ফাইল ছবি
জাকিয়া খানের ‘আমাদের পাখিরা’ বইটি হাতে পাবার পর মনে পড়লো হুমায়ূন আহমেদের ‘বৃক্ষকথা’ পড়ার অনুভূতি। স্রেফ গাছ-গাছড়া নিয়ে লেখা একটা বই এক বসায় পড়ে ফেলতে পারবো চিন্তা করিনি। পাখি নিয়ে অনেকটা তেমনি ধারায় লেখা ‘আমাদের পাখিরা’, যেটা পড়তেও ছেদ পড়েনি। লেখার ধাঁচ নিয়ে কথা বলার আগে একটি জরুরি কথা বলে নিই। নাহলে বই আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ অংশটি বাদ পড়ে যাবে।
পাখি নিয়ে লিখবার সময় জাকিয়া অদ্ভুত নিজস্বতা যোগ করেছেন। সেটা হলো পাখির পরিচিতির সাথে লোককথার সমন্বয়। ‘ঝগড়াটে শকুন’ বা ‘লাজুক তিতির’ এমন সমন্বয়ের সুসমন্বিত প্রকাশ। আমাদের গ্রামীণ জীবনাচরণের অংশ এটা। রাতে পেঁচা ডাকলে মানুষের শঙ্কিত হতো এক সময়। এখন অবশ্য মানুষ এমনিতেই শঙ্কিত থাকে, শঙ্কার কাল বলে। গ্রাম থেকে শহর সবখানেই মানুষের বসবাস আজ শঙ্কার সাথে।
যাকগে, আসল কথায় আসি। শকুনের সাথে ঝগড়াটে যোগ করে পাখির পরিচয়ের সাথে তাকে নিয়ে গ্রামীন মানুষের ধারণা এবং আমাদের শেকড় দুটোই সামনে এনেছেন জাকিয়া খান। তেমনি লাজুক তিতিরের ক্ষেত্রেও। পাঠককে পাখির পরিচিতির সাথে মনে করিয়ে দেবে লোকজগাথাগুলোকেও। এই বিষয়টা খুবই আলাদা। চিন্তার এমন নিজস্বতা এ ধরণের বইয়ের ক্ষেত্রে সাধারণত চোখে পড়ে না। সে জন্যেই হুমায়ূন আহমেদের ‘বৃক্ষকথা’র ব্যাপারটি তুলেছিলাম।
‘কদম্ব’ মানে কদমের বর্ণনা দিতে গিয়ে হুমায়ূন আহমেদ লিখলেন, ‘শ্রী রাধিকার কৃষ্ণকে নিয়ে লীলাখেলা সবই কদম্ব গাছের নিচে। বলা হয়ে থাকে, কদম ফুলের হালকা সুবাস অদ্ভুত এক নেশা তৈরি করে। পুরুষ ও রমণী এই নেশায় একে অন্যের প্রতি অনেক বেশি আকর্ষণ বোধ করে।’ এই যে, গাছের বর্ণনা দিতে গিয়ে একটা বিশেষ ‘মিথ’কেও মনে করিয়ে দেয়া। আয়ুর্বেদের সাথে সাহিত্যকে মিশিয়ে কদম ফুলের মতন হালকা সুবাসের নেশা তৈরি করা, এক বিরল বিষয়।
এভাবেও যে লেখা যায়, এটা সাহিত্য চিন্তার নিশ্চিত নতুন দিক। বিষয় ভিত্তিক বর্ণনাও যে খটখটে না হয়ে আলাদা সাহিত্য হতে পারে ‘বৃক্ষকথা’ তারই জলজ্যান্ত প্রমান। জাকিয়া খানের ‘আমাদের পাখিরা’ও অনেকটা তাই। বইটি ছোটদের, তার আলোচনায় হুমায়ূন আহমেদের তোলা কৃষ্ণ-রাধার ‘বড়ত্ব’ টেনে আনলাম কেনো, এ প্রশ্নটি উঠতে পারে। এর উত্তর রয়েছে লেখার শেষে।
জাকিয়া খান ‘মেঠো ছাতারে’ নামের পাখিটির বর্ণনা দিতে গিয়ে বলছেন, ‘বাবা, আজ স্কুলে মিস আমাকে “বিপদ সংকেতদাতা” বলেছেন।’ এই যে, গল্পের নেশায় পাখির সাথে পরিচয়ের প্রচেষ্টা এটা এক কথায় চমৎকার। যাদের পাখি নিয়ে এতটা উৎসাহ নেই তারাও যদি বইটি নেড়েচেড়ে দেখতে গিয়ে চোখ বুলান তাহলে নিশ্চিত বইয়ে ঢুকে পড়বেন। আর তাদের পরিচিতিও হয়ে যাবে বেশ কিছু পাখির সাথে। তেমনি ‘ঝগড়াটে শকুন’ এর কথা শুরু হয়েছে লাবিবা’র গল্প দিয়ে। অনেকটা গল্প পড়ার ছলেই মানুষ ঢুকে পড়বে পাখির পরিচিতিতে। সত্যি বলতে পাখি নিয়ে এমন কাজ খুব কম হয়েছে আমাদের দেশে।
জাকিয়া খানের মূল জায়গা সাহিত্য। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য নিয়ে। এর বাইরে পাখিপ্রেম এবং পাখিদের প্রতি মমত্ববোধ থেকেই সম্ভবত ‘আমাদের পাখিরা’ লেখা তার। যদিও বইটির ফ্ল্যাপে এমন কথা লেখা নেই। আর সেখানে লেখা ‘ছোটদের বই’ বলে আমি বইটিকে বয়সের ছকে আটকাতে চাইছি না। জাকিয়ার গল্প এবং লিখনির বোধ্যতায় বড়দেরও যুক্ত না হবার কোনো কারণ নেই। আমি নিজেও যে কারণে বইটিতে ঢুকে পড়েছি। একজন লেখকের সফলতাটা এখানেই। বলয় নির্দিষ্ট করে লিখলেও সেটা বলয়ের বাইরে বেরিয়ে পড়ে। এগিয়ে যায় বৃত্ত ভাঙার দিকে। যেমন ছোটদের বৃত্ত ভেঙেছেন জাকিয়া খান তার ‘আমাদের পাখিরা’তে এবং হয়তো তা নিজের অজান্তেই।
ওহ, শেষ করার আগে ছবিগুলো ও বইয়ের আঙ্গিকের কথা বলতে ভুলে গেছি। পাখির ছবি প্রায় সবগুলোই সুন্দর। সাথে বইয়ের আঙ্গিকও দৃষ্টিনন্দন সেটা অস্বীকারের ইচ্ছা থাকলেও জো নেই।
কাকন রেজা : লেখক ও সাংবাদিক।