ছবি : দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেয়া
জিম আল খলিলী
একজন নিয়মিত টুইটার ব্যবহারকারী হিসেবে অনলাইনে আমি কোন মানুষকে বা কোন সংস্থাকে অনুসরণ করব তা সতর্কভাবে নির্বাচন করি। এবং এখানেই একটি সমস্যা লুকিয়ে আছে। সামাজিক গণমাধ্যমে আমরা তাদের সাথেই যুক্ত হই এবং সেই বিষয়বস্তুতেই বিশ্বাস করি যা আমাদের নিজেদের মতের সাথে খাপ খায়, একইভাবে ঐ ধারণাগুলোর মাধ্যমেই পরিতৃপ্ত হই যে ধারণাগুলোর সাথে আমরা পূর্ব থেকেই একমত। এই ধারণাগুলোর কয়েকটির ভিত্তি হলো রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ভাবাদর্শ, অন্যগুলোর ভিত্তি হলো যুক্তিহীন তথ্য এবং একেবারেই ভাসাভাসা ও অনির্ভরযোগ্য তথ্য। এই ধরনের বিরোধপূর্ণ চিন্তা এবং বিশ্বচিন্তার মেরুকরণের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে আমাদের এখন বলতে হচ্ছে- পূর্বের যেকোন সময়ের তুলনায় বেশি পরিমাণে বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানীদের উপর আস্থা রাখুন।
করোনাভাইরাসের সংকটের সময়ে সবাই-ই অনলাইনে ‘বৈজ্ঞানিক’ মত প্রচার করছে। আমরা সবাই আলোচনা করছি ভাইরাসের সদৃশ্য তৈরি নিয়ে, সূচকীয় বা ব্যাখ্যামূলক বক্ররেখা নিয়ে, আক্রান্তের সংখ্যা এবং অ্যান্টিবডি পরীক্ষা নিয়ে; হঠাৎ করে আমরা সবাই মহামারী-সংক্রান্ত বিদ্যা, রোগ-প্রতিরোধ বিদ্যা, এবং ভাইরাস বিদ্যা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছি। যখনই সাধারণ জনগণ শুনতে পায় যে, কোন একটি বৈজ্ঞানিক তথ্য বা অভিমত সরকারি পলিসিতে হঠাৎ কোনো পরিবর্তন আনার জন্য পরামর্শ দিচ্ছে, তখনই সাধারণের প্রবণতা এমন যে তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছে- ‘বিজ্ঞানীরা জানেনা তারা কি করছে সুতরাং তাদেরকে বিশ্বাস করা যাবে না।’
অর্থাৎ এই বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্যটি কোন কাজেই আসে না, কারণ সাংবাদিকেরা বিজ্ঞানীদের প্রশ্ন করার চেয়ে রাজনীতিবিদদেরকে প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে বেশি পটু। এদিকে রাজনীতিবিদরা বৈজ্ঞানিক তথ্য স্পষ্ট ও স্বচ্ছভাবে বুঝাতে আসলেই দুর্বল।
এটা কখনোই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয় যে বিজ্ঞান কোন পথে কাজ করছে (কোন একটি সমস্যা সমাধানে বিজ্ঞানভিত্তিক বিভিন্ন পথে চেষ্টা করা হয়)। রাজনীতিতে যেখানে একটি ভুলকে মেনে নেয়া হলো দুর্বলতার চিত্র আবার বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এটা সম্পূর্ণ বিপরীত। কারণ এখানে ভুল করাই হলো জ্ঞানের ভিত্তি। পুরনো তত্ত্ব ও হাইপোথিসিসকে (বিজ্ঞানভিত্তিক অনুমান) নতুন তত্ত্ব ও হাইপোথিসিস দ্বারা প্রতিস্থাপন করা, তুলনামূলকভাবে অধিক নির্ভুল তত্ত্ব বা হাইপোথিসিস’র মাধ্যমে আমরা কোন একটি বিষয়ে গভীর জানাশোনা অর্জনের দিকে এগিয়ে যাই। ইতিমধ্যে তথ্য ও উপাত্তের ভিত্তিতে আমরা গাণিতিক মডেল উন্নীত করেছি এবং পূর্বানুমান তৈরি করেছি।
এই করোনাভাইরাসটি একেবারে নতুন হওয়ার কারণে আমাদেরকে খুবই সামান্য জ্ঞানের পরিসর থেকে কাজ শুরু করতে হয়েছে। যেহেতু আমাদেরকে এই ভাইরাস সম্পর্কে নতুন উপাত্ত (ডেটা) যোগাড় করতে হচ্ছে সেহেতু আমাদের মডেল এবং পূর্বানুমান ধারাবাহিকভাবে বর্ধিত এবং উন্নত হবে।
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল, কোন একটি নিশ্চিত ধারণার উপর সন্দেহ পোষণ করা। সন্দেহের এই ধারণা গবেষণার ক্ষেত্রে একটি মূল্যবান বিষয়। এই ধারণার সাথে আমরা পরিচিত হই মধ্যযুগীয় বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন থেকে। আরব পণ্ডিত ইবনে আল হাইতান (আল হাজেন) এবং পারস্যের পণ্ডিত আল রাজি -এদের মাধ্যমে।
আরবিতে যে আন্দোলনকে বলে আল-শুকুই (সাধারণ অর্থ-সন্দেহ), এবং যা ওই সময়ে এক হাজার বছর ধরে প্রচলিত প্রাচীন গ্রিক পণ্ডিতদের জ্যোতির্বিদ্যা ও চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ক জ্ঞানকে ভুল প্রমাণ করে।
আল-হাইতান ছিলেন একজন শুরুর দিকের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রবক্তা। যিনি সন্দেহ পোষণ করেন হেলেনিক জ্যোতির্বিদ টলেমির ধারণার উপর। এবং তিনি পরামর্শ দেন যে, আমাদের শুধুমাত্র বিদ্যমান ধারণার উপর সন্দেহ করে প্রশ্ন করা উচিত তা নয় আমাদের উচিত নিজেদের অর্জিত নিজস্ব ধারণাকেও প্রশ্ন করা, এবং বিরোধী তথ্য-প্রমাণের আলোকে বিদ্যমান ও অর্জিত মত বা ধারণাকে পরিবর্তন বা বাতিল করার বিষয়ে প্রস্তুত থাকা।
তিনি হাজার বছরের পুরনো একটি ধারণা ভুল প্রমাণ করেছিলেন সেই ভুল ধারণাটি ছিল ‘আমাদের চোখ থেকে আলো কোন বস্তুর উপর পড়ার পরে আমরা ওই বস্তুকে দেখতে পাই’, এবং আমাদের দর্শনশক্তি কিভাবে কাজ করে এর সঠিক ব্যাখ্যা তিনিই প্রথম দিয়েছিলেন।
এই চিন্তা পদ্ধতি এখনো আমাদেরকে জানান দেয় যে, বিজ্ঞান কিভাবে কাজ করে। আসলেই এখানেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাথে ষড়যন্ত্রবাদীদের অবস্থানের তফাৎ।
ষড়যন্ত্রবাদীরাও বিজ্ঞানীদের মতো সন্দেহ করে; তারাও সন্দেহবাদী, তারা সবকিছুকে প্রশ্ন করে এবং তথ্যের গুরুত্বের মূল্য নির্ধারণ করে। কিন্তু বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আমরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে পারি যে, আমাদের দেয়া তত্ত্ব এবং পৃথিবী সম্পর্কে আমাদের ব্যাখ্যা সঠিক, কিন্তু আমরা কখনোই পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারি না। সবশেষে যদি কোন পর্যবেক্ষণ বা পরীক্ষামূলক ফলাফল সামনে আসে যা আমাদের বর্তমান বিদ্যমান তত্ত্ব বা ব্যাখ্যার সাথে সাংঘর্ষিক হয় তাহলে আমরা অবশ্যই পুরনো প্রজ্ঞা বা জ্ঞানকে ত্যাগ করবো।
খুবই বাস্তব যে, ষড়যন্ত্রবাদীরা বিজ্ঞানীদের থেকে ভিন্ন মেরুতে অবস্থান করে, তারা এমন কিছু তথ্য উপস্থাপন করে যা তাদের মূল বিশ্বাসের সাথে বিরোধপূর্ণ, এবং তথ্যগুলোকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করে যা ওই বিশ্বাসকে অস্বীকার করার পরিবর্তে নিশ্চয়তা প্রদান করে।
প্রায়ই এই ধরনের মতাদর্শগত বিশ্বাসের ক্ষেত্রে, আমরা এই উপমাটি শুনি ‘মানসিক অসঙ্গতি’ যেক্ষেত্রে কোনো একজন আসলেই মানসিক অস্বস্তি অনুভব করে যখন সে ওই তথ্যের মুখোমুখি হয় যা তার ধারণ করা অভিমতের বিরোধিতা করে। এই মানসিক অসঙ্গতি পূর্ব থেকে বিদ্যমান বিশ্বাসকে শক্তিশালী হতে কাজ করতে পারে। একজন ষড়যন্ত্রবাদী তাত্ত্বিককে এই প্রশ্ন করতে পারেন: কী তাদের মনোভাবকে পরিবর্তন করতে পারতো?
যেহেতু তারা তাদের অভিমতের উপর সম্পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তাই সাধারণত তাদের উত্তর হবে: কোনো কিছুই না।
যাইহোক, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আমরা শিখি বা জানি আমাদের ভুল গুলোকে চিনতে এবং আমাদের মনোভাবকে পরিবর্তন করতে যেন পৃথিবী সম্পর্কে নতুন ধারণা পেতে পারি।
বর্তমানে মহামারীতে এই কথাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, পরিষ্কার করে বললে- করোনাভাইরাসের এমন সংকটকালে, ‘এই ভাইরাস সম্পর্কে সকল কিছু জানবো তারপর পদক্ষেপ বা অ্যাকশন নিবো’ এই কথা বলার সুযোগ পৃথিবীর হাতে নেই (আমাদের হাতে যা তথ্য-উপাত্ত আছে তার ওপর দাঁড়িয়েই পদক্ষেপ বা অ্যাকশন নিতে হবে); আবার একই সময়ে এটাও মনে রাখতে হবে যে, বিপরীত বা ভিন্ন নতুন তথ্য পাওয়ার পরেও কোন একটি বিশেষ কৌশলের প্রতি একগুঁয়ে আনুগত্য প্রদর্শন হতে পারে বিরাট সর্বনাশের কারণ। আমাদেরকে অবশ্যই আমাদের কৌশলগত দিক বদলানোর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে যেহেতু আরো উপাত্ত (ডেটা) আমাদের হাতে আসছে এবং আমাদের কাজের মডেল সংক্রান্ত পূর্বানুমান আরো নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠছে। এটাই হলো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির শক্তিশালী দিক, দুর্বলতা নয়।
আমি আমার ক্যারিয়ারকে বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষিত সমাজ গঠনের গুরুত্বের উপর জোর দিয়ে পার করেছি। আমি এটা বলতে চাইছি না যে, প্রত্যেককেই মহাজাগতিক বিজ্ঞান বা কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানে সুদক্ষ হতে হবে বা সকলেই RNA এবং DNA এর তফাৎ বুঝবে। কিন্তু আমাদের সকলেরই নিশ্চিতভাবেই জানা উচিত ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের মধ্যে পার্থক্য কি। আমরা যদি এই বিপদ থেকে বের হতে পারি তাহলে আমরা আরো গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি অবশ্যই জানব তা হলো- ‘বিজ্ঞান কিভাবে কাজ করে’, এবং একটি বিষয় সম্পর্কে অবশ্যই আস্থা অর্জন করবো যে এমন সংকটাপন্ন অবস্থায় নিশ্চয়তা প্রদানের চাইতে সন্দেহকে ধারণ করাটাই হতে পারে শক্তির উৎস।
অনুবাদ : আমিনুল ইসলাম অভি
[জিম আল খলিলী ইরাকি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী। তিনি সারে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। বিবিসি টেলিভিশন ও রেডিও’র বিজ্ঞানবিষয়ক অনুষ্ঠানের উপস্থাপক। সেইসাথে অন্যান্য ব্রিটিশ গণমাধ্যমের বিজ্ঞানবিষয়ক নিয়মিত বক্তা।]
মূল লেখা পড়তে লিঙ্কে ক্লিক করুন
বাংলা/এসএ/