ছবি: সংগৃহীত
অনুপম সৈকত শান্ত:
নেদারল্যান্ডে আমরা যে গ্রামটায় থাকি, সেখানে একটা হাউজ আর্টসেন প্রাক্টাইক (স্থানীয় চিকিৎসকের কেন্দ্র) আছে। আমাদের বাসা থেকে সাইকেলে ৫ মিনিটে চলে যাওয়া যায়। আশে পাশের গ্রাম থেকেও অনেকেই এখানে আসেন। গোটা নেদারল্যান্ডে ছড়িয়ে ছিটিয়ে এমন হাউজ আর্টসেন প্রাক্টাইক আছে ৪৭৪৫টি। প্রতি ৫-১০ টি গ্রামের জন্যে একটি করে হাউজ আর্টসেন প্রাক্টাইক। বাংলাদেশের ইউনিয়ন পর্যায়ের সাথে তুলনা করা যেতে পারে।
আমাদের গ্রামের এই হাউজ আর্টসেন প্রাক্টাইকে আছেন ৩ জন হাউজ আর্টস বা চিকিৎসক, যাদের দুজন পুরুষ এবং একজন নারী। ৩ জন চিকিৎসক সহকারী যাদের দুজন নারী ও একজন পুরুষ। এই হাউজ আর্টসেন প্রাক্টাইকের অংশ হচ্ছে একটি আপোথেক (ওষুধকেন্দ্র বা ফার্মেসি)। সেখানে কাজ করে ৫ জন সহকারি, তাদের ৫ জনই নারী। এর বাইরে আরেকজন আছেন, যিনি চিকিৎসক ও ওষুধকেন্দ্র- দুটোরই সহকারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, তিনিও নারী। দুজন প্রাক্টাইক-ওন্ডারস্টেউনার বা এই চিকিৎসা কেন্দ্রের সাহায্যকারী, দুজনই নারী। সবশেষে, আরেকজন রয়েছেন- তিনি ফিনান্সিয়াল এডমিনিস্ট্রেশনের কাজ করেন, নারী।
এই হচ্ছে আমাদের গ্রামের হাউজ আর্টসেন প্রাক্টাইকের ওয়ার্কিং সেট-আপ। খুবই পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, যাকে বলে টিপটপ এই হাউজ আর্টসেন প্রাক্টাইকের ভেতরে ঢুকলে একটা বড় রুম। যেখানে লাগোয়া আছে ফার্মেসি আর তার পাশে রিসেপশন। এই রুমের পাশেই ওয়েটিং রুম। সেটার দরজা দিয়ে চিকিৎসকদের চেম্বারে যাওয়া যায়। তিনজনের জন্যে তিনটি আলাদা ঘরে তিনটি চেম্বার। সেই তিন চিকিৎসক চেম্বার রুমের পাশে রয়েছে আরেকটি রুম, যেখানে ছোটখাট ইমার্জেন্সি চিকিৎসা দেয়া হয়।
যেই ভবনটিতে এই হাউজ আর্টসেন প্রাক্টাইক রয়েছে, তার নাম মেডিস্ক সেন্ট্রুম বা মেডিকেল সেন্টার। এর অর্ধেকটায় এই হাউজ আর্টসেন প্রাক্টাইক, বাকি অর্ধেকে রয়েছে ফিজিওথেরাপি সেন্টার ও লোগোপিডি বা স্পিচ থেরাপি সেন্টার। ফিজিওথেরাপি সেন্টারে রয়েছেন ৫ জন ফিজিওথেরাপিস্ট, যাদের ৪ জন নারী ও একজন পুরুষ। স্পিচ থেরাপি সেন্টার যেটা বললাম- সেটার নাম ক্লিঙ্ক। এটা আসলে কেবল স্পিচ থেরাপি সেন্টার নয়। এখানে স্পিচ থেরাপি (লোগোপিডি), ডিসলেকশিয়া থেরাপি ও কোচিং- এই তিন সেবা দেয়া হয়। লোগোপিডি বা স্পিচ থেরাপি সেন্টার সম্পর্কে যাদের ধারণা নেই- তাদের জন্যে বলছি, এখান ভাষাগত তথা উচ্চারণগত সমস্যা, তোতলামি, কথা বলার ক্ষেত্রে শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত সমস্যা, শ্রবণের সমস্যা, কন্ঠস্বরের সমস্যা- এরকম নানান সমস্যায় সেবা দেয়া হয়।
আমাদের গ্রামে এই মেডিকেল সেন্টারের পাশপাশি রয়েছে- টান্ড আর্টস প্রাক্টাইক বা ডেন্টাল ক্লিনিক বা দাঁতের চিকিৎসাকেন্দ্র (নেদারল্যান্ডের লোকজন বছরে দু’বার রুটিন চেকাপের জন্যে দাঁতের ডাক্তারের কাছে যায়)। এটি আমাদের বাসা থেকে সাইকেলে ২ মিনিটের পথ। এখানে ঢুকেই একটা করিডর, সেই করিডরের শুরুতেই হাতের বামে রিসেপশন, আর ডানে ওয়েটিং রুম। তারপরে করিডর দিয়ে এগুলেই পাওয়া যাবে, ডানে ও বামে ট্রিটমেন্ট চেম্বারগুলো। মোট কতটি আছে জানি না, আমরা বিভিন্ন সময়ে তিনটি চেম্বারে ঢুকেছি। এই তিনটিতেই অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সম্বলিত চেয়ার, কম্পিউটার সেটাপ আছে। এই দাঁতের চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়মিত দাঁতের ক্লিনিং শুধু নয়, রুট ক্যানাল থেকে শুরু প্রায় সবরকম সেবার ব্যবস্থাই রয়েছে। দাঁতের ছবি তোলা ও এক্সরেরও করার ব্যবস্থা আছে। এই কেন্দ্রে তিনজন টান্ড আর্টস বা দাঁতের চিকিৎসক রয়েছেন। একজন মন্ডহাইজিনিস্টে বা মুখ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং তিনজন প্রিভেনচি এসিস্টেন্টি বা সুরক্ষা সহকারি রয়েছেন। আর রয়েছেন একজন প্রাক্টাইক ম্যানেজার। এদের বাইরে একজন রয়েছেন শিক্ষানবিশ সহকারি, যিনি আসলে পাশের একটি শহরের একটি কলেজের বিবিএল শিক্ষার্থী (বিবিএল শিক্ষা হচ্ছে চিকিৎসা বিষয়ক কর্মমুখি শিক্ষা, যেখানে নার্সিংসহ বিভিন্ন রকম শিক্ষা দেয়া হয়)। এই পুরো ওয়ার্কিং ফোর্সের প্রত্যেকেই নারী।
এই হচ্ছে আমাদের গ্রামের চিকিৎসার সুযোগ সুবিধা। বড় রকম সমস্যার চিকিৎসা এখানে হয় না। স্পেশালিস্ট চিকিৎসক এখানে নেই। কোনরকম ডায়গনিস্টিক টেস্ট এখানে করা যায় না। সেসবের জন্যে আশেপাশের শহরের হাসপাতালে যেতে হবে। আমাদের এই গ্রামের সাথে তিনটি শহরের সাথে বাস যোগাযোগ রয়েছে। যার দুটিতে একটি করে হাসপাতাল রয়েছে, আরেকটিতে ৩টি। বাসে যেতে ২৫ থেকে ৪৫ মিনিট সময় লাগে, প্রাইভেট কারে আরো কম সময় (ঢাকা শহরে কল্যাণপুর বা মোহাম্মাদপুর থেকে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে পৌঁছতে আরো বেশি সময় লাগে)।
চিকিৎসা সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে এদের হিসাবটা খুব সহজ। মানুষের বেশিরভাগ অসুস্থতার ক্ষেত্রেই, খুব সাধারণ চিকিৎসা পরামর্শের দরকার। এর জন্য স্পেশালিস্টের দরকার নাই। যেকোন অসুখেই গড়েবড়ে একগাদা টেস্টের দরকার নেই। সে কারণে নেদারল্যান্ড জুড়ে জনগণের নাগালের মধ্যে তৈরি করা হয়েছে হাউজ আর্টসেন প্রাক্টাইক (স্থানীয় চিকিৎসকের কেন্দ্র)। এখানে হাসপাতালের চাইতে এসব হাউজ আর্টসেন প্রাক্টাইকের সংখ্যা বেশি, স্পেশালিস্ট চিকিৎসকের অনেকগুন বেশি সাধারণ মেডিসিনের চিকিৎসক। তার চাইতেও বেশি চিকিৎসকের সহকারি, নার্স, মিডওয়াইফসহ বিভিন্ন পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মী।
শহরের পাড়ায় মহল্লায় যেমন নেই ডায়গনিস্টিক সেন্টার, তেমনি নেই ফার্মেসি। ডায়গনিস্টিক সেন্টারগুলো হাসপাতালের পার্ট। আর ফার্মেসিগুলো সব হাউজ আর্টস প্রাক্টাইক ও হাসপাতালের পার্ট- যেখান থেকে চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন বাদে কোন ওষুধ কেনা সম্ভব না। সুপার শপগুলোতে প্যারাসিটল, পেইন কিলার টাইপের ওষুধ, নানারকম ভিটামিন, মিনারেল ক্যাপসুল, ভেষজ ওষুধপাতি পাওয়া যায়। সেগুলো কিনতে প্রেসক্রিপশনের দরকার নেই। কিন্তু অন্য কোন ওষুধ প্রেসপক্রিপশন বাদে কেনার সাধারণত উপায় নেই। এমনকি চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশনটাও এখন পর্যন্ত হাতে পাইনি কখনো। হাউজ আর্টসেন প্রাক্টাইকের চিকিৎসকের কাছ থেকে প্রেসক্রিপশনটা অনলাইনে সরাসরি আপোথেক (ফার্মেসি) এর কাছে চলে যায়। সেখান থেকে ওষুধ সংগ্রহ করতে হয়। ওষুধের প্যাকেটের গায়ে স্টিকার সেটে দেয়, কয়বেলা কয় ডোজ খেতে হবে। ফলে একই প্রেসক্রিপশন নিয়ে এসে কোন ফার্মেসি থেকে ইচ্ছেমত ওষুধ কেনার উপায়ও নেই। তাছাড়া, ওষুধের দামটাও বেসিক ইন্সুরেন্স থেকেই চলে যায় (স্কিনের সমস্যায় শ্যাম্পুর দাম নিজে থেকে দিতে হয়)।
বেসিক ইন্সুরেন্স, যার জন্য প্রতিমাসে ১০০-১২০ ইউরো দিতে হয়। এই হাউজ আর্টস প্রাক্টাইক, ওষুধপাতি, হপিটালাইজেশন- প্রভৃতি কাভার করলেও দাঁতের চিকিৎসা, ফিজিওথেরাপি, স্পিচ থেরাপি এসব করে না (বাচ্চাদের জন্য অবশ্য ফ্রি)! সেসবের জন্য আলাদা প্রিমিয়াম কিনতে হয়, না হলে সেই চিকিৎসা নিতে অনেক বেশি খরচ করতে হয়। অনেকে কোনো বছরে বিশেষ চিকিৎসা শুরু করার আগে (যেমন ফিজিওথেরাপির ট্রিটমেন্ট), বিশেষ ইন্সুরেন্স প্যাকেজটা সাবস্ক্রাইব করে। আবার বছর শেষে পরের বছরের ইন্সুরেন্সে সেটা বাদ দিয়ে দেয়। কিছুক্ষেত্রে আমি হিসাব করে দেখেছি, প্রতি মাসে বছরের পর পর, বিশেষ প্যাকেজ নেয়ার চাইতে সেই দুই তিনবারের উচ্চ খরচ দিয়ে চিকিৎসা নেয়াটা লাভজনক। কিন্তু প্রতিমাসে অল্প কিছু খরচ বাড়ানোর (১০-২০-৫০ ইউরো) চাইতে একবারে বড় একটা এমাউন্ট পে করা (যেমন ১০০-২০০-৩০০ ইউরো) অনেকের জন্য কষ্টকর মনে হওয়ায়, ইন্সুরেন্সের প্যাকেজ কিনে ফেলে।
বাঙালি বুদ্ধিতে আমার মনে হয়েছে, এর চাইতে প্রতিমাসে সেই টাকাটা ইন্সুরেন্সে না দিয়ে আলাদা করে জমালেও লাভ! এমন আলাপের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে- নেদারল্যান্ডের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে যত প্রশংসাই করি। আমার চোখে এর সবচাইতে বড় সমস্যা হচ্ছে, এই ব্যয়বহুল চিকিৎসা ব্যবস্থাটা শেষ পর্যন্ত প্রচণ্ড রকম বৈষম্যমূলক। বেসিক চিকিৎসা সেবাটুকু সকলের জন্যে নিশ্চিত করা হয়েছে, বাচ্চাদের জন্যে চিকিৎসা ফ্রি- এসবই ভালো। কিন্তু, বিশেষায়িত ও ক্রিটিকাল চিকিৎসার ব্যয় নির্বাহ করা নিম্নবিত্ত মানুষের জন্যে খুবই কষ্টসাধ্য।
(চলবে)
লেখক : প্রকৌশলী ও গবেষক ।