ফ্যামিলি কিংডমের প্রতিষ্ঠাতা ও রিলেশনশিপ কাউন্সেলর মোঃ রামিজুর রহমান খান
ঢাকা শহরে প্রতি ঘন্টায় একের অধিক বিবাহ বিচ্ছেদ হচ্ছে, গত ১২-১৫ বছরে শুধুমাত্র ঢাকায় ৫০,০০০ বিবাহ বিচ্ছেদ এর আবেদন জমা পড়েছে। পারিবারিক বন্ধনের এই নাজুক অবস্থার অবনতি রুখে দাঁড়াতে ও স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক সমুন্নত করে ডিভোর্স রেট কমাতে দেশে এই প্রথম ভিন্ন আঙ্গিকে চালু হয়েছে ফ্যামিলি হ্যাপিনেস কনসালটেন্সি সেবা “ফ্যামিলি কিংডম”।
কথা হলো ফ্যামিলি কিংডমের প্রতিষ্ঠাতা ও রিলেশনশিপ কাউন্সেলর মোঃ রামিজুর রহমান খান এর সাথে। জেনে নিন তার পরিকল্পনা, উদ্দেশ্য ও বৃহৎ সেবা পরিচালনার কৌশল সমূহ।
প্রশ্ন: ১২ বছরের কর্পোরেট ক্যারিয়ার ছেড়ে ফ্যামিলি হ্যাপিনেস নিয়ে কাজ শুরু, পেছনের গল্পটা কী?
মোঃ রামিজুর রহমান খানঃ আমি কাজ করতাম সেলস এন্ড বিজনেজ ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্টে। কাজের কারণে কাস্টমার, পার্টনার, সাপ্লায়ার বা ইন্ডাস্ট্রি কলিগ- সবার সাথে একটা আন্তরিক রিলেশনশিপ বজায় থাকতো। যাদের সাথে একটু বেশি ফ্রেন্ডলি সম্পর্ক হতো তারা তাদের ফ্যামিলির অনেক প্রব্লেম শেয়ার করতো, আমি মন দিয়ে শুনতাম, প্রশ্ন করতাম, মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলু বোঝার চেষ্টা করতাম, নিজের দাম্পত্য জীবনের সাথে মিলিয়ে অনেক কিছুর সমাধান খুঁজতাম।
সমাধান খুজে বের করার ব্যাপারে আমার একটা কৌতূহল তৈরি হয়ে যায়, এটা ২০১২ এর শুরুর দিকের ঘটনা, তখন থেকেই ফ্যামিলি লাইফের উপর নানা ধরনের পড়াশোনা শুরু করি, স্কলারদের লেকচার শুনি, বই পড়ি, বড়দের সাথে আলোচনা করি ইত্যাদি।
পড়াশোনা থেকে প্রাপ্ত সমাধানগুলো আমার দাম্পত্য জীবনে এপ্লাই করি এবং অবাক হয়ে দেখি যে, আমার নিজের ফ্যামিলি হ্যাপিনেস অনেক বাড়তে শুরু করেছে, আমার ওয়াইফের সাথে আগের চেয়ে অনেক বেশি সিংক হচ্ছে, ছোট খাট কনফ্লিক্ট প্রায় উধাও হতে শুরু করেছে।
এরপর থেকে মানুষের ফ্যামিলি লাইফে হেল্প করাটা একটা পেশনে পরিনত হয়। ২০১৩ সাল থেকে ভলেন্টারিলি ফ্রেন্ডস, কলিগ বা রিলেটিভদেরকে টুক-টাক কাউন্সেলিং করতাম, চাইতাম সবাই যেন আমাদের মত ফ্যামিলি লাইফে ভালো থাকে। গত ৭-৮ বছরের পড়াশোনা থেকে পরামর্শ দিতাম। এটাই হচ্ছে পেছনের গল্প।
প্রশ্ন: ফ্যামিলি হ্যাপিনেস নিয়ে বাংলাদেশে কাজ করার সময় এসেছে, কীভাবে আপনি এটা বুঝতে পারলেন?
মোঃ রামিজুর রহমান খানঃ পরিবার ও সামাজিক পরিবর্তন নিয়ে কিছু রিপোর্ট পরছিলাম যেখানে উঠে এসেছে বাংলাদেশে গত এক যুগে বিবাহ বিচ্ছেদের হার দ্বিগুণ বেড়েছে, এবং স্বামী-স্ত্রী পৃথক থাকার হার তিন গুন বেড়েছে। ২০১২ থেক ২০১৮ পর্যন্ত মোট ৫০,০০০ ডিভোর্স অ্যাপ্লিকেশান জমা পড়েছে শুধু ঢাকায়, মানে প্রতি ১ ঘন্টায় একটি করে। ২০১৮ এর জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ২৫৩২ ডিভোর্স অ্যাপ্লিকেশান জমা পড়েছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে।
ডিভোর্স কারণগুলোর পড়ে দেখলাম বেশির ভাগ ডিভোর্সই ছোট খাট মনোমালিন্য থেকে শুরু হয়, সেগুলো শুরুতেই সমাধান না করে যে যার মত চলতে চলতে এক সময় ডিভোর্সের দিকে গড়াচ্ছে।
তখন আমার খারাপ লাগল যে, দুইটা শিক্ষিত মানুষ একটু চেষ্টা করে যদি মানসিকতার উন্নয়ন ঘটাতো, তাহলেই সংসার টিকিয়ে রাখতে পারতো, সুখে থাকতে পারতো। আমার ফ্রেন্ড ও কলিগদের মধ্যে এরকম বেশ কয়েকটি ঘটনা দেখে ভাবলাম এখনই সময় গুছিয়ে শুরু করার। একটা শর্ট ফিসিবিলিটি স্টাডি করলাম, তারপর নেমে পড়লাম ফ্যামিলি কিংডম নিয়ে।
প্রশ্ন: ফ্যামিলি কিংডমের সার্ভিসগুলো কী কী? কোন এইজ গ্রূপের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে?
মোঃ রামিজুর রহমান খানঃ ফ্যামিলি কিংডমের পাঁচটি সার্ভিস-
১) ফ্যামিলি হ্যাপিনেস বিষয়ে দম্পতিদের জন্য ওয়ার্কশপ (হাফ ডে)
২) বিয়ের আগে বর কনের মানসিক প্রস্তুতির উপর মাস্টারক্লাস (হাফ ডে)
৩) পজিটিভ প্যারেন্টিং ও বয়স্ক পিতা মাতার কেয়ারিং নিয়ে মাস্টারক্লাস (হাফ ডে)
৪) কর্পোরেট ট্রেনিং- ফ্যামিলি হ্যাপিনেসের মাধ্যমে পারফরম্যান্স উন্নয়ন (হাফ ডে)
৫) প্রাইভেট কাউন্সেলিং সেশনস
এই সার্ভিসগুলো ডিজাইন করা হয়েছে ২০-৪৫ বছর বয়সী বিবাহিত/অবিবাহিত নারী পুরুষের জন্য
প্রশ্ন: এখন কী কী ধরনের প্রোগ্রম নিয়ে কাজ করছেন?
মোঃ রামিজুর রহমান খানঃ এই মুহুর্তে আমরা দুইটি প্রোগ্রাম নিয়ে কাজ করছি-
১) ফ্যামিলি হ্যাপিনেস বিষয়ে দম্পতিদের জন্য ওয়ার্কশপ (হাফ ডে, জানুয়ারী ১৮, ২০২০)
২) বিয়ের আগে বর-কনের মানসিক প্রস্তুতির মাস্টারক্লাস (হাফ ডে, জানুয়ারী ১৮, ২০২০)
প্রশ্ন: বাংলাদেশ আইটি ইন্ডাস্ট্রিতে প্রায় ১২ বছরের ক্যারিয়ার, কোথায় কোথায় কাজ করেছেন?
মোঃ রামিজুর রহমান খানঃ আমি ২০০৮ সাল থেকে ২০১৯ পর্যন্ত আইটি ইন্ডাস্ট্রিতে, কাজ করেছি মুলতো চারটি প্রতিষ্ঠানে-
১) হুয়াওয়ে টেকনোলোজিস
২) রিভ সিস্টেমস লিমিটেড
৩) লীডস কর্পোরেশনস লিমিটেড
৪) ভ্যালু প্লাস কম্পিউটার সিস্টেমস
প্রশ্ন: নতুন এই ক্যারিয়ারে আসার জন্য কী কী প্রস্তুতি নিতে হয়েছে?
মোঃ রামিজুর রহমান খানঃ অনেক প্রস্তুতি নিতে হয়েছে, যেমন-
১) বিবাহিত জীবন নিয়ে পড়ালেখা, রিলেশনশিপ কাউন্সেলিং নিয়ে অনলাইন ডিপ্লোমা করেছি
২) চাইল্ড সাইকোলজি ও ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে বেশ কয়েকটি অনলাইন কোর্স করেছি
৩) মার্কেট ফিজিবিলিটি স্টাডি করতে হয়েছে, অনেক মানুষের সাথে পরিক্ষামুলক কাউন্সেলিং করতে হয়েছে
৪) গ্লোবাল স্কলারদের লেকচার শুনছি প্রতিনিয়ত
৫) পারিবারিক সম্পর্ক নিয়ে নানান ধরনের রিসার্চ, পরিসংখ্যান ও রিপোর্ট দেখা
৬) ওয়ার্কশপের/ট্রেনিং এর মডিউল ও মার্কেটিং কন্টেন্ট তৈরি করা, আপগ্রেড করা
৭) তাছাড়া বিনিয়োগ ও প্রাতিষ্ঠানিক কাজ গুছানোতো আছেই
প্রশ্ন: ফ্যামিলি কিংডম নিয়ে আপনার ভিশনটা কী? কী লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছেন?
মোঃ রামিজুর রহমান খানঃ তিনটি ভিশন:
১) পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, হ্যাপিনেস বৃদ্ধির মাধ্যমে বন্ধনকে আবার শক্তিশালী করা
২) গত ১০ বছরে ডিভোর্স রেট ৩% থেকে বেড়ে ৬% হয়েছে, এটাকে কমানো
৩) ফ্যামিলিতে বয়স্ক বাবা-মার সঠিক গুরুত্ব বুঝিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো থেকে মানুষকে বিরত রাখা
প্রশ্ন: আপনার মতে কোন তিনটি বিষয় খেয়ার রাখলে স্বামী-স্ত্রী সুখে শান্তিতে জীবন পাড়ি দিতে পারবে?
মোঃ রামিজুর রহমান খানঃ বিষয়টা সহজ বটে। একটু চেষ্টা করলেই তা করা সম্ভব।
১) ভালোবাসার সাথে পাশাপাশি পারস্পরিক মায়া-মমতা্ ও শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে সংসার করা
২) রাগর সময় চুপ থেকে মাথা ঠান্ডা হওার পর কথা বলা, একজন রেগে গেলে আরেকজন চুপ হয়ে যাওয়া
৩) ‘আমি কী পেলাম’ মনোভাব বাদ দিয়ে ‘আমি কী দিতে পারলাম’ এই মনোভাব রাখা