জাফরুল নাদিম। ছবি : সংগৃহীত
শহরের ময়লা পরিষ্কারক :
এক ভোরবেলা ময়লা নিতে এসে ময়লাওলা বিষু তিনতলা এক বাড়ির দোতলার বাম পাশের ফ্ল্যাটের ময়লার ঝুড়ি ওঠাতে গিয়ে অকস্মাৎ শিউড়ে খাম্বা হয়ে গেল। ফ্ল্যাটের দরজাটা আধখোলা, গৃহকর্ত্রী মহিলাটি ময়লার ঝুড়ি বের করে দিয়ে দরজার ফাঁকে মুখ রেখে ঝুড়ির ময়লাগুলো ড্রামে রাখার অপেক্ষায় রইলেন।
বিষু ত্রিশ বছর ধরে এ পাড়ায় ময়লা নেয়ার কাজই করছে। একদিন বাদে একদিন প্রতিটা ফ্ল্যাট থেকে ঝুড়ি ভর্তি ময়লা তার সাথে বহন করা বড় ড্রামে ভরে খালি ঝুড়ি রেখে দিয়ে পরের ফ্ল্যাটের দিকে মুখ ঘোরায়। বছরের পর বছর এই একই কাজ করার ফলে প্রতিদিনকার অভ্যাসে তার কাজের গতি বাস্তবিক যত দ্রুত দেখা যায় আসলে তার থেকেও দ্রুত বেগে সে ঝুড়ি থেকে ময়লা তার ড্রামে ফেলতে পারে।
বাহির থেকে দেখা যায় খুব স্বাভাবিক আয়েশি ভঙ্গিতে সে সবচেয়ে উপরতলা থেকে প্রতি ফ্ল্যাটের ময়লা তার সাথে থাকা ড্রামটিতে ভরে নিচতলায় চলে আসে আর তারপর তার ভ্যানগাড়িতে তুলে নেয়। ফলে প্রতিদিনকার অভ্যাস হেতু দক্ষতায় সে এমন গতি লাভ করেছে যে গলির একদম শেষের এই তিনতলা বাড়ির নয়টি ফ্ল্যাটের ময়লা ড্রামে ভরে তারপর ভ্যানে তুলতে তার ত্রিশ থেকে চল্লিশ সেকেন্ডের মত সময় লাগে। এতে তার বাস্তবিক কোন তাড়াহুড়া লাগে না।
ফ্ল্যাটবাড়িতে ঢোকার মিনিট দুয়েক আগে সে তার বাঁশিতে ফু দেয়। তখন তার হাতে একটা বিড়ি জ্বলতে দেখা যায়। বিড়ি খাওয়া শেষ হলে ড্রামটি কাঁধে নিয়ে সব থেকে উপরের তলায় চলে যায়। এই সময়ের মধ্যে গৃহকর্ত্রী কিংবা কাজের বুয়ারা দরজার সামনে ময়লার ঝুড়িটি রেখে দরজা লাগিয়ে দেয়। তারপর ময়লাওলা ঝুড়ি খালি করে চলে গেলে আবার দরজা খুলে ঝুড়িটি ভেতরে নিয়ে নেয়। ফলত এই ত্রিশ বছরে বিষুর সাথে কোন গিন্নি বা বুয়ার বাক্য বিনিময় কিংবা চোখাচোখি হওয়ার মত কোন ঘটনা ঘটা সম্ভব নয়। তবে এ পাড়ার প্রত্যেক ফ্ল্যাটের গৃহিনীরা বিষুর নাম জানে। কিন্তু এটাই তার প্রকৃত নাম কিনা সেটা জানার কোন উপায় নাই। কারণ ময়লা নিতে যেই আসুক সিটি কর্পোরেশনের ময়লার বিলের কাগজে ময়লা পরিষ্কারকের জায়গায় বিষু নামটাই লেখা থাকে। ব্যাপারটা এমন এ পাড়ায় যেই ময়লা নিতে আসুক তার নাম বিষুই হবে।
তবে গত গত ত্রিশ বছর ধরে এ পাড়ায় শুধুমাত্র এই বিষুই ময়লা নিতে এসেছে। আট বছর বয়সে যখন সে তার পিতার স্থলাভিষিক্ত হয় তারপর থেকে একদিনও সে কামাই দেয়নি। ফলে অন্য কোন বিষু এ পাড়ায় এই ত্রিশ বছরে আসেনি, যদিও আত্মপরিচয়ের এই নামটা বিষুও জানে তবুও বিষু নামে আজ ভোর অব্দি কেউ কখনো তাকে ডাকেনি বা ডাকার মত কোন কারণ ঘটেনি।
আজ ভোরে ময়লা দেবার সময় দোতলার ফ্ল্যাটে যে মহিলাটি আধখোলা দরজার ফাঁক দিয়ে মুখখানা বের করে রেখেছিল তার ময়লার ঝুড়িতে সবার উপরে দেখা গেল সাদা খাঁজকাটা একটু মোটা ধরনের কাপড়ে ছোপ ছোপ তাজা রক্ত। সম্ভবত খুব অল্প সময় আগের, সাদা মোটা কাপড়ের টুকরায় লেগে আছে, এখনো জমাট বাঁধে নি। ময়লা বহন করা জীবনে বিষুর কাছে সে যতই তাজা হোক, পরিত্যক্ত রক্ত ময়লার বেশি কিছু মনে হবার কোন কারণ নেই।
হতে পারে এইমাত্রই কারো হাত বা অন্য কোন অঙ্গ কেটে গেলে সে রক্ত এই সাদা কাপড়ে মুছে তারপর ময়লার ঝুড়িতে রেখে দিয়েছে। কিন্তু বিষুর ক্ষেত্রে এতসব ভাবনার অবকাশ নেই। বাঁশি বাজিয়ে যখন সে ফ্ল্যাটের সবচেয়ে উপরের তলায় চলে যায় তারপর থেকে তার ময়লার গাড়ি নিয়ে ময়লা স্তুপ করার জায়গায় যাবার আগ পর্যন্ত সে যা নিতে পারে বা ভাবতেই পারে সে ময়লা ব্যাতীত কিছুই নয়। পঁচা, গলা কিংবা শুকনো ময়লা তার কাছে একই রকম।
এমনকি তার ময়লার ড্রামে জ্যান্ত ইঁদুর, তেলাপোকা বা আধমরা বিড়ালছানা কিংবা সোনাদানা যা কিছুই হোক না কেন সেগুলোকে সে ময়লা ছাড়া আর কিই বা ভাবতে পারে? ময়লা নেবার সময় যাদের সাথে তার হয়ত দেখা হয়ে যায় তৎক্ষণাৎ তাদেরকেও ড্রাম ভর্তি ময়লা ভাবাটাই তার জন্য স্বস্তিদায়ক। কিন্তু দরজার ফাঁক গলে যে মহিলাটি মুখ বের করেছিল তার চোখে আর ময়লার ঝুড়িটিতে সাদা কাপড়ে তাজা লাল রক্তে বিষুকে মুহূর্তের জন্য ময়লাবিহীন বাস্তবতার তীক্ষ্ণ এক বোধ এনে দিল।
ময়লাওলা বিষুর কাছে মহিলার চোখ আর সাদা কাপড়ের রক্তের ছোপ ছোপ দাগ একটা সহজ সম্পর্ক হাজির করে, এই রক্ত ঐ চোখ যার তার শরীর থেকে বইছে। ময়লার ঝুড়ি আর মহিলার চোখের মাঝে বিষুর কাছে একটা বহমান রক্তের সেতু হয়ে ধরা পড়ে যা তাকে তার লব্ধ সব অভিজ্ঞতা থেকে নিবৃত করে, শুধু একটি শব্দই উচ্চারন করার সুযোগ পায়। সে কেবল ‘মা’ বলেই মহিলাটির পায়ের কাছে লুটিয়ে পরে। এরপর আর যা ঘটে তা কিছুই বিষুর মনে পড়ার কথা না। কিন্তু যখন সে নিজেকে একটি নরম বিছানায় মাথার নিচে তুলতুলে বালিশ দেওয়া অবস্থায় আবিষ্কার করল তখন সে প্রথম সুজোগেই বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠে গেল। সে নিজেকে ধিক্কার দিতে শুরু করল যে সে একজন ময়লাওলা হয়ে ময়লার গাড়ি না টেনে কিভাবে নরম তুলতুলে বিছানা এত সময় ধরে শুয়ে থাকে!
সেই মহিলাটি ততক্ষণে আরেকটি প্যাড চেঞ্জ করে এসেছে। সে বিষুর নাম ধরে ডাকল, তারপর তার মুর্ছা যাবার ঘটনাটি এমনভাবে বলল যেন বিষু কিছুটা অভয় লাভ করতে পারে। বিষুকে আরো কিছুক্ষন রেস্ট নিতে বললে, সে অস্বস্তিতে পড়ে গেল এই ভেবে যে কত কাজ না বাকি পেছনে পড়ে আছে, কত কাজ বাকি তার, বাকি মহল্লার ময়লা নিতে হবে, তার তো দাঁড়াবার আর ফুসরত নাই। কিন্তু গৃহিণী মহিলাটি তাকে কিছুতেই এ অবস্থায় বের হতে দিতে না চাওয়ায় নানান রকম কথা বলা আরম্ভ করল।
কিন্তু বিষু তো জীবনে ময়লা ছাড়া আর কিছু চেনেনি, মহিলাটির কুশলাদি জিজ্ঞাসার জবাবে সে কেবল তার ময়লা টানার ভ্যান গাড়িটার বর্ননা দিতে পারে, সেটি এখন কই আছে তা মনে করার চেষ্টাও বিষু করল আর তখনই বুঝতে পারল সে সবকিছু ভুলে যাচ্ছে। নানান রকম আসবাবে সাজানো রুমের ঠিক মাঝখানে যে বিছানায় সে বসা, কানে বাজতেছে গিন্নী মহিলার মিহি কণ্ঠস্বর এগুলো সব মিলে বিষুকে একটা সহজ উপলব্ধি এনে দিল যে এসব কিছুও তো ময়লার মতই সুন্দর। যে মহিলার কথা তার কানে বাজে তাকে মনে হচ্ছে ভিন্ন কিছু, যাকে ময়লার ড্রাম বা ভ্যানগাড়ি কোনকিছুর সাথেই তুলনা করা যায়না, কিন্তু মুখ দিয়ে সে একটি শব্দও উচ্চারণ করতে পারে না।
তার সম্বিত ফিরে পাওয়া বোধ তাকে আটকায়, এমন পরিবেশে মুখ বন্ধ রাখা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। কিন্তু সংজ্ঞাহীন অনেক অনুভূতি নিয়ে ফ্ল্যাটের এই ঘর, এই আসবাব, ঘরের গৃহিনী তাকে প্রলুব্ধ করছে, তার চোখ আর মুখও কিছু শব্দ তৈরি করতে চায় যে শব্দগুলো তার কাছে নতুন কিছুই না কিন্তু সে ওগুলো কোনদিন ব্যবহার করেই দেখেনি তাই সেগুলো এই ঘরের মধ্যেই কোথায় যেন এলোমেলো ছোটাছুটি করছে।
এমন সময় গৃহিণী মহিলাটি বিষুকে আবারও নাম ধরে ডাকলে তার মনে হল সে তো ‘বিষু’ই, কিন্তু তার নাম তো বিষু নয়- এ পাড়ার ময়লাওলার নাম। ফলে সে তার নাম ভুলে গিয়ে নিজেকে বিষুই ভাবতে শুরু করে, যার এতক্ষণে ময়লার ভ্যান নিয়ে সিটি কর্পোরেশনের নির্ধারিত ময়লার স্তূপের কাছে থাকার কথা। এতে তার মনে বিষম কষ্টের ঝড় বয়ে যেতে শুরু করে- সে বিষু নামটা ভুলে যেতে চেষ্টা করে তবে এমন এক পরিবেশে একজন গৃহকর্ত্রীর সামনে মনের নানান অব্যক্ত আকুলিবিকুলি নিয়ে বসে থাকার চাইতে তার কাছে ঝুড়ি থেকে ড্রামে ময়লা ভরা আর ময়লার ভ্যান ঠেলা ঢের স্বস্তির। কিন্তু সামনে বসে থাকা মহিলাটির দিকে চোখ পড়লেই সে যেন নড়াচড়ার শক্তিটুকু হারিয়ে ফেলছে।
এদিকে ঘরের গৃহিণী মহিলাটি স্থান পরিবর্তন করে ময়লাওলার উল্টোদিকে মুখ ফিরিয়ে বসলে স্বভাবসুলভভাবে বেণী করা চুল ঘাড় হয়ে পিঠে এলিয়ে পড়ে। দুজনকেই কিছুক্ষণ এভাবে চুপ করে বসে থাকতে হয়, তবে বিষুর অস্বস্তি মাত্রা ছাড়ায় সবার আগে- প্রথমবারের মত মুখ খুলতে চেষ্টা করে সে, অস্ফুটভাবে তার মুখ থেকে যে শব্দগুলো বের হয় তার কোন অর্থ মহিলাটির বোধগম্য না হওয়ায় সে কেবল ধৈর্য্য ধারণ করার কথাই বলে বিষুর নিকটতম দূরত্বে বসে যা তার কাছে কোন অর্থ তৈরি করে না।
তবে এই সমস্ত ঘটনাবলী বিষুর কার কাছে অতি সামান্য যথার্থতা তৈরি করার মত বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে সমর্থ হয়- নিকট দূরত্বের এই মহিলার সঙ্গম আকাঙ্ক্ষা, নরম বিছানা কিংবা নতুন সৃষ্টি হওয়া অবোধ কোন বাসনা তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। কিন্তু এ সমস্ত কোন ভাবনাই তার মুখে কোন রা এনে দিতে পারে না, ফলে উদ্ভূত আবশ্যিক নীরবতা এই ঘরের গৃহিণীর কাছে মনে হচ্ছিল আকস্মিক পাওয়া- এক ভোরে কোন পুরুষের উপস্থিতিতে এই ধুন্ধুমার নীরব প্রহর গৃহিণীটি প্রাণ ভরে উপভোগ করা কোনভাবেই থামাতে পারছিল না।
ফলে তুমুল উন্মাদনা, অসংখ্য শব্দ এই নারীর কাছেও এসে ফিরে যাচ্ছিল। সে তখন মুখোমুখি ফিরে খাটের কোনে হেলান দিয়ে কেবল নিজের পায়ের আঙুলের দিকে চেয়ে রইল যেন সে কোন ময়লার ড্রামের মধ্যে খুব নিশ্চুপ গুটিসুটি মেরে বসে আছে- অযথা শব্দ যেন এই ময়লাওলার কোনোরূপ বিঘ্ন না ঘটায়। আর ততক্ষণে নিজেকে ফিরে পেতে তীব্র লড়াইরত বিষু একটা উপায়ই খুঁজে বার করতে পারল- কেবল এই ফ্ল্যাটের গৃহিণীটিকে টেনে হিঁচড়ে তার ভ্যানগাড়িতে পূরে যেন সে তার লক্ষ্যের দিকে পৌঁছাতে পারবে।
*গল্পটি বইমেলায় প্রকাশিত লেখকের প্রথম গল্পের বই "সোমত্ত হাওয়া"র অন্তর্ভূক্ত।
জাফরুল নাদিম
গল্পকার
প্রকাশিত বইঃ সোমত্ত হাওয়া (গল্পের বই)
প্রকাশকালঃ একুশে বইমেলা ২০২০