ডা. ফারহানা নীলা। ছবি : সংগৃহীত
ডা. ফারহানা নীলা :
গাজীপুরে এই বৃদ্ধাশ্রমে খইফুল বিবি এসেছেন তাও তো এক বছর হয়ে এলো। প্রথম প্রথম খুব মন খারাপ হতো। একা লাগতো। ভয় করতো ভীষণ। ঘরগুলোতে অনেকগুলো চৌকি। একটু দূরে দূরে পাতা বিছানা। খইফুলের ঘুম আসে না রাতে।
গত বছর রোজায় টিপু আর বৌয়ের কি নিয়ে যে বিবাদ লাগলো! খইফুল তার কিছুই জানে না। মিনি নাম টিপুর বৌয়ের। নামটা খুব পছন্দ খইফুলের। মিনিও খইফুলের সাথে মানিয়ে চলে সুন্দর। মেয়েটা বেশ মায়াবতী।
টিপুর বরাবরই রাগ বেশী। তার বাবাও খুব রাগী ছিলেন। সংসারে খইফুলের সারাজীবনই মানিয়ে চলা আর মেনে চলা। টিপুর বাবার মনে হয় সামন্তবাদের মন মানসিকতা ছিল। পুরুষের আলাদা দেমাগ লাগে, সেটাও ছিল। তার কথার বাইরে গেলেই মুশকিল। তাঁর পছন্দসই না হলেই বিপদ। খইফুল প্রানান্তকর চেষ্টা করতো সংসারে শান্তির পায়রা ওড়াবার। কিন্তু মন পাওয়া হয়নি কখনো।
টিপু এলো সংসারে বিয়ের তিন বছর পর। এরমধ্যেই বাঁঝা নামটা তিলকের মত সেঁটে গেছে কপালে। আগেও দুইবার বাচ্চা নষ্ট হয়ে গেছে যদিও।
এরপর আরো কয়েকবার অন্তঃসত্ত্বা হলেও জীবিত অবস্থায় কেউ আসেনি পৃথিবীতে। চার, পাঁচ মাসেই নষ্ট হয়ে যায় বাচ্চা। টিপুর বাবার সে কি রাগ! হুজুর আনে, পানি পড়া, ঘর বন্ধ... সব চলে। খইফুলের গলায় একগাদা তাবিজ কবচ। বাজুবন্ধ নাই আছে কালো, লাল সুতোয় হাজারটা গিঁট।
টিপুর বাবা গ্রামে নামি-দামি মানুষ। তাঁকে সবাই মান্য করে। অথচ জ্বীন-ভূত তাঁকে কাঁচ কলা দেখায়। খইফুলের আর বাচ্চা হয় না।
ভাগ্য বিড়ম্বনার শেষ নেই খইফুলের। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করার পর খইফুল বোঝা হয়ে যায়। মাত্র তেরো বছর বয়সে চল্লিশ বছরের মানুষটার সাথে বিয়ে হয়। টিপুর বাবার আগের বউ মারা গেছে তখন কেবল। তাঁর কোনো ছেলেপুলে ছিল না।
বিয়ের রাতেই টিপুর বাবা তাকে সন্তানের কথা বলে। খইফুল শোনে আর মনে মনে ভাবে এ কেমন কথা! সবে মাত্র মাসিক শুরু হয়েছে খইফুলের। মাসিকের রক্ত দেখলে তখনো ভয় পায় খইফুল।
টিপুর বাবাকে খুব সম্মান করে খইফুল।খুব সমাদরে রাখে। অতটুকু বয়সে এটা জেনে গিয়েছিল... সংসারে পুরুষদের সমঝে চলতে হয়।
টিপুর বাবা মারা যাবার পর খইফুল একাই বড় করে টিপুকে। অর্থকষ্ট ছিল। ছিল প্রতিবন্ধকতা। এর মাঝেই টিপুকে লেখাপড়ার জন্য তৈরী করে। টিপুর পড়ার খেয়ালটা ভাল ছিল। রেজাল্ট ভাল করায় বৃত্তি পেতো। আর খইফুল ঘরে বসে সেলাই মেশিনের চাকা ঘোরায়। আশপাশের সবার ব্লাউজ, পেটিকোট সেলাই করে। জামা সেলাইয়ের কাজও শিখে নেয়।
স্কুল কলেজ শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পালা এবার টিপুর। টিপু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হয়। হোষ্টেলে থাকে। মাঝেমধ্যে বাড়ীতে আসে। খইফুলের অপেক্ষা শেষ হয় না। টিপুর জন্য এটা ওটা রেঁধে রাখে।
একা একা বড় হওয়ায় বোধ করি টিপুর এই বাড়তি রাগ। একটুতেই সব ছুঁড়ে মারে। খইফুলের মন খারাপ হয়। কিছু বলতে পারে না। ছেলে বড় হয়েছে, এত্ত লেখাপড়া করে..... খইফুল তো ছেলেকেও সম্মান করে!
মিনিকে পছন্দ করেই বিয়ে করলো টিপু। একসাথেই পড়তো দুজন। বিয়েতে তেমন কিছুই করতে পারেনি খইফুল। খুব সাদাসিধা বিয়ে হলো।
তাতেও টিপুর রাগ।
.... শ্বশুর বাড়িতে মান সম্মান থাকলো না মা। তোমার জন্য আমি খাটো হলাম তাদের কাছে। টিপুর কথার উত্তর জানে না খইফুল।
টিপু চাকরি করে, মিনিও চাকরি করে। এখন তারা ঢাকায় থাকে। মিনির বাচ্চা হবে। টিপু একদিন আচমকা গ্রামে গিয়ে খইফুলকে নিয়ে এলো ঢাকায়। টিপুকে কোনো কথা জিজ্ঞেস করার সাহস হয়নি খইফুলের।
এখানে এসে মানিয়ে নিয়েছে খইফুল। মানিয়ে নেওয়া আর মেনে নেওয়াটাই জীবন... জেনে তো গেছে সেই কবেই!
মিনি অফিসে যায়। মেয়েটার অনেক কষ্ট হয়। সারাদিন পর বাসায় ফিরে বমি করে। খইফুল রান্নাবান্না শেষ করে রাখে।
.... মা আপনি এত কষ্ট করেন কেন? মিনির কথায় হাসে খইফুল।
.... আমি তো সারাদিন বাসাতেই থাকি মা। সময়ও কেটে যায়। আমার তো কোনো কষ্ট হয় না!
সেইদিন মিনি মার্কেট থেকে একজোড়া শাড়ী কিনে এনেছে। খইফুল গোসল করে আজ নতুন শাড়ী পড়ে ইফতারের আয়োজন করে।
রাতেরবেলা কি এমন হলো? টিপু সকালেই মা কে ডেকে নিয়ে কথাগুলো বললো।
.... মা শোনো। গাজীপুরে একটা খুব সুন্দর জায়গায় তোমাকে নিয়ে যাবো। তোমাকে রাঁধতে হবে না। চিকিৎসা নিয়ে ভাবতে হবে না। আমরা সারাদিন থাকি না। তুমি একা একা থাকো। চিন্তা হয় আমাদের। ওখানে অনেকে থাকে। তোমার একা লাগবে না।
টিপুর কথাগুলো শোনে খইফুল।
.... বাপ রে আমার তো কোনো অসুবিধা হয় না। আমি কি কিছু বলেছি কখনো?
.... তুমি কাপড়চোপড় গুছিয়ে নাও। চলো আগে যেয়ে দেখি আমরা! টিপুর কথার উপর কথা বলার সাহস পায় না খইফুল।
মিনি কাঁদছে। কেন কাঁদছে মিনি? টিপু মিনির দিকে তাকিয়ে খইফুলকে নিয়ে রওনা হয়। আসার সময় মিনিকে জড়িয়ে আদর করে খইফুল।
.... সাবধানে থেকো মা। এই সময়টা নিয়ম মেনে চলতে হয়। ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করো।
গাড়ীতে কোনো কথা হয় না টিপুর সাথে।
পৌঁছে গেছি মা! টিপুর কথা শুনে সম্বিত ফিরে পায় খইফুল।
কিসব কাগজপত্রের কাজ শেষ করে টিপু।
.... মা এখন থেকে এখানেই থাকবে তুমি। আমরা তোমাকে দেখতে আসবো। আর বছরে একবার বেড়াতে নিয়ে যাবো আমাদের বাসায়।
টিপু চলে যায়। সেদিন খুব কেঁদেছিল মাতৃত্ব নিদারুণ বেদনায়।খুব অসহায় এক মা আশ্রয় খুঁজেছিল ভালবাসায়।
এখন এখানে অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে গেছে খইফুল। অনেকের সাথেই হয়ে গেছে চেনা পরিচয়।
কি এক রোগের কথা সবাই বলাবলি করে। খুব ছোঁয়াচে। বৃদ্ধাশ্রমের এরা বারবার সাবান দিয়ে হাত ধুতে বলেছে। মাস তিনেক আগে টিপু এসেছিল দেখতে। মিনির সাথে দেখা হয় না কতদিন। মিনির একটা ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে। টিপু মোবাইলে ছবি দেখিয়ে গেছে।
.... রোজার ঈদে তোমাকে নিয়ে যাব মা।আর মাত্র কয়েকটি দিন!
.... তোর মেয়ে কার মত হলো? ওকে বুকের দুধ খাওয়ায় তো মিনি? কি নাম রেখেছিস?
.... বুকের দুধ তেমন পায় না মা। তোলা দুধ খায়। নাম রেখেছি প্রথমা!
আসলে মিনি একদমই বুকের দুধ খাওয়াতে চায় না। ফিগার নাকি নষ্ট হয়ে যায়! আর এত ধৈর্য্যও নেই মিনির।
মিনি খুব সাজগোজ পছন্দ করে। নিজেকে সুন্দর রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করে। টিপু অনেকবারই বলেছে। কিন্তু কাজ হয়নি,।
টিপুর রাগ এখানে তেমন খাটে না।
গাজীপুরের সবখানে ছড়িয়ে পড়ছে রোগটা। টিপুও আর আসতে পারে না। গাড়ি বন্ধ। মানুষকে ঘরে থাকতে বলা হয়েছে। মোবাইলে কথা হয় কদাচিৎ। টিপুই ফোন করে।
রোজার ঈদে তোমাকে আনতে পারবো কিনা জানি না মা! টিপুর গলায় কেমন জানি করুণ স্বর!
এখানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বলে। খইফুল এসব মানে বোঝে না। আর কেউই বোঝে না। একসাথেই তো সবাই থাকে, খায়, গল্প করে!
সামাজিক দূরত্ব মানে কি? খইফুলের খুব জানতে মন চায়।
সেইদিন একজনের ছেলে ফলফলাদি নিয়ে দেখতে এসেছিল। মুখে মাস্ক পড়া ছিল। বিস্কুট, চিড়ামুড়ি তাও এনেছিল।
খইফুলের সাথে একই ঘরে তিনিও থাকেন।
তিনদিনের মাথায় তার জ্বর এলো। সাথে কাশি। এখানে অনেকেরই অনেক অসুখ। অনেক ওষুধ খেতে হয় অনেককেই।
শ্বাসকষ্ট শুরু হতেই তাঁকে গাজীপুর সদরে সরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেছে।
খইফুলের নিজের শরীরটাও ভাল লাগছে না। কেমন জানি দুর্বল লাগছে। পায়ে খুব ব্যথা। অবশ্য এসব খইফুলের পুরাতন ব্যথা!
সকালে আরো অনেকেরই জ্বরের লক্ষণ দেখা যায়।
এখানকার ডাক্তারও নাকি আক্রান্ত!
খইফুলের খুব টিপুকে দেখতে ইচ্ছে করে। কাশির দমকে পিঠটা ব্যথা।
.... মা! মা! একটা বাচ্চার আওয়াজ। ঐ তো টিপু এসেছে স্কুল থেকে। এখনই বলবে.. মা ক্ষুধা পেয়েছে। খইফুল কাঁধের থেকে স্কুল ব্যাগটা নামায়।
... হাত মুখ ধুয়ে আয় বাপ। আমি খাবার দিচ্ছি। আজ তোর জন্য গরুর মাংসের তরকারি রেঁধেছি।
টিপুর তড় সয় না।
মা! মা! আগে খাবো!
খইফুল তাড়াতাড়ি ভাত বাড়ে। গরম ভাতে ধোঁয়া!
খইফুল শ্বাস পায় না,দম পায় না।
অনেক জোড়ে শ্বাস নিতে চায়। কেমন জানি দম আটকে আসে। হাতটা বাড়িয়ে টিপুকে ধরতে চায়। একটু কাছে আয় বাপ!
পুরো বৃদ্ধাশ্রম লক ডাউন। মোবাইলে খবর পায় টিপু। কিন্তু আসতে পারবে না জানিয়ে দেয় কর্তৃপক্ষের কাছে।
পুনশ্চ : আজ মা দিবস।কোনো একদিনে কি আটকে থাকে ভালবাসা। সকল মায়ের প্রতি ভালবাসা..... থাক প্রতিদিন, থাক প্রতিক্ষণ।