ফাইল ছবি
বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশে দ্রুতবেগে ছড়িয়ে পড়ছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। এখন পর্যন্ত এর কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে পারেনি বিজ্ঞানীরা। কিন্তু এ ভাইরাস ঠেকাতে নানা ধরণের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে যেগুলোর অধিকাংশ হয় অপ্রয়োজনীয় নয়তো বিপজ্জনক। যা ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
তবে এসব পরামর্শ কোনো ভিত্তি নেই বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। বিষয়টির ওপর বিজ্ঞানীদের মতামত তুলে ধরে সংবাদ প্রকাশ করেছে বিবিসি।
রসুন :
ফেসবুকে এমন অসংখ্য পোস্ট দেখা গেছে যেখানে লেখা রয়েছে- যদি রসুন খাওয়া যায় তাহলে সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, ‘যদিও রসুন একটা স্বাস্থ্যকর খাবার এবং এটাতে এন্টিমাইক্রোবিয়াল আছে’ কিন্তু এমন কোনো তথ্য প্রমাণ নেই যে রসুন করোনাভাইরাস থেকে মানুষকে রক্ষা করতে পারবে।
অনেক ক্ষেত্রেই এ ধরনের প্রতিকারক ব্যবস্থা মানুষের জন্য ক্ষতিকারক নয়। কিন্তু এটার মাধ্যমেও ক্ষতি হতে পারে। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট’র খবরে বলা হয়, করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে একজন নারী দেড় কেজি কাঁচা রসুন খান। এতে করে তার গলায় ভয়াবহ প্রদাহ শুরু হয়। এরপর ওই নারীকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়।
আমরা জানি ফল, সবজি, এবং পানি খেলে স্বাস্থ্য ভাল থাকে। কিন্তু নির্দিষ্ট কোন খাদ্য দিয়ে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব হবে, এ বিষয়ে এখনো কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
অলৌকিক সমাধান :
জরডান সাথের হলেন একজন ইউটিউবার। বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে তার হাজার হাজার অনুসারী রয়েছে। তিনি দাবি করেন ‘একটা অলৌকিক খনিজ পদার্থ’ যাকে এমএমএস নামে ডাকা হয় সেটা দিয়ে এই করোনাভাইরাস একেবারে দূর করা সম্ভব। এতে ক্লোরিন ডাই-অক্সাইড যেটা একটা ব্লিচিং এজেন্ট। জরডান ও অন্যরা এই পদার্থকে করোনা ছড়িয়ে পড়ার আগে থেকেই প্রচার করে আসছেন।
এর আগে জানুয়ারিতে টুইটে তিনি বলেন, ‘ক্লোরিন ডাই-অক্সাইড ক্যান্সারের কোষকেও ধ্বংস করতে পারে এবং এটা করোনাভাইরাসকে ধ্বংস করতে পারে।’
গত বছর মার্কিন ফুড এন্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রিশন সতর্ক করেন, এমএমএস পান করা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। অন্যান্য দেশের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষও এ বিষয়ে একই সতর্কতা জারি করে।
এফডিএ জানায়, তারা এমন কোনো গবেষণা সম্পর্কে জানে না যে এই পদার্থ নিরাপদ অথবা কোনো অসুস্থতার জন্য পথ্য হতে পারে। এফডিএ সতর্ক করে জানায়, এটা পান করার ফলে, মাথাব্যথা, বমি, ডায়রিয়া, এবং পানিশূন্যতার লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
ঘরে তৈরি জীবাণুনাশক :
করোনাভাইরাস প্রতিরোধের এক কার্যকর উপায় হলো বার বার করে হাত ধোয়া। এতে করে হাত ধোয়ার জেল শেষ হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বর্তমানে চীনের পর ইতালিতে করোনা পরিস্থিতি খুবেই খারাপ। সেখানে এই জেল ফুরিয়ে যাওয়ার খবর শোনা যায়। তখন ঘরে কিভাবে এই জেল বানানো যায় সেটার রেসিপি দেয়া শুরু হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। কিন্তু এই রেসিপি জীবাণুনাশকগুলো মূলত ঘরের মেঝে বা টেবিলের উপরিভাগে ব্যবহার করতে হয়।
কিন্তু বিজ্ঞানীরা জানান, এটা ত্বকের জন্য মোটেই ভালো নয়। অ্যালকোহল যুক্ত হ্যান্ড জেলগুলোতে ৬০%-৭০% অ্যালকোহল থাকে তার সাথে থাকে এমোলিয়েন্ট নামে এক ধরণের পদার্থ যেটা ত্বককে নরম রাখে।
লন্ডন স্কুল অব হাইজিন এন্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক স্যালি ব্লুমফিল্ড জানান, তিনি বিশ্বাস করেন না ঘরে বসে হাতের জন্য উপযুক্ত জীবাণুনাশক তৈরি করা সম্ভব।
রূপার পানি :
কলোইডিয়াল সিলভার মূলত এ ধরনে পানি যেখানে রুপার ক্ষুদ্র কণিকা মেশানো থাকে। মার্কিন টেলি-ইভানজেলিস্ট ধর্মপ্রচারক জিম বেকার এই জল ব্যবহারের পরামর্শ দেন। তার অনুষ্ঠানে এক অতিথি দাবি করেন, এই পানি কয়েক ধরণের করোনাভাইরাস মারতে সক্ষম। অবশ্য তিনি এটাও স্বীকার করেন, কোভিড-১৯’র ওপর এটা পরীক্ষা করে দেখা হয়নি। কলোইডিয়াল সিলভারের সমর্থকদের দাবি, এটা অ্যান্টিসেপটিক এবং নানা ধরনের চিকিৎসায় ব্যবহার করা চলে।
তবে মার্কিন স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানান, এই ধরনের রূপা ব্যবহার করে স্বাস্থ্যের কোনো উপকার হয় না। উল্টো এর ব্যবহারে কিডনির ক্ষতি হতে পারে ও লোকে জ্ঞান হারাতে পারে। লোহা ও জিংক যেমন মানব দেহের জন্য উপকারী, রূপা তেমনটা নয় বলেও জনান।
১৫ মিনিট পর পর পানি খাওয়া :
ফেসবুকের একটি একাউন্টের এক পোস্টে একজন ‘জাপানি ডাক্তার’কে উদ্ধৃত করে বলা হয়, করোনাভাইরাসের জীবাণু মুখের মধ্যে ঢুকে পড়লেও প্রতি ১৫ মিনিট পর পর পানি খেলে তা দেহ থেকে বের হয়ে যায়। এই পোস্টের একটি আরবি ভার্সন ২৫০,০০০ বার শেয়ার হয়েছে।
এ বিষয়ে লন্ডন স্কুল অব হাইজিন এন্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক স্যালি ব্লুমফিল্ড জানান, এই দাবির পক্ষে সত্যিই কোনো প্রমাণ নেই।
তাপমাত্রা ও আইসক্রিম পরিহার :
গরমে করোনাভাইরাস মরে যায় বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক ধরনের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। গরম পানি পান করা, গরম জলে গোসল করা, এমনকি হেয়ারড্রায়ার ব্যবহারেরও সুপারিশ করা হচ্ছে। ইউনিসেফের উদ্ধৃতি দিয়ে এমন একটি পোস্ট নানা দেশে সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করা হচ্ছে।
এখানে বলা হয়, গরম জলপান করলে এবং রৌদ্রের নীচে দাঁড়ালে করোনার জীবাণু মরে যাবে। একই সঙ্গে আইসক্রিম খেতেও বারণ করা হয়।
তবে ইউনিসেফ জানায়, এটা ভুয়া খবর। ফ্লু ভাইরাস মানব দেহের বাইরে বেঁচে থাকতে পারে না। আর দেহের বাইরে এই জীবাণুকে মেরে ফেলতে হলে ন্যূনতম ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা লাগবে, যেটা গোসলের পানি থেকে অনেক বেশি গরম।
বাংলা/এনএস