আমিনা সুলতানা সানজানা। ফাইল ছবি
আমিনা সুলতানা সানজানা :
নীলার সকাল থেকেই কেমন জানি বমি বমি লাগছে। ভেতর ভেতর একটু অস্থিরতাও আছে। দুই মেয়েকে স্কুলে দিয়ে এসে এই সময় নীলার নিঃশ্বাস নেয়ার সময় থাকে না। তিন ঘণ্টা হাতে সময়। এর মধ্যেই ওকে রান্না, ঘর গোছানো, ওদের বিকালে টিচার আসবে তার জন্য নাস্তা রেডি করা, পড়াগুলো গুছিয়ে রাখা যাতে সন্ধ্যায় পড়তে বসে ঝামেলা না হয় সব করতে হবে।
বুয়া এই ফাঁকে ঘর মোছা, কাপড় ধোঁয়া সেরে ফেলে।
কিন্তু আজ নীলার কিছুই করতে মন চাইছে না। কেমন যেন আলস্য ভর করেছে ওর উপর।
স্কুল থেকে এসেই গা এলিয়ে দিল বিছানায়। বুয়াকে বলে দিলো এক পট চাল চড়িয়ে দিতে উনুনে। মেয়েরা এসে ঘুমায়। খুব একটা খেতে চায় না। সকালের আলু ভাজি আছে আর ডিম ভাজি করবে, আজকের মেনু হয়ে গেল দুপুরের। সব সময় কি আর একরকম লাগে মন মেজাজ!
রাতে ওরা বাইরে খাবে। মামুনের সাথে আজ অনেক ঝগড়া হয়ে গেছে সকালে এই সুইচবোর্ড নিয়ে। কি করবে নীলা! মামুনটা একেবারে সাংসারিক না। কোন কাজ সময় মতো করে না। একটা কিছু নষ্ট হলে বলতে বলতে অস্থির হয়ে যায় নীলা। কিন্তু মামুনের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই তাতে।
ওরা এ বাড়িতে এসেছে প্রায় তিন বছর। আসার পর থেকেই দেখছে বিদ্যুৎ গিয়ে জেনারেটর সংযোগ দেয়ার সময় বিকট শব্দ হয় সুইচ বোর্ডটিতে। এর মধ্যে দুবার মিস্ত্রি দেখানো হয়েছে। ওদের বাসার নিচেই থাকে ছেলেটা, ভালো কিছু জানে বলে মনে হয় না নীলার। তাই হলো সে ঠিক করতে পারেনি। নীলা অনেকদিন ধরে বলেই যাচ্ছে মামুনকে এই সম্পূর্ণ সুইচ বোর্ডটাই পরিবর্তন করতে। ভালো একজন মিস্ত্রি দেখাতে। টাকা যায় যাক। বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়াটাই জরুরী। পাশের রূনা ভাবী আর সাদিয়া ভাবীও অনেকদিন সতর্ক করে গেছে, মামুনকে সে কথা বলেও লাভ হয়নি।
মামুন তো মামুনই! কোন কিছুতেই ভ্রুক্ষেপ নেই মামুনের ! শুধু এটা না সংসারের সব কিছুতেই তার উদাসীন ভাব চরম। মাসের শেষে টাকা দিয়েই শেষ। প্রয়োজনীয় সব কাজ নীলার ঘাড়ে। মামুনের জীবনে অফিস থেকে এসে মোবাইল দেখা আর বাচ্চাদের সাথে হাসাহাসি করা ছাড়া কোন কিছুর কোন তাড়া নেই। এসব সবসময় ভালো লাগে না নীলার! সংসারটা মাঝে মাঝে বোঝা মনে হয়!
এসব নিয়েই ঝগড়া। এখন নীলার খারাপ লাগছে। সে মামুনের সাথে এসব বিষয় নিয়ে অনেক ঝগড়াঝাঁটি করে, কিন্তু ভালোবাসেও অনেক তাকে। পরে নিজেই কষ্ট পায় ঝগড়া করে। তাই ঠিক করেছে, আজ রাতে বাইরে খেতে যাবে সবাই মিলে। একটু হালকা হবে পরিবেশ। বড় মেয়ে লাইসা অনেক দিন ধরেই পিজ্জা খেতে চাচ্ছে, আজ তা খাওয়া যেতে পারে। ছোট মেয়ে রাইবার আব্দার ছিল একটা পুতুলের, আজ সেটাও পূরণ করে দিবে নীলা। বাচ্চাদের জন্যোই তো সব, ওরা খুশি থাকলে সব ভালো লাগে। আর মা হিসেবে নীলা খুব কঠোর, তাই বাচ্চাদের খুব একটা আবদার তার মেটানো হয় না।
আজ না হও একটু নিয়ম ভঙ্গ হলো !
দুপুরে বাসায় ফিরে লাইসা ঘুম ঘুম চোখে খেয়ে নিলো, কিন্তু রাইবা মাংস ছাড়া খাবেই না। সন্ধ্যায় পিজ্জা খাওয়াবো, এসব বলেটলে কোনরকম খাওয়ালো নীলা।
আজ মনে হয় রাজ্যের ঘুম ওদের চোখে।
অন্যদিন খাবার ফ্রিজে তুলে রাখে সে। আজ আর তেমন কিছু নেই। তাই যা ছিল তা টেবিলে ফেলে রেখেই ঘুমাতে গেল নীলা দুই মেয়ে নিয়ে।
মানুন অফিস থেকে বের হয়ে গেল বিকালের আলো থাকতেই। নীলার সাথে ঝগড়া হয়েছে সকালে, ভালো লাগে না আর এসব। জীবনটা নির্ভেজাল ভাবে কাটানোর কোন উপায় নেই। শুধু এটা কর, ওটা কর! মানুনের এসবে বড় অনীহা। সে অফিসে যা করে তার বাইরে আর কোন কাজ করতে ইচ্ছে করে না তার। বাকিটা সময় কই একটু আরাম করবে, নাহ ! নীলা এমনিতে খুব ভালো মেয়ে। মা এবং বউ হিসেবে খুব দায়িত্বশীল। শুধু মামুনের পিছনে লেগে থাকে। সব বিষয়ে ওর অতিরিক্ত চিন্তা। শ্বশুরবাড়ি থেকে যৌতুক হিসেবে মানুষ কত কিছু পায়, মামুন পেয়েছে বউয়ের অতিরিক্ত চিন্তা...... এসব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে মামুন রিক্সা দিয়ে বাসার দিকে এগোয়।
রাইবা আইসক্রিম খেতে চেয়েছে, সকালে ঝগড়াঝাঁটির মাঝে কানে কানে এসে বলে গেছে, "বাবা আজ কিন্তু আমার জন্য অবশ্যই আইসক্রিম আনবা, আচ্ছা বাবা!"
দুই মেয়ে মামুনের কলিজা। এতো মায়া মায়া কথা বলবে ছোটজন, যা অগ্রাহ্য করা যায় না ! মায়ের চিৎকার তার কানেই যাচ্ছে না, সে আছে তার আইসক্রিম নিয়ে। বড় মেয়েটা বেশি শান্ত, মায়ের চিৎকার চেচিমেচিতে কিছু বলেনি, কিন্তু ওরও ইচ্ছা আইসক্রিম খাওয়ার। মামুন তা জানে! নীলাকে লুকিয়ে নিয়ে যাবে আইসক্রিম। তারপর সময় সুযোগ বুঝে খেয়ে নিবে বাপ-মেয়ে। বাড়ির কাছের দোকান থেকেই কিনবে, তা না হলে গলে যাবে আইসক্রিম।
প্রচন্ড ধোঁয়ায় শ্বাস বন্ধ হওয়ার যোগার। কাশতে কাশতে ঘুম ভাঙলো নীলা আর লাইসার। রাইবা তখনও ঘুমে। এমন ধোঁয়ায় মেয়েটা কেন ঘুমাচ্ছে নাকি কেন এতো ধোঁয়া আর এতো চিৎকার, কোনটা আগে মনে পড়লো নীলার কে জানে! ঘরে আগুন লেগেছে বুঝতে এক মিনিট মতো সময় লাগলো নীলার! বাইরে অনেক মানুষ চিৎকার করছে, অনেক শব্দ কিন্তু কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না নীলা। যে দরজা দিয়ে ঘর থেকে বের হতে হয়, তার পাশেই সুইচবোর্ডটা। ওখানে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। ধোঁয়ায় সব অন্ধকার হয়ে গেছে। নীলা লাইসা আর রাইবাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে অনেক শক্ত করে, যেন বুকের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলতে পারলে বেঁচে যেতো তার দুই মেয়ে। তার নিজের জন্য কোন চিন্তা নেই, মেয়ে দুটোকে কিভাবে বাঁচাবে নীলা! নীলা চিৎকার করছে, হাউমাউ করে কাঁদছে। লাইসা অনেক ভয় পেয়েছে, ভয়ে মেয়েটা কাঁদতেও পারছে না। রাইবা কেন শব্দ করছে না!
কেউ একজন বারান্দা দিয়ে ডাকছে ওদের। নীলা সেদিকে এগোতে গিয়ে দেখে রাইবা কোন সারা শব্দ করছে না। নীলা ডাকতে থাকলো, রাইবা উঠ তাড়াতাড়ি, রাইবা! নীলা আর উঠতে পারে না রাইবার নিথর দেহ রেখে। লাইসা আর রাইবাকে শেষবারের মতো অনেক অনেক চুমু খায় এক অসহায় মা। বলতে থাকে, আম্মু সরি মা, আম্মু সরি!
আগুন দ্রুত ওদের আশেপাশে চলে আসছে। পানি দিচ্ছে মনে হয় বাইরে থেকে। কিন্তু ধোঁয়ায় কখন নীলা জ্ঞান হারালো সে জানে না!
মামুন বাসার সামনে এসে যখন দেখে লোকে লোকারণ্য, তখন ওর আর কিছু করার ছিল না তার কলিজার দুই টুকরা আর তার প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্য। লাইসা, রাইবা আর নীলা যখন পুড়ছিল শর্ট সার্কিট থেকে লাগা আগুনে।