ফাইল ছবি
চীনের ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড (ওবর)’ বাস্তবায়িত হলে তা বিশ্বব্যবস্থার শক্তি কাঠামোয় ঘটাবে পরিবর্তন। আর তাই ওবর’র মোকাবিলা করার জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়ে বাংলা’র সাথে খোলামেলা কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান।
তিন পর্বের ধারাবাহিক সাক্ষাৎকারটির আজ প্রকাশ করা হলো দ্বিতীয় পর্ব। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বাংলা’র নিজস্ব প্রতিবেদক নূর সুমন।
বাংলা : এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ পরিকল্পনার বিরোধিতা করছে, এর কি কারণ থাকতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
ড. তানজীমউদ্দিন খান : যুক্তরাষ্ট্র তো সরাসরিই বলেছে যে, ওবর শুধুমাত্র অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য নয়। ‘এশিয়া ফর দ্য এশিয়ানস্’ এই কথাটা যখন চীন বলেছে, খুব স্বাভাবিকভাবেই এটার মাধ্যমে চীন তো একটা নিজস্ব প্রভাব বলয় তৈরি করতে চাইছে। যেহেতু এর মধ্য দিয়ে চীনের প্রভাব বলয় তৈরি হচ্ছে, সেহেতু বিশ্বব্যবস্থার শক্তি কাঠামোতেও একটা পরিবর্তন সূচিত হচ্ছে। আর এই পরিবর্তন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক যে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শক্তিকাঠামো, তা দুর্বল হয়ে ওঠার এটা একটা লক্ষণ। তাই যুক্তরাষ্ট্র আশঙ্কাগ্রস্ত না হয়ে পারেনা। যুক্তরাষ্ট্রও চেষ্টা করছে ওবর’র বিকল্প কিছু সামনে আনার জন্যে, যাতে চীনের সাথে অন্য রাষ্ট্রগুলো জোটবদ্ধ হতে না পারে।
এর অংশ হিসেবে ২০১৮ সালে আমরা দেখলাম, মার্কিন প্রশাসন কংগ্রেসে বেটার ইউটিলাইজেশন অব ইনভেস্টমেন্টস লিডিং টু ডেভলপমেন্ট (বিইউআইএলডি/BUILD) অ্যাক্ট পাস করে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে এটা এখন আইনে পরিণত হয়েছে। এই আইনের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইন্টারন্যাশনাল ডেভাল্পমেন্ট ফিন্যান্স কর্পোরেশন নামের একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান গঠন করেছে। এই প্রতিষ্ঠান বেসরকারি খাতে ৬০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে চায়, উন্নয়ন খাতে।
শুধু তাই নয়, এশিয়াতে চীনের প্রভাব কমানোর চেষ্টায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরো একটি পদক্ষেপ নিয়েছে। এর নাম হলো এশিয়া রিএসুরেন্স ইনিশিয়েটিভ অ্যাক্ট বা এরিয়া(ARIA)। এটা হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ ও সিনেটে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে পাস হয়েছে। এই আইনের আওতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগামী পাঁচ বছর ভারত-প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবিলায় জাতীয় নিরাপত্তার জন্যে গড়ে ১.৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে পারবে। এগুলো থেকে প্রতীয়মান হয়- চীনকে ঘিরে তাদের যেমন রয়েছে সামরিক কৌশলগত উদ্বেগ, তেমনি রয়েছে অর্থনৈতিক স্বার্থকে ঘিরে অনিশ্চয়তা। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেশি দুশ্চিন্তায় পড়েছে তার বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর ক্রমান্বয়ে চীনমুখী হওয়ার প্রবণতাকে নিয়ে।
বাংলা : চীনের এই পরিকল্পনার ফলে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভূ-রাজনীতি ও অর্থনীতিতে কি কি প্রভাব ফেলছে বা আগামীতে ফেলতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
ড. তানজীমউদ্দিন খান : এটাতো ভূ-রাজনীতিতে একটা বড় ধরনের পরিবর্তন আনবে নিশ্চিতভাবে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন বাস্তবায়িত হলে। কেননা চীনকেন্দ্রিক যোগাযোগ সংযুক্তি আর অবকাঠামোগত উন্নয়ন এই অঞ্চলের ভৌত ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যেও অনেক পরিবর্তন নিয়ে আসবে আর এতে ভূ-রাজনীতিতেও নতুন নতুন মাত্রা যোগ হবে নিশ্চিতভাবে। আমরা যদি ওবর’র পথরেখা দেখি তাহলে দেখবো, সেগুলোতে অনেক সংঘাতপূর্ণ অঞ্চল আছে। ভারতের জন্য বিশেষ করে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে অরুণাচল ও লাদাঘকে নিয়ে। ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধের সময় এই অঞ্চলে সীমান্তগত কিছু অমীমাংসিত বিষয় থেকে গিয়েছিলো। এর পরিপ্রেক্ষিতে, ভারত আশঙ্কাগ্রস্ত যে, এই ধরনের অবকাঠামো নির্মাণের ফলে বিরোধপূর্ণ অঞ্চলে ভারতের যে সার্বভৌমত্বের দাবি, তা আর বিরাজ করবে কিনা শেষ পর্যন্ত।
অন্যদিকে ওবর’র যে মেরিটাইম সিল্ক রোড, তা একেবারে আফ্রিকার মধ্য দিয়ে ইউরোপের সাথে এশিয়ার বাণিজ্য পথ সংযুক্তি ও সম্প্রসারণের একটা প্রচেষ্টা। এর মাধ্যমে চীন তার নিজস্ব সামুদ্রিক অঞ্চলের বাইরেও তার আধিপত্য বিস্তার করতে চাইছে। বিশেষ করে ভারত মহাসাগর সংলগ্ন জিবুতিতে চীনের সামরিক নৌঘাঁটি সেটাই নির্দেশ করে। আবার থাইল্যান্ডের ক্রা খালটাও চীন খনন করতে সক্ষম হলে তা চীনকে সামুদ্রিক পথে সামরিক কৌশলগত সুবিধাও দিবে। তাই সমুদ্রের বা মহাসাগরের উপর আধিপত্য চীনের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে আরো নিরাপদ করবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ক্রমান্বয়ে ‘সুপারপাওয়ার’ হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সাথে সাথে সমুদ্র অঞ্চলেও মার্কিন নৌবাহিনী ব্রিটেনের আধিপত্যের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। সমুদ্রে আধিপত্য বিস্তারের এই প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে চীনকে ঘিরে নতুন বাস্তবতা যে অপেক্ষা করছে, সেটা বুঝাটা খুব সহজ। তাই চীনের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক প্রভাব বলয় বিস্তারের সাথে সাথে তার সমুদ্র অঞ্চলে শক্তিশালী হয়ে ওঠার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। অনেকেই মনে করছেন, ওই প্রবণতারই একটা প্রতিষ্ঠানিক কাঠামো মেরিটাইম সিল্ক রোড। যদিও চীন এটা দাবি করে থাকে তাদের এসব কিছুই শান্তিপূর্ণ উন্নয়ন বা ‘পিসফুল ডেভাল্পমেন্ট’। তারা তাত্ত্বিকভাবে প্রচার করে- এই ধরনের যোগাযোগ সংযুক্তি ও পারস্পরিকভাবে নির্ভরশীল ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্পর্ক রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনাকে কমাবে। এতে পৃথিবীটা আরো শান্তিময় হবে।
বাংলা : বাংলাদেশ চীনের ‘ওয়ান বেল্ট,ওয়ান রোড (ওবর)’কে স্বাগত জানিয়ে এতে অংশগ্রহণ করেছে। এর থেকে আমারা কতটুকু লাভবান হতে পারবো?
ড. তানজীমউদ্দিন খান : এখনকার অর্থনৈতিক বাস্তবতায় চীনকে উপেক্ষা করার অবস্থা আসলে কারোরই নেই, যেটা আমি শুরুতেই বলছিলাম। জাপানও চেষ্টা করছে যে ভারতের সাথে একটা ঐক্য তৈরি করার- বিশেষ করে ভারত মহাসাগরে চীনের আধিপত্যকে মোকাবেলা করার জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চীনের প্রভাব বলয়কে উপেক্ষা করা যাবে কিনা সেটা তো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। চীনের অর্থনৈতিক শক্তি তৈরি হয়েছে, তার উদ্বৃত্ত মূলধন রয়েছে। কারেন্ট একাউন্টে এই বছরের দ্বিতীয় ভাগে তাদের উদ্বৃত্ত ছিলো ৩১৪ বিলিয়ন আরএমবি যা ডলারে ৪৪.৬৫ বিলিয়ন। এই উদ্বৃত্ত মূলধন তো তাকে বিনিয়োগ করতে হবে।
আর অন্যদিকে বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রের তো বড় চেষ্টা হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা। সেই ক্ষেত্রে চীন বাংলাদেশের জন্য খুবই প্রত্যাশিত। তাই এই বাস্তবতায় চীনকে উপেক্ষা করার সামর্থ্য আসলে বাংলাদেশের নেই। বাংলাদেশে শি জিন পিং’র সফরকালীন ২০ বিলিয়ন ডলারের ২৭টি প্রকল্প সংক্রান্ত চুক্তি দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছিলো। শুধু তো বাংলাদেশ নয়, আনুষ্ঠানিকভাবে ৭০টা দেশ ওবর’র সাথে যুক্ত হচ্ছে। ফলে এই বাস্তবতায় আসলে চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পৃক্ত হওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই।
আবার দক্ষিণ এশিয়াতে প্রভাব বিস্তারে চীন-ভারত প্রতিযোগিতার বাস্তবতা রয়েছে। যেমনি রয়েছে সামরিক কৌশলগত প্রতিযোগিতা তেমনি অর্থনৈতিক স্বার্থকে ঘিরে প্রতিযোগিতা। এখন বাংলাদেশ কিভাবে লাভবান হবে সেটা নির্ভর করবে, চীন-ভারতের মধ্যে বিরাজমান এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধকে বাংলাদেশ কিভাবে নিজের স্বার্থে কাজে লাগাবে। আর আঞ্চলিক পর্যায়ে এই ধরনের স্নায়ুযুদ্ধের সুবিধা-অসুবিধা দুটো দিকই আছে। কূটনৈতিক দরকষাকষির জন্য এখন ভারত কার্ড ও চীন কার্ড – দুটো কার্ডই রয়েছে। এই দুই কার্ড নিয়ে কূটনৈতিক দরকষাকষির একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে মালদ্বীপ, নেপাল আর শ্রীলংকার মধ্যে এই প্রবণতা প্রকট হয়ে উঠেছে। তবে এটা ঠিক মতাদর্শবিহীন এই স্নায়ুযুদ্ধ বাংলাদেশকে দুই দেশের তরফ থেকেই আবার চাপের মধ্যে রাখছে।
এখন আঞ্চলিক পর্যায়ের এই স্নায়ুযুদ্ধের সুবিধাটা আমরা কিভাবে নিব এবং নিজেদের সুবিধাটা কিভাবে নিশ্চিত করতে পারবো, তা আসলে নির্ভর করবে চীন-ভারতের সাথে কূটনৈতিক তৎপরতায় আমরা দরকষাকষিটা কিভাবে করছি। এদিকে অন্য আরেকটা ঝুঁকি হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের তো এক ধরনের প্রভাব সবসময়ই ছিলো, বিশেষ করে ঐতিহ্যগতভাবে বর্তমানের ক্ষমতাসীন দলের সাথে। আর এখন চীনও দক্ষিণ এশিয়াতে নতুন প্রভাব বলয় তৈরি করার ক্ষেত্রে আগের চাইতে অনেক বেশি সক্রিয়। এর একটা নিদর্শনও আমরা দেখেছি বাংলাদেশের রাজনীতিকে ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ে, যা আগে ওভাবে অতীতে দেখা যায়নি। ২০১৮ সালের ‘বিতর্কিত’ জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার জন্যে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে গিয়ে চীনের রাষ্ট্রদূত অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।
এটার কিন্তু প্রতীকী গুরুত্ব রয়েছে এবং খুবই কৌতুহলোদ্দীপক ব্যাপার। কেননা, কোনো দেশের খুব অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে সরাসরি কোনো মনোভাব প্রকাশের প্রবণতা সাধারণত চীন দেখায় না। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে উল্টোটাই আমরা দেখলাম। অর্থাৎ চীন-ভারত উভয়ই এখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির গতিবিধি নির্ধারণে অনেক সক্রিয়। এখন যেই ক্ষমতায় থাকুক না কেনো, খুব গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, চীন-ভারতকে তারা কিভাবে ম্যানেজ করছেন। আর চীন-ভারতকে ম্যানেজ করার উপর আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ভাগ্য বোধহয় নির্ধারিত হচ্ছে। ফলে চীন-ভারতের আঞ্চলিক পর্যায়ে ‘স্নায়ুযুদ্ধ’ যেমন আমাদের কখনো কখনো সুবিধা তৈরি করেছে, আবার কখনো কখনো অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রেক্ষাপটে আমাদের জন্য অনেক চাপও তৈরি করছে।
বাংলা : কি ধরনের চাপ? যদি দুই-একটা উদাহরণ দেন।
ড. তানজীমউদ্দিন খান : এটা তো খুব জানা কথা। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে বিনিয়োগকে ঘিরে চীন-ভারতের মধ্যে যে টানাহেঁচড়াটা, তাতেই বুঝা যায় আমরা কি রকম চাপে পড়েছিলাম। যদিও শেষ পর্যন্ত চীনই বিনিয়োগের সুযোগ পায়। এছাড়াও চীন থেকে ২০১৬ সালে দুটি সাবমেরিন কেনার পর ভারতের নীতিনির্ধারণী মহলের যে প্রতিক্রিয়া, সেটা থেকেই বোঝা যায়। চীনের দিকে বাংলাদেশ যদি একটু হেলে যায়, সেটা ভারতের জন্য কতটা স্পর্শকাতরতা তৈরি করে- সাবমেরিন ক্রয়ের খবর প্রকাশের দুই সপ্তাহের মধ্যেই ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পরিকর আর ভারতীয় সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াতের বাংলাদেশ সফর দিয়ে বুঝা গেছে তারা কতটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলো! ভারতীয় অনেক নিরাপত্তা বিশ্লেষকও সেই সময় ‘ক্রোধান্বিত’ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় নৌবাহিনীর প্রধান অরুণ প্রকাশ। তিনি এই সাবমেরিন কেনার বিষয়টিকে বাংলাদেশ সরকারের একটা ‘উস্কানি কর্ম’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন।