো করতেছে অনেকেই। বাংলাঃ হুম। জাহিদ জগৎঃ মানে নাম বললে অনেকের নাম বলা যাবে, তো আমি স্পেসিফিক কাউরেই বলতেছি না। কারণ হচ্ছে যেহেতু এটা একটা সময়, সময়কে ধারণ করা খুবই টাফ, এর মধ্যে ধরেন দশ হাজার ছেলেমেয়ে কবিতা লিখতেছে, তার মধ্যে দশ জন ভালো করে উঠছে, দ্যাট মিনস এই সময়টাই ভালো করে উঠছে। যেহেতু এই সময়টা কবিতার জন্যে খুবই ভালো হয়ে উঠছে, তার মানে হচ্ছে যে, স্পেসিফিক কারও নাম বলার প্রয়োজনই নাই। আবার অন্যদিকে উপন্যাসের ক্ষেত্রে আমি বলবো, মানে এইক্ষেত্রে ডেডিকেশন কম। উপন্যাস তো একটা প্রতিচ্ছবি, একটা সিনেমার মতো। একটা সিনেমা যেমন কম্বাইন্ড আর্ট, তার সুনির্দিষ্ট আর্টিস্ট থাকে, ডিরেক্টর থাকে, ক্যামেরাম্যান থাকে, তো এরকম একটা উপন্যাসের ক্ষেত্রেও আমার মনে হইচে যে তার চিন্তাকে, তার চিন্তার বাস্তব, পরাবাস্তব অবস্থার প্রতিফলন দেখে, তারপর একটা রূপকাঠামো তৈরি করা। সেক্ষেত্রে উপন্যাস খুব ভালো হচ্ছে বলে আমার মনে হয় না এসময়।
বাংলাঃ তো, আপনি, আমরা জানি যে আপনি উপন্যাস মানে প্রকাশিত আপনার বই উপন্যাসই একটা...
জাহিদ জগৎঃ হ্যাঁ।
বাংলাঃ আপনি কবিতাও লিখেন, গানও লিখেন, প্রবন্ধ লিখেন কিনা এই বিষয়ে আমি আপনার সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট...
জাহিদ জগৎঃ হ্যাঁ, লিখেছিলাম কিছু। আসলে ওগুলো কিছুই হয় নাই। ওটা তো আসলে বুদ্ধিবিত্তিক কাজ! আমার অতো শিক্ষা দীক্ষা নাই।
বাংলাঃ লিখেন, প্রবন্ধও লিখেন এবং......(কিছুক্ষণ বিরতি মূলত আযানের জন্য, সন্ধ্যাও হয়ে আসছিলো, নানামুখী শব্দে কথা বলতে একটু সমস্যা হচ্ছিলো উদ্যানে, ফলে আমরা দুই তিন মিনিটের বিরতি নিয়ে সিগারেট টানতে থাকি।)
বাংলাঃ আমি যেখানে ছিলাম, আমি যেটা বলতে চাচ্ছিলাম যে আপনি একই সঙ্গে উপন্যাস লিখেছেন (একটা প্রকাশিত), প্রবন্ধ লিখেন, কবিতা লিখেন, গানও লেখেন যেটাকে আমরা গীতিকবিতা বলি, এবং আমরা জানি যে আপনি সিনেমাতেও কাজ করেছেন। তো প্রত্যেকটা তো ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যম, প্রত্যেকটার ফর্ম বা কাঠামো আলাদা আলাদা, চিন্তা কাঠামো আলাদা আলাদা; তো এই সবগুলোর ভিতরে আপনি সমন্বয় করেন কিভাবে? বা আপনার চিন্তার কাঠামোতে এখানে কোনো প্রভাব ফেলে কিনা, মানে ধরেন একটা লিখছেন আরেকটা এসে ঝামেলা করছে কিনা? এই জায়গাটা তৈরি হয় কিনা?
জাহিদ জগৎঃ একদমই করে নাই। কারণ হচ্ছে যে আমি আসলে সরাসরি জীবনের এতোগুলো পাঠ পড়ে আসছি যে, আমার কাছে প্রত্যেকটা পাঠই আলাদা মনে হয়। মানে জীবনের প্রত্যেকটা পার্ট বা জার্নি একেবারেই আলাদা, একেবারেই নতুন, একেবারেই প্রথম। সিনেমাতেও কাজ করার সময়, বা তার আগেও অনেকের সাথে অ্যাসিটেন্সি করছি অনেক দিন। অ্যা... কমলা রকেট! নূর ইমরান মিঠু পরিচালিত। তো... সেখানে প্রধান সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব নিয়ে বের হলাম, তখন মনে হইছে যে আমি বোধহয় শুধুমাত্র সিনেমা বানানোর জন্যই জন্ম নিছি। বা এইটা দিয়েই আমার জীবনের শুরু এবং এইটাই শেষ কাজ। উপন্যাসের ক্ষেত্রেও তাই ঘটছে। অ্যা, গান লেখার ব্যাপারটা হচ্ছে এইসব আলোচনার উর্দ্ধে। আমার প্রকাশিত প্রথম কোনো কিছু হচ্ছে যে গান, “সুন্দরবন” নিয়ে লেখা ছিল। অ্যা, গারো মান্দি একটা ব্যান্ড গাইছে। তো সেই দিক থেকে, আমি যখন গান লিখতে আসছি, তখন আমি সমস্ত কিছুর বাইরে কোন এক উঁচু জায়গায় বসে দেখছি তার সমস্তটুক। য্যানো আমার অতীত আর ভবিষ্যতের একমাত্র ভাষা গান। পৃথিবীতে আমি তখন গানের ভাষাই বুঝি আর কোনো কিছুই বুঝি না। সে এক হাহাকার মনে হয়। যা কিছু বেদনা, তা যেন অন্য আর কোন ভাষাতেই বলা যায় না।
বাংলাঃ হুম, তার মানে ইনফ্যাক্ট যেটা দাঁড়াচ্ছে, অ্যা, আপনার লেখালেখির জায়গায় আলাদা করে অনুপ্রেরণার কোনো দরকার হয় না, আপনার জীবনযাপন পদ্ধতিই আপনাকে লেখালেখির দিকে ঠিক নিয়ে যায় কিনা!
জাহিদ জগৎঃ ঠিক, ঠিক, একদম তাই। বাংলাঃ আচ্ছা... জাহিদ জগৎঃ কারণ, “লিখতেই হবে” বিষয়টা'কে এইরকম করে ভাবি নি কোন সময়। কিন্তু জীবনটাকে যাপন করা যায়, এইটার যে রঙ আছে, একটা নদীতে আপনি যখন নৌকা নিয়ে নৌকাটা ছেড়ে দেবেন, না বেয়ে, নৌকাটা এপাড় ওপাড় না করে। তখন দেখবেন যে, নৌকাটা কত ভাঁজে ভাঁজে, কত ভাবে সে স্রোত বেয়ে চলে যাচ্ছে, স্রোতের সাথে মিশে যাচ্ছে, আবার বাড়ি খেয়ে ঘুরেও যাচ্ছে স্রোতের বিপরীতে। তো এই স্রোতের সাথে মিশে যাচ্ছে ভাঁজে ভাঁজে এইটারও আলাদা একটা রঙ আছে। প্রত্যেকবার এইটা চেঞ্জ হয়! এই চেঞ্জ এর ভেতর দিয়ে নতুন করে জীবন দেখা যায়, জীবন মরণের সংজ্ঞাটাও আমি এভাবেই দেখি যে, প্রতিবারই আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি, তারপর আবার নতুন রঙে নতুন ভাবে বেঁচে উঠতেছি।
বাংলাঃ আচ্ছা, তার মানে হচ্ছে যে আপনি শুরুতে সাক্ষৎকারে, শুরুতেই বলেছিলেন যে আপনি একটা দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে লেখেন... জাহিদ জগৎঃ হ্যাঁ। বাংলাঃ বা সেটা লেখা না হয়ে সেটা অন্য কিছুও হইতে পারতো!
জাহিদ জগৎঃ হ্যাঁ, পারতোই তো।
বাংলাঃ দায়বদ্ধতার জায়গা বলতে আমি যেটা বুঝতেছি যে আপনি যেহেতু একটা জীবনযাপনের ভেতর দিয়ে জীবনযাপনটাকেই আপনি সাহিত্য মনে করেন, হ্যাঁ, তো সোসাইটি থেকে একটা দায়বোধ তৈরি হয় আপনার। সেই দায়বোধটাকেই কি আপনি আপনার সাহিত্যে রূপান্তর করেন কিনা?
জাহিদ জগৎঃ আসলে, দায়বোধটাকেই সাহিত্যে রূপান্তরিত করি কিনা তার থেকেও বড় ব্যাপার যে, ও আমাকে ফোর্স করে কি না। ছেড়ে দেওয়া নৌকাটার মতো ভাসমান কিন্তু প্রতিটি নতুন রঙ বা সোসাইটির বাঁক ফোর্স করে। যদি ধরেন, আমি একজন ঔপন্যাসিক হিসেবে প্রকাশিত না হতাম, অথবা কবিতা না লিখতাম অথবা গান না লিখতাম, তাহলে আমি পলিটিশিয়ান হতাম। আমি হতাম একজন রাজনীতিবিদ। রাজনীতিবীদ হতাম এই কারণে যে, তখন আমার এই দায়বদ্ধতারও যে আলাদা আলাদা রঙ! আরও বেশি করে দেখার জায়গা ছিল। যেহতু সেইখানে আমি ফেইলড, আমি পারি নি একজন দক্ষ রাজনীতিবীদ হইয়ে উঠতে! সেহেতু, যে অবস্থায় যা যা দায়বদ্ধতা আমার সেই অবস্থা যদি ফোর্স করে যে, এইটা তোমার করণীয়, এইটা করা উচিৎ।
বাংলাঃ আপনার সুনির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক বিশ্বাস আছে কিনা?
জাহিদ জগৎঃ এখন, এইটা একটু কঠিন ব্যাপার! কঠিন ব্যাপার এই কারণে যে, আপনি দেখবেন যে, নানা ভাবে ঠিক একই উদ্দেশ্যে নানা রঙের নানা বর্ণের রাজনৈতিক দলের গড়ে ওঠা। প্রত্যেকেরই একই লক্ষ্য, ঠিক প্রত্যেকের না, আপনি দেখবেন যে ডান বাম বলে দুইটা অংশ জারি আছে আমাদের সমাজে, দুইটার দুই রকম উদ্দেশ্য হলেও ইনডিভিজুয়াল আজকে বিএনপি’র উদ্দেশ্য যা, আওয়ামী লীগ'র উদ্দেশ্যও সেই একই। আবার এদিকে বাম দলগুলোর অবস্থা দেখলেও বুঝবেন যে সব দলগুলোরই একই অবস্থা, বামদলগুলোর প্রত্যেকেরই উদ্দেশ্য এক, একটা শ্রেণিহীন সমাজ তৈরি করা। এখন, এই এরকম সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শ তো অবশ্যই আছে, সেইক্ষেত্রে প্ল্যাটফর্ম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই প্ল্যাটফর্মটা এখন পর্যন্ত তৈরি হয় নাই, বলে আমার ধারণা। তারা প্রায় জনবিচ্ছিন্ন, বেশিরভাগ দলই। তারা জনগণের ভাষার সাথে সম্পৃক্ত না প্রথমত। দুই হচ্ছে যে, তারা ক্রাইসিস সম্পর্কে একাডেমিক চিন্তার মধ্যে গোষ্ঠীবদ্ধ থাকে। আপনি দেখবেন যে ল’এর দুইটা পার্ট; সাধারণত রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত একটা ল, যেটাকে আমরা আইন বিভাগের মধ্যে ফেলে রাখি। আর একটা হচ্ছে সামাজিক ল। যেটা হচ্ছে যে, ছোট খাটো অনেক অপরাধের সমাধান এখনো সমাজ নিজেই করে ফেলে। এই অংশের নিয়ন্ত্রণ নিতে রাষ্ট্র নিজ উদ্যোগে গ্রাম সালিশ বা গ্রাম সরকার গঠন করে বসে আছে, যেন কিছুতেই সমাজের এক ইঞ্চি জায়গাও রাষ্ট্র ক্ষমতার বাইরে যেতে না পারে। এই যে ল্যাঙ্গুয়েজের দুইটা ধারা! আইনেরও যে দুইটা পার্ট আলাদা জারি আছে, সেই ক্ষেত্রে এই দ্বন্দ্ব গুরুত্বপূর্ণ। সোসাইটি নিজে নিজেরে শাসন করবে না রাষ্ট্র তারে শাসন করবে? তো এইক্ষেত্রে হচ্ছে যে, মানে... সমস্ত বামদলগুলো সোসাইটির এই ল্যাঙ্গুয়েজকে রিসিভ করতে পারে নাই। তারা রাষ্ট্রের অথর্ব এক ল্যাঙ্গুয়েজের সাথে ওঠা-বসা কিংবা বোঝা পড়া করতে থাকে। সমাজের ভাষার সাথে তাদের এই যোগাযোগ করতে না পারার কারণে এইখানে জনগণের হয়ে কোনো প্ল্যাটফর্ম দাঁড়ায় নাই। এই যে জনগণের প্ল্যাটফর্ম দাঁড়ায় নাই সেইটার ব্যর্থতা আমি বলতে চাইছি মূলত, যার ভেতর দিয়ে আমারও রাজনৈতিক ব্যর্থতা বড় হইতেছে।
বাংলাঃ সেক্ষেত্রে অ্যা... সাহিত্য কী ভূমিকাটা নিতে পারে?
জাহিদ জগৎঃ ওহ, যেহেতু আমি আর কিছুই করতে পারি নাই, যেহেতু আমি আমার পলিটিকস্টা করতে পারি নাই, যেহেতু আমি আমার সুনির্দিষ্ট সোসাইটি মেক করতে পারি নাই, সেহেতু সাহিত্য হচ্ছে যে সবচেয়ে নিম্নমানের আশ্রয় আমার। মানে, তালাক যেমন হালালের মধ্যে সবচে ছোট হালাল সেই রকম আর কি। এছাড়া আমার আর কোনো উপায়ও নাই আপাতত। যেখানে আমি করতে পারি নাই বলতে হচ্ছে, এই বলার মাধ্যম হিসেবে আমি সাহিত্য'রে নিছি।
বাংলাঃ ওকে, তাহলে আপনার অ্যা... ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বা সামনে কী প্রকাশ করবেন আপনি? অ্যা কোন মাধ্যম? গল্প, কবিতা নাকি উপন্যাস?
জাহিদ জগৎঃ অ্যা অ্যা, খুব তাড়াতাড়ি আমি গল্পের বই করতে চাই। “সাপের খামার” নামে। এইটা আমার একটা বিশেষ দুঃখ। “সাপ” বইলা আমার একটা অধ্যায় আছে। যেইটারে আমার যাপন করতে হয় তারে একটা দুঃখ নাম দিয়া আমি কিছুতেই আড়ালে রাখতে পারতেছি না। তারে তার হাতে দিয়া মুক্তি নিতে চাই।
বাংলাঃ আচ্ছা।
জাহিদ জগৎঃ সেখানে কয়েকটা গল্প আছে। এই “সাপের খামার” বলতে যা বুঝি আমি সেটা হচ্ছে যে একেবারে রাষ্ট্রের যে অবকাঠামো এবং তার যেই যেই অঙ্গপ্রত্যঙ্গ! তারা প্রত্যেকেই সাপ হিসেবে আইজ, অ্যা... সাধারণ মানুষ হিসেবে আমাকে যেভাবে দংশন করে, যেভাবে আমাকে আহত করে, যেভাবে আমাকে খুন করে, ঠিক এই প্রেক্ষিতেই গল্পগুলো সাজানো। এর বাইরে ব্যক্তিগত দংশন তো আছেই। এই সবকিছুর উপরে দাঁড়ায়াই ‘সাপের খামার’টা করা।
বাংলাঃ আচ্ছা, তো বই প্রকাশের ক্ষেত্রে, আপনি যেহেতু বই প্রকাশ করেছেন; লেখক হিসেবে প্রকাশের সঙ্গে আপনাকে তো জড়িত থাকতে হয়, কাজ করতে হয়, বই প্রকাশের ক্ষেত্রে আমাদের এখানে প্রকাশনা শিল্পের অবস্থাটা নিয়ে আপনার নিশ্চয়ই কোনো চিন্তাভাবনা আছে? বা আপনি কী দেখেছেন, সেই জায়গাটা আপনি যদি আমাদেরকে পরিষ্কার করে বলেন।
জাহিদ জগৎঃ আপনি দেখবেন যে, “অন্নদাস” হচ্ছে খুবই অখ্যাত, অপ্রয়োজনীয় বলা যায়, যার নামই জানে না কেউ এই রকম একটা প্রকাশনী থেকে আসছে- ‘অদ্বৈত’। এই প্রকাশনাটি মূলত একেবারেই একটি অপ্রতিষ্ঠিত একটি জায়গা, আমাদেরই কয়েকজনের মিলে একটা প্রকাশনা সংস্থা করে তোলার চেষ্টা করছিলাম এবং সেইখান থেকেই বইটা করা এবং শেষ পর্যন্ত দাঁড়ায় নাই। তো মূল জায়গাটা হচ্ছে যে, আমি এতো বেশি অখ্যাত, এতো বেশি রাফ টাফ যে কখনই প্রকাশনা সংস্থার সাথে আমার খুব ভালো সম্পর্ক হয়ে ওঠে নাই। প্রায় সব জায়গাতেই সাহিত্যের একটা অঙ্গন জারি থাকে, সেটা সব সময়ের জন্যে। দ্যাখেন, “সাহিত্যের অঙ্গন” যার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত প্রকাশনা সংস্থা, লেখক, কবি, সাহিত্যিক, একই সাথে পাঠকও। একটা ব্যাপার আমি দেখছি যে, কেন জানি এই অঙ্গনটা আমাকে কোনো সময়ই খুব সহজভাবে নিতে পারে নাই। হয় তারা ভয় পায়, আর না হয়, আমি খুবই আনকালচারড (অঙ্গনের কালচারে)। যেহেতু তাদের কেউই মুখোমুখি হয় নি আমার, অথবা হতেই চায় নি। সেইদিক থেকে, হয় তারা আমাকে ভয় পায় আর না হয় আমি একেবারেই অপ্রয়োজনীয়! যেহেতু আমার জায়গাটাই ভিন্ন, এবং আমি নিজেরে এইভাবে দেখি কোনো কোনো সময় যে, আমি এই অঙ্গনের বাইরেই নিজের জমিতে এক অসভ্য মাস্তান। যেহেতু কাউরেই আমি কোনো সময় কেয়ার করি নাই, কোনো প্রকাশক'রে আমি কোনো দিন ফোন দেই নাই। মানে কোনো প্রকাশনার সাথে আমি আজ পর্যন্ত কথা বলি নাই এই নিয়ে যে, আমার একটা পাণ্ডুলিপি আছে বা এই ওই লিখে উদ্ধার করে ফেলেছি। যদিও প্রকাশনা'র ক্ষেত্রে সংস্থার দায় অনেক বেশি, লেখকের থেকে শুরু করে পাঠক পর্যন্ত। সেইক্ষেত্রে যতখানি সততা থাকার দরকার ছিলো তার এক অংশও কারও মধ্যে দেখা যায় না এখন। আপনি দেখবেন, বইমেলার সময়, যে কেউ যে কারও বই ছাপতেছে। কারও কোন স্পেশালিটি নাই। নতুন নতুন ফ্যাশনেবল বোকা সোকাদের হাতিয়ে নিয়ে যাচ্ছে-তাই একের পর এক ছেপে লেখকরেই ধরায়ে দিচ্ছে ২০ কপি। সে কবিতার বইও ছাপতেছে, নামায শিক্ষাও বেচতেছে আবার বড়দের দাম্পত্যও। সবচে বেশি হয় দালালী। এইক্ষেত্রে একাডেমির বাইরে আমি। আপনি দেখবেন বাংলা একাডেমি যে আয়োজন করে এইখানে আমার কোনো, অ্যা আমার কোনো কন্ট্রিবিউশন নাই।
বাংলাঃ অ্যা, আ...আমি ঠিক এই জায়গাটাতেই আসতে চাচ্ছিলাম যে প্রকাশনার জন্য বই মেলার প্রয়োজনীয়তা কতটা?
জাহিদ জগৎঃ এখন, বইমেলা হচ্ছে একটা মেলা। খেলনার সিজনাল অথবা নৌকা বাইচের মেলাও দেখছেন, তারপরে আরও যেসব, বৈশাখী মেলা হয় পান্তা ইলিশের এরকম বইমেলাও শুধুমাত্র একটা মেলা! এইক্ষেত্রে শুধু প্রকাশনার জন্য বইমেলা একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক বিষয়টা ঠিক এরকম না। বরং এর মধ্য দিয়ে অনেক মানুষের মধ্যে বই যে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার অথবা খেলনা, যাইহোক, শুধু বই ম্যাসেজটা ছড়ায় দেওয়া যায়। এর চেয়ে এর খুব বেশি কোনো গুরুত্বপূর্ণ দিক নাই মানে মানুষ'রে বই শব্দটার সাথে কানেক্ট করা ছাড়া। প্রকাশনার ক্ষেত্রে যেকোনো সময়ই প্রকাশ হইতে পারে, কিন্তু বইমেলাটা যখন হয় তখন একেবারে সাধারণ মানুষও সারা মাস ধরে রেডিও টেলিভিশন অথবা রাস্তাঘাটে মানুষের কাছে শুনতে থাকে যে বইমেলা হচ্ছে। দ্যাট মিনস নৌকা বাইচ, পান্তা ইলিশের মতো বইও একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এইটা একটা ভালো দিক বইমেলার। এর বাইরে আমি আর বেশি চিন্তা করতে পারি না বইমেলা নিয়ে।
বাংলাঃ আচ্ছা, অ্যা, আমরা জানি যে একটা সময় আমাদের...লেখা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বা লেখকদের চিন্তাগুলো জানার মাধ্যম হিসেবে পত্রিকাগুলোর সাহিত্যপাতাগুলো ছিল, হ্যাঁ, সেই সাহিত্যপাতাগুলো থাকার জায়গা থেকে এখানে এক ধরণের গোষ্ঠীবদ্ধতার জায়গা তৈরি হয় আরকি! নানা প্রতিষ্ঠানের নানা উদ্দেশ্য বা নানা চিন্তা থাকে, তো সেই চিন্তার জায়গা থেকে একটা জায়গা তৈরি হয় কিন্তু এখন যেহেতু একটা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম আসার পরে মানুষের হাতে মানুষ নিজেই এখন একটা মিডিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে আরকি! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো যেখানে আসছে, তো আসার ফলে দেখা গেল যে কেউ আপনার লেখা ছাপলো না বা কারও মনে হল আপনার চিন্তা তার বা তাদের গোষ্ঠীর চিন্তার সঙ্গে যাচ্ছে না, তখন আপনি আপনার ইচ্ছেমতো সেটাকে প্রকাশ করে দিতে পারছেন, এই যে মানুষের বা মানুষকে এই ক্ষমতাটা দেয়া বা মানুষের এই ক্ষমতায়ন তৈরি হওয়াটাকে আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করেন?
জাহিদ জগৎঃ আমি খুবই পজেটিভলি নিই। পজেটিভলি নেই এই কারণে যে, মানুষের কাজের জায়াগাটা ছিলো একেবারে পুঞ্জীভূত, সেটাও কোনো না কোন গোষ্ঠীর হয়ে। একটা সময় মানুষের প্রকাশনার জন্য, এমনকি জীবনানন্দকেও চিঠি লিখতে হইছে যে “আগামী একবছর কবিতা দেবো, আমারে কিছু টাকা দ্যান” টাইপ। তো এইসব জায়গা থেকে মানুষ খানিকটা বের হয়ে আসতে পারছে। এর কিছু খারাপ দিকও আছে, খারাপ দিক বলতে, ধরেন, মানে, সে প্রকাশ করলো, এই অনলাইনে, ফেসবুকে বা আরও সব সামাজিক মাধ্যমে! প্রকাশ করার পরে মানে তার গুরুত্ব ঠিক কতটুকু, যেই গুরুত্বপূর্ণ আলাপটা সে করতে চায়, সেটা আদৌ মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো কিনা! আই মিন মাচ পিপলের মধ্যে সমসময় একটা ঢালাও স্রোত থাকে। চিন্তার কাজ ট্রেন্ডের মধ্যে হারায়া যাওয়া না। সেইক্ষেত্রে একটা দূরত্ব চিন্তাশীলের থাকেই! চিন্তার জায়গাটা ভার্চুয়ালি হঠাৎ করে একটা ট্রেন্ডের মধ্য দিয়ে ঠিকঠাক বুঝে ওঠা যায় কি না! মানে ইলেক্ট্রিক ডিভাইসের মধ্যে যেই দ্রুত তার মগজ দৌড়াইতে থাকে, তাতে সে চিন্তা'র ওজনটা ধরতে কঠিন হয়ে ওঠে কি না আর সকলের জন্য সেইটা একটা বিবেচনার বিষয়।
বাংলাঃ হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেই জায়গায় আমারও একটা প্রশ্ন আছে...
জাহিদ জগৎঃ সেই ক্ষেত্রে অনলাইন হইলেও নির্ভরযোগ্য কিছু জায়গা ক্রিয়েট হওয়া জরুরি, যেমন ওয়েবজিন হচ্ছে এখন, নানা সাহিত্য ম্যাগাজিন হচ্ছে, অনলাইন ম্যাগাজিন হচ্ছে। সেইক্ষেত্রে ম্যাগাজিনগুলো আদৌ দায়িত্ব নিচ্ছে কিনা যে, সহজে কি করে চিন্তা'কে গুছিয়ে সাজিয়ে মানুষের কাছে পৌছে দেওয়া যায় কি না! বিচ্ছিন্নতা ঝেড়ে ফেলে একটা বাস্তবতার মধ্যে নিয়ে আসার মতো সেই দায়িত্ব আসলে ম্যাগাজিনগুলো নেয় কিনা? সেটা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে!
বাংলাঃ হুম, অ্যা, অ্যা, আপনার কাছে কি মনে হয়, আমি একটা জিনিস খেয়াল করেছি যে, এটা পজেটিভ প্রকাশনার জায়গা হিসেবে এটা পজেটিভ...
জাহিদ জগৎঃ হুম... পজিটিভ ব্যাপারটা আসলে গড়ে তুলতে হয়।
বাংলাঃ কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে একটা সাহিত্য নিয়ে নানা ধরণের আলাপ হতে পারে, আলোচনা সমালোচনা হতে পারে, কিন্তু এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ঠিক সমালোচনার জায়গাটা নষ্ট হয়েছে কিনা বা নষ্ট করে দিয়েছে কিনা? এখানে দুটা ট্রেন্ড আমরা খেয়াল করি, একটা হচ্ছে যে হয় প্রশংসা, হ্যাঁ হয়েছে, খুব ভালো হয়েছে অথবা গালাগালি। গালাগালি, সহজ বাংলায় যদি বলি কিছুই হয় নাই অথবা ব্যক্তিগত অ্যাটাকের জায়গাটা; এটা কি আমাদেরকে মানে সমালোচক হিসেবে বা সাহিত্যের একটা প্রপার সমালোচনা, যেমন সাহিত্যিক হয়তো যেটা ভাবেও নি বা যে লিখেছে, সেই এঙ্গেলটা সে ধরেই নি , এই জায়গাটায় সমালোচনাকে এই মাধ্যম উন্মোচিত করছে নাকি আরো দাবিয়ে দিচ্ছে বলে আপনার মনে হয়?
জাহিদ জগৎঃ এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আদৌ সমালোচনার এই জায়গাটা, এই ভার্চুয়াল দুনিয়া সেই সমালোচনার জায়গাটা নষ্ট করে দিচ্ছে কিনা? চিন্তাভাবনা করেছি এক দুইবার। সিদ্ধান্তে উপনীত হই নাই, কারণ হচ্ছে যে, আপনি দেখবেন, সমালোচনার ক্ষেত্রে যেইটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ! সেইখানে, এক্সাক্টলি একটা লাভ হইছে, সেই লাভটা হচ্ছে যে, যেইটা আসলে কাজ, সেই কাজটা নিয়ে আলোচনা বা সমালোচনা করতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। ভার্চুয়ালি সেই আলোচনা বা সমালোচনাটা ইনস্ট্যান্ট লেখক'কে মুখোমুখি দাঁড় করায় দিচ্ছে। যেই কথাগুলো আর পাঁচজন বলতেছে, আপনিও বলতেছেন বা দুনিয়ায় এই কথাগুলো আগেও বলা হয়ে গেছে, তারপরও আপানার নতুনত্ব হচ্ছে যে, একই আলাপ নতুন করে আপনার নিজের ভাষায় তুলে আনা, আপনার সমসাময়িক করে তোলা। তো সমসাময়িক অবস্থার মধ্যে যদি আপনি সত্যিকার কোনো কাজ করে থাকেন, তাহলে সেটা নিয়ে আলোচনা বা সমালোচনা করতে অনেকটাই বাধ্য হয় সমাজ। অনলাইনে সেই সুযোগটা বরং, কিছুটা বড় হইছে বলে আমার মনে হয়। সোসাইটিতে কাজ হচ্ছে কি হচ্ছে না, তার থেকেও বড় ব্যাপার হইলো সোসাইটি অলস! এই সোসাইটিটা হচ্ছে যে, একেবারে মাস পিপলের সোসাইটি নয়। এটা হচ্ছে, চিন্তার সোসাইটি। এই চিন্তার সোসাইটিটা যে প্রচণ্ড রকমের অলস, তার কারণটা বলি, সে খুব দ্রুত ও সহজ একটা চিন্তার পদ্ধতি আবিষ্কার করে নেয় নিজের মধ্যে এবং সেই পদ্ধতির মধ্যে কোনরকম ভাবনা চিন্তার সময় না দিয়েই, অতি দ্রুত সমস্ত কিছুরে সেই চিন্তার গর্তে ফেলে সে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে চায়। এই পদ্ধতিটা খুবই ভুল মনে হইচে। তাকে অবশ্যই তার চিন্তার ভাঙ্গা গড়ার ভেতর দিয়ে সোসাইটির কাছে যেতে হবে। এবং সেইখান থেকেই যা কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ তুলে আনতে হবে। এই যে গুরুত্বপূর্ণ কাজ তুলে নিয়ে আসা, সেটা যেই ব্যক্তি তুলে নিয়ে আসতে পারছে বা পারতেছে, সেই কাজটাই হচ্ছে আসলে কাজ এবং এই সময়েই সেটা আলোচিত বা সমালোচিত হচ্ছে।
বাংলাঃ ওকে, তো, আপনার অ্যা নেক্সট কাজ হচ্ছে গল্পের বই।
জাহিদ জগৎঃ জ্বী।
বাংলাঃ তো কবিতার বই কি আমরা পাবো আদৌ? সামনে এই রকম কোনো পরিকল্পনা আছে কি?
জাহিদ জগৎঃ কবিতার জায়গা (হাসি) আমি, আমি, আমার অনেক বন্ধু আছে, আপনিও আছেন, যারা কবিতা লিখতেছেন! কবিতার জায়গাটা আমি খুবই একেবারে নিজস্ব যাপনের মতো করে, অন্তর্জগত বলে একটা জায়গা আছে, যার সাথে মানুষের প্রতিনিয়ত দেখা করতে হয়, ফিরে আসতে হয় যার কাছে, কথা বলতে হয়, যেহেতু এই জায়গাটা একেবারেই অন্তর্জগতের সাথে নিজস্ব ভাবের লেনদেন! এইক্ষেত্রে হচ্ছে যে, সেইখানে পৃথিবীর অনেক ব্যাপার, অনেক বাস্তবতাই লুকায় পড়ে। সেই লুকানো জায়গাটা আপাতত আমার কাছে লুকানোই থাক!
বাংলাঃ আচ্ছা, তার মানে হচ্ছে আপাতত আপনি কবিতা প্রকাশের দিকে যাচ্ছেন না! (হাসি), আপাতত যাচ্ছেন না!
জাহিদ জগৎঃ জ্বী।
বাংলাঃ আপনার গান শুনেছি বা আপনার গানের লিরিকগুলো পড়েছি, অ্যা যতটুকু বুঝি আমি এই সময়ে লিরিকের আকালে বেশ শক্তিশালী লিরিক আরকি! হ্যাঁ, তো আপনার এই গানগুলো ঠিক কিভাবে, আপনি তো লিরিক লিখছেন, আপনি তো গান গাচ্ছেন না?
জাহিদ জগৎঃ আমি গান গাইতেও জানি না।
বাংলাঃ কিন্তু এটা ঠিক কিভাবে গান হয়ে ওঠে? এর প্রক্রিয়াটা কী আসলে?
জাহিদ জগৎঃ মানে গান হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া সে নিজেই, গান নিজেই একটা প্রক্রিয়া। প্রচুর গান শুনেছি তো আমি, বিশেষ করে প্রচুর সাধুসঙ্গে মানে একেবারে সাধারণ মানুষের যে লৌকিক ধারা, এই লৌকিক ধারার মধ্যে গান হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটা আমার খুব কাছে থেকে দেখা। যার ফলে আমিও এক, আমারও এক লৌকিক যাত্রা আছে। এই লৌকিক যাত্রার ভেতর নিজেই তো বাজি সময় সময়, নিজেই তো গাইতে থাকি ভেতরে ভেতরে। আমার ভেতরেও তো একজন আমারে গান শোনায়। এই যে, ভেতর থেকে যে একটা ভাষাহীন গান শোনায়, আমি মূলত তারেই আমার ভাষায় নিয়ে আসার চেষ্টা করি।
বাংলাঃ আচ্ছা, আমি যেটা বলার চেষ্টা করছি সেটা হলো, ধরা যাক আপনি একটা লিরিক লিখলেন, এখন সেটা আপনি তো আর গাচ্ছেন না, তাহলে ওই লিরিকটা কেউ না কেউ তো গাচ্ছে, তাদের সাথে কম্বিনিশন হয় কিভাবে? তারা আপনার বক্তব্যটা বুঝে কিভাবে? যেমন আপনার যে গানটা ‘গানপোকা’ গেয়েছে, আমি শুনেছি, খুবই ভালো গেয়েছে তারা। আপনাদের ভেতর এই সমন্বয়টা হয় কিভাবে?
জাহিদ জগৎঃ হ্যাঁ, ‘গানপোকা’ আসলে ভালোই গেয়েছে গানটা। আমার তো মাত্র তিনটা গানই গাওয়া হইছে। তো এদের সাথে আমার দহররম মহররম সম্পর্ক। যখন লিরিকটা নেয় গাওয়ার জন্য তার আগে থেকেই একটা বোঝাপড়া, ওঠাবসা ছিলো, এবং শেষ পর্যন্ত ছিলো, এখনো আছে।
বাংলাঃ আপনার সাথে এই আড্ডা দিতে বেশ ভালোই লাগছিলো, কিন্তু আমার মনে হয় অনেক কথা বলে ফেলেছি আমরা, শেষ একটি বিষয় জানতে চাই আপনার কাছে, কবিতার ছন্দ বিষয়ে আপনার ভাবনা কী?
জাহিদ জগৎঃ হ্যাঁ, দেখতে দেখতে অনেক আলাপ আমরা করে ফেললাম! (হাসি) ছন্দের ব্যাপারে আমি যেটা বলতে চাই, আমি আপনাকে আগেই বলেছি, কবিতা হলো মূলত অন্তর্জগতের সাথে নিজস্ব ভাবের লেনদেন, এখন কার ভাবের লেনদেন কার অন্তর্জগতের সাথে কিভাবে হয় এইটা তার নিজস্ব ছন্দের ব্যাপার। এই ব্যাপারে আপনি হার্ট বিটের কথা ভাবতে পারেন, প্রত্যেকটি মানুষের, এমনকি প্রত্যেকটা প্রাণীর হার্টবিট আছে, এখন সবারটা নিশ্চয়ই একই তালে, একই ছন্দে বাজে না। প্রত্যেকের একটা আলাদা গতি আছে, সবারই তার মতো করে সুনির্দিষ্ট নিয়ম আছে, কারওটা এক না, তবুও সবাই কিন্তু বেঁচে আছে। ছন্দ বিষয়টাও ঠিক তাই আমার কাছে।
বাংলাঃ আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জাহিদ জগৎ। সুযোগ হইলে আমরা আরও আড্ডা দিবো।
জাহিদ জগৎঃ নিশ্চয়ই আমরা আবারও আড্ডা দিবো। আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।
**জাহিদ জগৎঃ রাজবাড়ী জেলার কালুখালীতে কোন এক ভাদ্র মাসে জন্ম। বর্ষার পানির উপর বাঁশের মাচায় ভাসতে ভাসতে জন্ম। ভেঙ্গেছেন, গড়েছেন কিন্তু কখনো থামেন নি। একাধারে লিখছেন গল্প, কবিতা, উপন্যাস, গান। নিজেকে দস্যু লেখক দাবী করা জাহিদ জগৎ কাজ করেছেন সিনেমাতেও, সহকারী পরিচালক হিসেবে।
প্রকাশিত বইঃ “অন্নদাস”।