কাকন রেজা। ফাইল ছবি
কাকন রেজা :
অনেকেই গোস্বা করেছিলেন আমার ওপর। জর্জ ফ্লয়েড হত্যা এবং আমেরিকার পুলিশের বর্ণবাদী আচরণের নিন্দা করিনি কেন, এই বলে। ব্যাপারটি নিয়ে চুপ ছিলাম। কেন ছিলাম এখন কী বুঝতে পারছেন? আমি আমার নিজের জনের হত্যার প্রতিবাদ যখন করতে পারি না, ভয় পাই, তখন বাইরের কারো মৃত্যুর প্রতিবাদ করার অধিকার নিশ্চিত ভাবে হারাই। আর আমি সাধারণত অনধিকারের চর্চা করি না।
আমাদের দেশের কিছু মানুষ কেরালায় হাতি হত্যার প্রতিবাদে অস্থির হয়েছেন, অথচ চট্টগ্রামের মেছোবাঘ হত্যার পর কাঁধে নিয়ে মিছিলের বিষয়ে টু শব্দটি করেননি! প্রতিবাদের এমন কনট্রাস্ট অগ্রহণযোগ্য। এই প্রতিবাদ অর্থহীন। অর্থহীন কোন কাণ্ডে জড়ানো বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
আমেরিকাতে বিক্ষোভ চলছে। গণ ও সামাজিকমাধ্যমের কল্যাণে সে সবের দৃশ্যচিত্র আমাদের হাতে হাতে। সেই দৃশ্যচিত্রে দেখা যাচ্ছে সেখানে আগুন জ্বলছে। পুলিশের ও ব্যক্তিগত গাড়িতে আগুন দেয়া হয়েছে। দোকান, শো-রুম লুট হচ্ছে। মানুষ দেদারছে জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছে দোকানপাট থেকে। আমাদের দেশের প্রগতিশীল বলে দাবিদাররা এর সমর্থন দিচ্ছেন। না আমার কোনো আপত্তি নেই এমন সমর্থনে। আর বিক্ষোভ যে সবসময় নিয়মতান্ত্রিক হবে এটাও মনে করি না। বিক্ষুব্ধ মানুষের মুভমেন্ট বোঝা কঠিন ব্যাপার। তাই এমন বিক্ষুব্ধতায় সবই সম্ভব মেনেই মানুষ বিক্ষোভে সমর্থন দেয়।
কিন্তু আমার আপত্তিটা অন্যখানে। আপনি যখন একই ধরণের মুভমেন্টকে বিক্ষোভ না বলে সন্ত্রাস বলবেন- সেটা নিজেদের ক্ষেত্রে। আর অন্যের ক্ষেত্রে সেই একই সন্ত্রাস হয়ে যাবে প্রতিবাদের ভাষা! এমন কন্ট্রাস্ট, বৈপরীত্য সমর্থনযোগ্য নয়। আপনি একইমুখে দুই কথা বলবেন, আপনার সেই কথাকে সমর্থন করা অনুচিত। কারণ আপনার নিজের সাথে নিজের সংঘাত রয়েছে নীতির প্রশ্নে। আপনার চিন্তায় কাজ করছে বৈপরীত্য। সেই নীতি, সেই চিন্তা অসৎ। আর সে অর্থে আপনি নিজেও সৎ নন। সুতরাং এমন মানুষের আহ্বান কিংবা আস্ফালন দুটোই অগ্রহণযোগ্য, নিরর্থক।
তবে আমেরিকার এই আন্দোলন থেকে আমাদের তথাকথিত প্রগতিশীলদের অনেক শিক্ষা নেয়ার রয়েছে। প্রথম শিক্ষাটা হলো অহেতুক ধর্ম বিদ্বেষ থেকে দূরে থাকার শিক্ষা। আমি নিজেও দীর্ঘদিন থেকে বলে আসছিলাম। সংঘাত ও সন্ত্রাসের জন্য ধর্মই একমাত্র কারণ নয়। ধর্ম একটা উপকরণ মাত্র। ধর্ম না থাকলেও বর্ণ, গোষ্ঠী, রাজনীতি নানান কিছু নিয়ে সংঘাত হতো, সন্ত্রাস হতো। যারা সংঘাত ও সন্ত্রাসের কাজটি করে তাদের প্রয়োজন একটি উপকরণ। যা হতে পারে ধর্ম, বর্ণ কিংবা রাজনীতি। আমেরিকার এই সংঘাত ধর্ম নয় বর্ণ ভিত্তিক। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র ধর্ম, বিশেষ করে আমাদের প্রগতিশীলদের ইসলাফোবিয়া থেকে সরে আসতে হবে। আমেরিকার বর্তমান মুভমেন্ট অন্তত তাই বলে।
দ্বিতীয়ত আমাদের কথিত প্রগতিশীলদের নিজেদের মধ্যেকার কন্ট্রাস্ট দূর করতে হবে। নিজের জন্য আন্দোলনের সংজ্ঞা একভাবে নির্ধারণ করবেন, অন্যদের জন্য করবেন আলাদা ভাবে- এমন নির্ধারণ থেকে সরে আসতে হবে। সারা পৃথিবীতে সফল বা বিফল যে আন্দোলনই হয়েছে, তা চুড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে আর নিয়মতান্ত্রিক থাকেনি। অ্যামেরিকার আন্দোলনেও তাই দৃশ্যমান হয়েছে এবং হচ্ছে। এমনকি পরিবেশবাদীদের আন্দোলনও বিক্ষুব্ধ হতে দেখা গেছে, সহিংস হতে দেখা গেছে। বিশ্ব সভ্যতার দাবিদার খ্যাত দেশগুলিতেও আন্দোলন সহিংস হয়েছে। সেই সহিংসতা বন্ধ করার প্রয়াস হয়েছে। কিন্তু সহিংসতার অজুহাতে আন্দোলন পরিত্যাজ্য হয়নি। ফ্রান্স, জার্মানি, বৃটেন আর অ্যামেরিকার উদাহরণ তো চোখের সামনে। সুতরাং আন্দোলন বিষয়ে নিজেদের ভেতর বৈপরীত্যহীন একটি চিন্তা সৃষ্টি এবং সমর্থনের বিষয়ে পরিষ্কার ধারণার কথাই জানিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান বিক্ষোভ চিত্র।
নিপীড়ন থেকে মুক্তি পেতে হলে আন্দোলন প্রয়োজনে যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়। যেমন আমাদের একাত্তর। শোষণ বঞ্চনার প্রতিবাদেই আমাদের যুদ্ধের মতন একটা এক্সট্রিম সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিলো। তাবৎ বিশ্বেই তা ঘটেছে। অ্যামেরিকার গৃহযুদ্ধও সেই নিপীড়নের বিরুদ্ধেই। যারা চিন্তা করেন শুধুমাত্র হারমোনিয়াম বাজিয়ে কিংবা নিপীড়কদের সাথে আপোস করে বিপ্লব সম্ভব তারা হয় বোকা নয় ধান্ধাবাজ। আজকে যখন লিখছি তখন যুক্তরাষ্ট্রের মিনিয়াপোলিস সিটি কাউন্সিল স্থানীয় পুলিশ বিভাগকে ভেঙে দেয়ার অঙ্গীকার করেছে। এটা এমনিতেই সম্ভব হয়নি। এরজন্যে প্রয়োজন হয়েছে বিক্ষুব্ধতা। প্রশাসন বুঝতে পেরেছে মানুষের পালস, বিক্ষোভের গভীরতা। তারাও মানুষের প্রতি সংহতি জানিয়েছে। এমনকি পুলিশও মানুষের আবেগের প্রতি শ্রদ্ধার প্রকাশ ঘটিয়েছে।
এই হয়, এমনটাই হয়। শেষ পর্যন্ত সভ্য দেশগুলিতে জনদাবির প্রতি মাথা নোয়ায় সবাই। আর সভ্য দেশের বিপরীতে দেশগুলিতে হয় বিভক্তি। ফলে সেখানে জনদাবি উপেক্ষিত হয়। দাবির পক্ষে থাকা মানুষ নিগৃহিত হয়। উল্টো মানুষকে সরে আসতে হয় তাদের অধিকার আদায়ের দাবি থেকে। আর তা থেকে সরে এলে কী হয়, তা আমাদের চোখের সামনেই।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট