অলংকরণঃ মুরশিদুল মোকাররাবীন
ফেরা
ব্যালকনিতে আসছি সিগারেট টানতে। দেখি,গলির ওপরের গুচ্ছ গুচ্ছ তারের একটায় বসি আছেন এক চড়াইনি। পাশে অস্থির ওড়াউড়ি করতেছেন চড়াই মশাই। কয়েক সেকেন্ড বাদেই উনি চড়াইনিতে উপগত হইলেন। সেও কয়েক সেকেন্ডের মতো। উড়ি বিঘত দুই দূরে গেলেন। ফিরি আসি আবার উপগত হইলেন। আবার কয়েক সেকেন্ড। আবার উড়ি গেলেন। ফিরলেন,উপগত হইলেন এবং উড়ি গেলেন; এবং...! এগারো বারের মতোন ঠায় বসি এই মধুর উৎপাত সহ্য করি চড়াইনি উড়ি গেলেন। এর মদ্দে আমি সিগারেটে মোটে আড়াইখানা টান দিতে পারছিলাম। আর চায়ে তিনখানা চুমুক।
চাপাতা আসছে সিলেট থাকি। বাজারি না। খাইতেছিও নয়া তরিকায়। একরকম ঠেলায় পড়িই আবিষ্কার করছি এই তরিকা। চায়ের হাঁড়ি নাই। দুধ গরম করবার যে হাঁড়ি আছে তাতে চা জ্বাল দিলে ক্যাচাল হয়। ফলে জাস্ট পানিটা গরম করি মগে নিতেছি। পরে চাপাতি ঢালি চামচে ঘুঁটা দিই। একটু থিতায় আসলে পরে চুমুক দিই। নো চিনি অর মশলা এটসেটরা। চায়ে চমৎকার সুঘ্রাণ আসে। শুদ্ধ চায়েরই। মন্দ লাগে না সেইটা।
ননস্মোকারদের এই বাসায় ঘরে সিগারেট টানা যায় না। ফলে,প্রতিবার সিগারেট টানতে হইলে ব্যালকনিতে চলি আসি। সবদিক থাকিই একটু মুশকিলেই পড়া গেছে। রক্ষা এই যে এইসব মুশকিলের দিন শীঘ্রই ফুরায়া আসতেছে।
সে কথায় পরে আসি। চড়াই দম্পতিরে নিয়া আলাপটা সারি আগে।
কাম-বুভুক্ষু কারও পক্ষে প্রকাশ্য দিবালোকে এই সঙ্গমের দৃশ্য হজম করা কঠিন। তারপরও যদি থাকে বুড়ার অত্যাচার। বুড়া কে? আচ্ছা,আচ্ছা। আপনার তারে তো চিনবার কথা না এমনে আসলে। পরিচয় করায় দেওয়া দরকার আছিলো। এই বুড়া সবার সাথে থাকেন। উনার কাম হইতেছে লোকেরে বিনিমাগনা সিনেমা দ্যাখানি। উনার হল লাগে না,স্ক্রিন লাগে না,নির্দিষ্ট শো টাইম লাগে না—অলমোস্ট কিছুই লাগে না। যেহেতু উনি যে সিনেমা দ্যাখান সেটির দর্শক কেবল আপনিই। যেকোনো উসকানিতে উনি আপনারে সিনেমা দ্যাখাইতে থাকবেন। সরসর করি পাস করতে থাকবে দৃশ্যের পর দৃশ্য! ও হ্যাঁ,যেইসব দৃশ্যের ভেতর সাঁতরায়ে উজানে আসছেন আপনি সেইসব দৃশ্যই। বুড়াটির কাম হইতেছে আপনারে ভাটিতে নিয়া গিয়া ফেলা। আর আপনি দুঃস্বপ্নে যেরকম ঘামতে থাকেন,ওরকম ঘামতে ঘামতে সাঁতরায়ে উজাইতে চাবেন। প্রতি পল,নিমেষে!
চড়াই-চড়াইনির ঘটনায় সিনেমা-বুড়া এরকমই এক ভাটিতে নিয়া ফেললো আমারে। সেইখানে অত্যন্ত বিপর্যস্ত দশায় আমি। শুরুর অল্প টাইমের ভিতরেই ফুরায়া যাইতেছি। ফের ট্রাই দিতেছি। ফের ফুরাইতেছি। রাগ,জেদ আর অসহায়ত্ব নিয়া জেরবার দশা। এমতাবস্থায় তিন্নি আমার কানে ফিসফিস করতেছে— চড়ুইটা আমার!
বিপর্যস্ত দশা-ই তো এইটা। যদিও গলায় আদর নিয়া বলতেছে তিন্নি।
বাসাটা সকাল সকালই ফাঁকা হইয়া যায়। সারাদিন একা থাকি ঘরে। দুপুরে একবার খালা আসেন। খোঁজ নেন। কোনো কোনো দিন উনি রান্দেন। ম্যাক্সিমাম দিনই নিজেই রান্দি। উনার আসলে দুপুরে রান্দার কথা না। সকালে রুটি আর একটা ভাজি,যেইটা সাধারণত পেঁপে হইয়া থাকে— অত্যন্ত অপছন্দের আমার,করেন উনি;রাইতে পুরা দস্তর রান্দা হয়। রাইত বলতে সন্ধ্যা আসলে। অই টাইমে অফিস থাকি বাকিরা ফেরেন। ঘরে টিভি চলে। লাগোয়া কিচেনে রান্দনযজ্ঞ। বারোয়ারি বাসা নিজ চরিত্র পায়। মোটামুটি আটটা-নয়টার মদ্দে রান্দা শেষ হয়। টিভিতে আটকায় থাকা লোকজন দশটা-সাড়ে দশটায় খাইতে বসেন। এগারোটার মদ্দে খাওয়ার পাট চুকি যায়। আরও খানিকক্ষণ টিভি চলে। তারপর মশারি টানায়া,বাতি নিভায়া বারোটা অবধি জাগি থাকাথাকি। এক সময় টিভি বন্ধ হয়। লোকেরা ঘুমায় যান সকালে উঠবার তাড়া নিয়া। অ্যালার্ম সেট করাই থাকে সবারই। রেগুলার ব্যাপার।
সকাল নয়টা থাকি সন্ধ্যা ছয়টা-সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত ফাঁকা থাকে বাসা। একদম সুনসান। কদাচিৎ ডোরবেল বাজে। পেপার কি ময়লার বিল চাইতে আসেন পেপারওয়ালা কি ময়লাটানা ভদ্রলোকে। বা দারোয়ান আসেন কলের মিস্তিরিরে সাথে নিয়া।
ব্যস্ত ঢাকা শহর বাইরে গমগম করে।
এরইমদ্দে আমার শুইয়া কাটে সারাদিন। বইপত্র পড়ি টুকটাক। আর মাঝেমদ্দে চা-সিগারেট খাই। সিগারেট ফুরায়া গেলে নিচে নামি। গেইটের কাকার দোকানে যাই। বসি। বড়োজোর একটা সিগারেট টানি বেঞ্চিতে বসি। লোকজনের কথাবার্তা কানে আসে। দুপুর বা বিকালে যারা কাকার দোকানে আসে তারা ন্যাচারালিই স্টুডেন্ট কিংবা সদ্যসাবেক স্টুডেন্ট— চাকরিপ্রার্থী;আশেপাশের মেসবাড়িতে থাকা যুবক। তাদের সংলাপে থাকে ঊর্ধ্বগতির বাসাভাড়া,সিগারেটের ট্যাকা না-জোটার বিপৎসংকেত,সিভি,সার্টিফিকেট— এইসবে ঠাসা। তাদের কেউ কেউ কাকার বাজে চায়ের শেষটা রাস্তায় ফালায়া দিতে দিতে সার্টিফিকেটে মুততে চায়। এ তারে বলে—চায়ের দোকান দিলেও তো পারি,না? কিংবা ড্রাইভিং শিখলাম! সিগারেট ফুঁকতে-ফুঁকতে এইসব শুনি। মনে মনে হাসি। সিগারেট বাটে আসি ঠেকলে আলতো টোকায় ফেলি দিয়া উঠি। কাকারে বলি— আর দুইটা ডার্বি দিয়া তিনটার দাম রাখেন,কাকা!
মার্কেসের গল্প পড়তেছি। একজন নারী একটা ফোন কল করবেন বলি আটকায় গেলেন অ্যাসাইলামে। আর ফেরা হইলো না উনার চেনা দুনিয়ায়। কী এক ট্র্যাপ বলেন!
এমত ট্র্যাপে কি আমিও আটকায় যাইতেছিলাম না,এই শহরে পড়তে আসি! আমিরে বহুবচন হিশাবে বদলায়েও পড়া যায় অনায়াসে। এই বাসার লোকজনের বা কাকার দোকানের যুবকদের কথা মনে পড়লো এই বাবদে।
আচ্ছা,এইসব বাদ। যেহেতু বাদ্দেবো বলি-ই ঢাকা ছাড়তেছি আমি। তার আগে অবশ্য দুইএকটা হিশাব ক্লিয়ার করতে হবে আমার।
তিন্নির কথা তো শুরুতেই বলছি। আরেকজনের সাথেও পরিচয় করায় দেবার আছে। শেলী।
তিন্নির প্রেমিকা চরিত্র নষ্ট হইলো ক্রমে। অধপতিত হইলো সে অলমোস্ট দাম্পত্য করতে গিয়া। জানেনই তো প্রেম সংসারের অথৈ পানিতে ক্যামোন আনাড়ির মতোন সাঁতরায়,হাত-পা ছোঁড়ে বৃথাই। তীরে কি আর উঠতে পারে! খাবি খাইতে থাকে কেবলই।
তিন্নিরে আমি বুঝায়ে উঠতে পারি নাই কেবল শরীর কিংবা দুনিয়াবি সাপোর্ট দিয়া কাম নাই প্রেমিকের। ক্লান্ত লাগে।
শেলীরে যে আসতে বলবো ভিতরে,সে উপায়ও নাই। তারে বাইরে রাখি ফলে। দুইজনই দুইজনের দিকে আগাইতে আগাইতে থামি একসময়। একটা দাগের সামনে। পরে ফিরি যাই। পেছনে তাকাই। দুইজনই। তারপর আর তাকাই না।
বিকালে শেলীর টেক্সট আসলো ফোনে,'আমারে একটা তুমি দ্যাও।'
বাইরে মেঘ জমতেছে। বিষটি নামলো দেখতে দেখতেই। আইজ আর বাইরে যাওয়া হইলো না।
টেক্সটের প্রেম ও ভার মাথায় নিয়া ঘুমায় পড়লাম।
বাসার মা বিলাইটার ডাকাডাকিতে উঠি ব্যালকনিতে গেলাম। বহুক্ষণ থাকি ডাকাডাকি করতেছেন। এরকম করেন না সাধারণত। গিয়া দেখি যথারীতি খাবার নিয়া আসছেন উনি। কিন্তু ছানাগুলির কেউই কাছে আসতেছেন না। খানিক বাদে সিঁড়ির দিকে চলি গেলেন। দুপুরে বাসায় ঢোকার মুখে সিঁড়ির গোঁড়ায় ওনারে বিমর্ষ দশায় বসি থাকতে দেখি আশংকা হইছিলো। দরোজা খুইলা দারোয়ান কাকারে জিজ্ঞাসা করি নিশ্চিত হইলাম। কেউ ছানা দুইটারে নিয়া গেছেন। মা বিলাইটা ডাকাডাকি করি যাইতেছেন এখনো।
এই বিলাই ফ্যামিলি আমার আপন হইয়া উঠতেছিলো। ব্যালকনিতে গেলেই আমি উনাদের পাইতাম। কখনো ছানারা মায়ের দুধ খাইতেন,কখনো মা ল্যাজ নাড়তেন,ছানারা ল্যাজ কামড়াইতেন। আবার কখনো ছানা দুইজনে হুটাপাটি করতেন। আমি জিভে চু-চু শব্দ করলেই টলটলা নীল চোখে বিস্ময় নিয়া তাকায়ে থাকতেন। উনাদের দেখি আনন্দ হইতো আমার। যদিও গ্রীলের খাঁচার ব্যবধান আমাদের দূরে রাখতো। বাসার ভিতরে মা-টি পাস করেন শঙ্কা নিয়াই। ফলে উনার সাথে খাতির তেমন হয় নাই আইজ অব্দি। সম্ভবত এই বিল্ডিংয়ের কোনও মানুষের সাথেই উনার খাতির হইয়া ওঠে নাই।
ছানাগুলি থাকেন একতলার ফালি ছাদে,দোতলার ব্যালকনির তলে‚ নিরাপদ জায়গায়। বেশ চিন্তামুক্ত আছিলাম আমি। অইখানে তো মানুষের যাতায়াত নাই। কিন্তু মানুষ থাকি দুনিয়ায় কে আর নিরাপদ!
অই ছোট্টো ছাদটুকুন জুড়ি আর উনাদের খাইতে,খেলতে,বিস্ময় নিয়া তাকাইতে দেখা যাবে না কখনোই। সেইসাথে এই ফাকিং সিটির নিষ্প্রাণ ফ্ল্যাটবাসার,ব্যালকনির ধাতব গ্রীলে আটকায়ে থাকার পরও যে আনন্দটুকু আছিলো,সেটিও আর ফিরি পাবো না।
মন খারাপ হইয়া গেলো।
মানুষের চাওয়ার কাছে,আমি দেখছি,নিজেরে ছালচামড়া ছিলা গোরু-ছাগলের মতো নিজেরে ঝুলায় রাখে মানুষ। ধরেন,কারও সিনার গোশত— নরোম হাড্ডি সমেত পছন্দ— নিয়া গেলো কেউ;কেউ নিয়া গেলো রান থাকি খালি গোশত— হাড্ডিহীন। কেউ কেউ আবার মাথাটারে নিয়া যাবে,মগজ ভুনায়ে খাবে বলি। কেউ নিয়া যাবে হৃৎপিণ্ড,কলিজা,গুর্দা! ভুঁড়ি কি ঠ্যাং তা-ও পছন্দ কারও কারও। ফেলনা যাবে না ওলান কিংবা অণ্ডও। সেগুলিরও ফরমায়েশ থাকে কসাইয়ের কাছে। একটা আস্ত মানুষ,তার হৃদয়,ইচ্ছা,সামর্থ্য নিয়া বড়ো বিপাকে থাকে। জনমভর। নিজেরে কেবলই গোশতের দোকান থাকি অন্যের পাতের সুস্বাদু ব্যঞ্জন আকারে হাজির করাই দস্তর এইখানে।
ক্লান্তির কথা আগেও বলছি নাকি? না-বলি থাকলে এইখানে বলি রাখি। গোশতের দোকানে অন্যের লোল জিহবা আর ক্ষুধার্ত পাকস্থলীর খাদ্য হইবার লাগি লোকের অপেক্ষা করবার দৃশ্যটির সামনে নিজের আত্মারে নিয়া দাঁড়ায় থাকতে দেখি দেখি সত্যই ক্লান্ত আমি।
এইসব থাকি দূরে যাইতে চাই।
এই যে একটি বিলাই পরিবাররে আমার এমন আপন-স্বজন লাগতেছে,এটাও সেই কারণেই। বিলাইয়ের কাছে আমার বা আমার কাছে বিলাইয়ের গোশতের সম্পর্ক না। কোনওভাবেই না।
বিষটিতে বাসার নিচের গলির বেহাল দশা। ঘরের চুলায় গ্যাসের কণামাত্র সাপ্লাই নাই। এরকমই ঘটে। দ্যাখা গেলো,রাইতে হয়তো রান্দাই হইলো না গ্যাসের অভাবে।
খানিকটা চা পাতা আর চিনি মুখে দিয়া ব্যালকনিতে গেলাম। গলিতে এখন হাঁটুপানি। সখীসমেত এক তরুণী এক হাতে হিল অন্য হাতে পাজামা তুলি হাঁটি যাইতেছেন। এইরকম হাঁটু অব্দি কাপড় উঠায়ে,কোনো কোনো টাইমে হাঁটুর ওপরেও,ডিপেন্ডস অন দ্য হাইট অফ ওয়াটার,কারার দহে নামি সন্ধ্যার মুখে চই চই চই বোলে হাঁসেদের ডাকেন আমাদের গ্রামের হাঁস-পালা নারীকুল। তরুণীর নাকে ধ্যাবড়া এক নাকফুল,মুখে পাউডারের প্রলেপ, চুল টানটান করি বাঁধা,চুলের ক্লিপেও এক ফুল ফুটি আছে দ্যাখা গেলো। এই সখী যুগল তেমাথায় এক রিকশার মুখামুখি হইলেন। রিকশাটি মেইন রোড থাকি আসলো। রিকশার নীল হুডের তলে মাথা নিচু করি বসি আছেন এক তরুণী,বসরাই শাদা গোলাপের মতোন (বসরাই গোলাপ কি শাদাও হয়? উনার গাত্রবর্ণ,মুখের আদল, স্বাস্থ্য দেখি এইরকম মনে হইলো।) তরুণীর গায়ে খাদির শাদা চাদর। বড়ো বড়ো চোখের বড়ো বড়ো কালা গোলক জোড়া পানির দিকে ঝুঁকি আছে। উচ্চতা বেশি বলি হুডের তলে বেশ জড়তা নিয়া বসছেন,পানির তলে গলির বুক যে মসৃণ না,সেইটি মাথায় রাখি সম্ভাব্য ঝাঁকির আশঙ্কাগ্রস্ত,বোঝা যায়।
দুই তরুণীর-ই প্রেমে পড়লাম।
এই এক কাম পারি আমি— প্রেমে পড়তে। জীবনে যে কতো সহস্রবার প্রেমে পড়ছি আমি,একমাত্র খোদাই জানেন। তসবিহ জপার মতোন বহু নাম জপি ডেইলি— একা।
তিন্নি কিংবা শেলীর আগেও নানাজন আসছে এবং গেছে। তাদেরে ধরি রাখা যায় নাই। না,প্রেম ইজন্ট এনাফ। তাদেরও রইছে গোশতের দোকানে দাঁড়ায় থাকবার স্বভাব। আপাত দৃষ্টিতে ধরা পড়ে না। বা সরাসরি না হয়তো। তবে যোগগুণভাগের সরলাংকের বাইরে যে অংক মেলাবার থাকে তাতে ধরা তো পড়েই হাঁ-মুখ,লোল জিহবার বীভৎসতা!
প্রভূত হিশাবনিকাশের প্যাঁচে পড়ি আরও ক্লান্ত হইছি দিনে দিনে। যদিও প্রেম আমারে বাঁচায়া রাখছে। হ্যাঁ, আস্তাকুঁড়ের সামনে দাঁড়ায়ে আমি পঁচতে আরম্ভ করা নাড়িভুঁড়ির গন্ধরে উপেক্ষা করি বুক ভরি ছাতিমের সুঘ্রাণ নিতে চাইছি। পারছিও তা। ফলে কোনও প্যাঁচেই আটকায়ে হাঁসফাঁস করি নাই। বাইর হইয়া গেছি বরাবর।
পৃথিবীতে স্টে করবার কারণ খুঁজি বাইর করাটা টাফ। ক্যানো থাকবো না সেইসব কারণ খুঁজি পাওয়াটা বরং সহজ তুলনামূলক। এই বাবদে কতেক সিদ্ধান্তে পৌঁছাইছি আমি। মানে,যাতে করি 'গুডবাই ক্রুয়েল ওয়ার্ল্ড'না গাইতে হয় আর কি!
সেক্ষেত্রে নারীরে একটা স্কেইপ রুট লাগে। আরও অজস্রবার প্রেমে পড়তে চাই এই কারণেই। ইদানিং ভাতঘুমে তো নানান হাবিজাবি স্বপ্নও দেখতে শুরু করছি। হাইসেন না,প্লিজ।
ধরেন,এ পৃথিবীর কোথাও সে রইয়া গেছে— শ্যামল ও সুন্দর। যারে আঁজলায় তুলি পান করতে পারি। যার অস্ফুট স্বরে ডিফিট করতে পারে শ্রুত তাবৎ ক্যাকোফনি! পারে নাকি?
যেমন,আম্মারে ফোন দিলেই শুনি কোনও বসন্তবৌরি ডাকতেছেন— টানা। আমি জানি বছরের অধিকাংশ টাইমেই উনারা কেউ না কেউ ডাকতে থাকেন বাড়িতে। সেই ডাকের তলে চাপা পড়ি যায় আর সব আওয়াজ।
খানিক আগে সখীসমেত যে তরুণী পানিজমা এই গলি পার হইলেন তারে কারারদহের পাড়ে দেখতেছি আমি এক্ষনে। সন্ধ্যামুখে,হাঁটু পানিতে নামি,আমারে ডাকতেছেন— চই চই চই...!
বসরাই গোলাপটিরে উদ্যানের বাইরে দেখবার খায়েশ নাই আমার।
তিন্নির বাবদে যে অভিযোগ দাঁড় করাইতেছি আমি,তারে সরল ও সংক্ষিপ্ত আকার দিলে এরকম দাঁড়ায়— ছুঁইতে না পারা। পাশাপাশি থাকিও কেউ ছুঁইতে পারতেছে না,অথচ নিজেদের সংবেদনশীল দাবিও করতেছে,এইটা খুব করুণ একটা পরিস্থিতি আসলে। বহুবার তারে একথা বলছিও আমি। কিন্তু জানেন তো,ছুঁইবার যে ভাষা তা ইশকুলে শিখানি হয় না!
আপাতত দূরে যাইতেছি তিন্নির থাকি। এই উপায়ে সম্পর্ক মেইনটেইন করবার যে দায়,তার থাকি রেহাই মিলবে অন্তত। যেমন মিলতেছে প্রতিষ্ঠার জোয়াল কান্ধে নেবার দায় থাকিও। এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে।
এই তৃপ্তিও যোগ হইতেছে বাড়ি ফেরার আনন্দের সাথে।
বাকি থাকলো শেলী।
শেলী ও আমার মধ্যবর্তী, সমদূরত্বে, টানা রেখাটা পার হইবার ইচ্ছা বোধ করি কোনও তরফেই নাই। সে আছে কোথাও— এই আরাম নেওয়া যাইতে পারে।
প্রেম মহার্ঘ। কেউ কোথাও তা রাখে আপনার জন্য,এইটাই যথেষ্ট না কি— আরাম নেবার পক্ষে। আমার তো এরকমই লাগে।
সন্ধ্যার মুখে দুইটা টেক্সট লিখলাম। প্রথমটা তিন্নিরে, দ্বিতীয়টা শেলীরে।
টেক্সট ১: 'আপাতত যাইতেছি। ফিরতে হইলে ফিরবো কখনো।'
টেক্সট ২: 'আমারে নেবার হইলে তুমি নিয়াই আছো আসলে।'
টেক্সট দুইটারে প্রকৃতার্থেই এসএমএস বলা যাইতেছে দেখি খুশি হইলাম।
সন্ধ্যা উতরায় গেছে। নিচের গলিতে গান গাইয়া ফিরতেছেন অন্ধ ভিখারীর দল। উনাদের একজন উঁচা স্বরে মূল গানটি গাইতেছেন। বাকিরা ধুয়া ধরতেছেন সমস্বরে। এরকম দলবদ্ধ গান শুনতাম লোকাল ট্রেনের বগিতে ওঠা অন্ধভিখারীদের গলায়। রিকশা আর লোক চলাচল মুখরিত গলিটার চেনা গন্ধ বদলায় গেলো এই করুণগানে।
সহজ-এ বাসের টিকিট করছিলাম টেক্সট দুইটা পাঠাইবার পরপরই। কিছুটা নাটকীয় হইলো ব্যাপারটা।
রাইতের বাসেই ফিরতেছি।
ঘরে।
বায়েজিদ বোস্তামী
কবি ও গল্পকার
প্রকাশিত বইঃ পাপের পুরাণ (কাব্যগ্রন্থ)