• ১৪ জুলাই ২০২০ ২১:৪১:৪৯
  • ১৪ জুলাই ২০২০ ২২:১৫:৩৪
অন্যকে জানাতে পারেন: Facebook Twitter Google+ LinkedIn Save to Facebook প্রিন্ট করুন
বিজ্ঞাপন

অক্ষমতার দ্বার দ্বারে

ইশরাত জাহান। ছবি : সংগৃহীত


ইশরাত জাহান :


--তানজিননননন, এই তানজিননননন।

--কি হলো এমন চিৎকার করছো কেন??

--আমার শার্টের কলারে আজকেও ময়লা, এই দেখো শার্টের এই বোতামটা উধাও। কি করো তুমি? এসব একটু খেয়াল রাখতে পারোনা।

--দেখো, তুমিও চাকরি করো, আমিও করি। তাই আমার এতো সময় নেই তোমার শার্টের কলারের ময়লা দেখার।

--তা দেখবে কেন? তুমি তো দেখবে কে কবে কোথায় ঘুরতে গেলো,কোথায় খেতে গেলো এইসব। স্বামীর শার্টের কলারের ময়লা দেখা তো আর তোমার কাজ নয়, তাই না।

--কি শুরু করলে সকাল সকাল? আজ বৃহস্পতিবার একটু মেজাজটা ঠিক রেখে অফিসে যেতে দাও। আজ কাজের খুবই চাপ যাবে আমার। 

--এমন একটা ভাব করো, চাকরি যেন তুমি একাই করো। আমিও করি। আজ আমার এমডি স্যারের সাথে মিটিং। 

--এই নাও, এই শার্টটা পড়ো। এটা ঠিক আছে।

--এই শার্ট কোথায় পেলে?

--তোমার জন্মদিনে দেবো বলে, আগেই কিনে রেখেছিলাম। আজ এটাই পড়ো।

--তানজিন তুমি সংসারের ব্যাপারে একেবারে উদাসীন। এবার একটু মনোযোগী হও। আর খরচের হাতটা এবার একটু কমাও।

--শোনো, আমার প্রতিমাসের বেতনের টাকা জমিয়ে কিন্তু ফ্ল্যাটের বুকিংটা দিয়েছিলাম। আবার এই ফ্ল্যাটের লোনও শোধ করেছি। পাঁচ মাস দিলেই এইটা পুরোপুরি আমাদের ফ্ল্যাট  হয়ে যাবে। তাই কিছু বলার আগে চিন্তা করে বলবে।

এই হলো তানজিন আর আজাদের সংসার। ওদের প্রতিটি সকাল শুরু হয় ঝগড়া দিয়ে, আর রাতের শেষ হয় এই ঝগড়া দিয়ে। আজাদ খুব খুঁতখুঁতে স্বভাবের লোক, প্রতিটি জিনিস চায় একেবারে টিপটপ। আর তানজিন হলো একটু অগোছালো। কোন জিনিষ গুছিয়ে করতে পারেনা। যাই করে আজাদ সেটাতেই খুঁত খুঁজে বের করে। আগে খুব বিরক্ত হতো তানজিন। এখন কিছুই মনে করেনা। আজাদ ওর কথা বলে যায় আর তানজিন ওর মতো কাজ করে যায়। তবে সমস্যাটা শুরু হয় তখনই যখন আজাদ ওর মায়ের সাথে তানজিনের তুলনা করে।

--মাকে দেখেছি, সবকিছু কত গুছিয়ে করতো। তুমি তার ছিটেফোঁটাও পেলেনা। আমার মাও তো চাকরি করতো।

--দেখো তোমার মায়ের সাথে আমাকে একদম তুলনা করবেনা। আমি এমনই আছি এমনই থাকবো। তোমার মা তো করতো স্কুলের চাকরি, আমার মতো এমন নয়টা টু নয়টা অফিস করতো, তাহলে বুঝতো।

এইভাবে সকালের সুপার ডুপার ঝগড়ার ইনিংস শেষ করে ওরা পৌঁছে যায়, যে যার অফিসে। তানজিন একটি পেট্রোলিয়াম কোম্পানিতে আর আজাদ ব্যাংকে। অফিস ওদের  কাছাকাছি। 

মাঝেমধ্যে দুপুরে দুজনে মিট ক'রে কোনো দরকার পড়লে। ওদের বিয়ের পাঁচ বছর গড়িয়ে ছয় বছরে পড়লো। এখনও টোনাটুনিই আছে,এটাকে এক্সটেনশন করার কথা এখনো ভাবেনি ওরা।

আজাদরা দুইভাই, এক বোন, মা ওদের আগলে রেখেছে,বাবা সাত বছর হলো আগে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেছে। মা ওর কাছেই থাকে মাঝেমধ্যে ছোট ভাই, বোনের বাসায় যায়। ছোটভাই থাকে সিলেটে, ওরা স্বামী স্ত্রী দুজনেই ডাক্তার। তবে ছোট ভাইয়ের বউটা খুবই সংসারী। সবকিছুই ওর মায়ের মতো, আজাদের খুব আফসোস ওর বউটা কেন ওদের মতো হলো না।

তানজিন বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে, একটু খামখেয়ালি। দায়িত্ব জ্ঞানের বালাই নেই। সবকিছুই ভালোলাগে শুধু ঘরের কাজকর্ম ছাড়া। রান্না করা ওর দুই চোখের এলার্জি। ওর যুক্তি হলো, নারী জাতির জন্ম শুধু রান্নাবান্না আর সংসার সামলানোর জন্যই হয়নি। ওদের আরো অনেক কাজ আছে। সেই কাজের মধ্যে একটি হলো শপিং, আর একটি হলো ঘোরাঘুরি, মুভি দেখা।

আজাদ আজ অফিসে ঢুকেই দুটো মিষ্টি খেয়ে ফেলে। উপলক্ষ্য ওর অফিস কলিগ তমাল বাবা হয়েছে। মিষ্টি খাওয়ার পড়ে ওর মনে খচখচ করতে থাকে। তমাল তিন বছর হলো বিয়ে করেছে, এর ভিতরে বাবা হয়ে গেলো। আর ওরা তিনের দ্বিগুন হয়ে এখনও টোনাটুনি হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কয়দিন পরে ছোটো ভাইয়ের ও মনে হয় ওর বাচ্চার মিষ্টি গিলবে।

আজ বাসায় ফিরে এই নিয়ে তানজিনের সাথে কথা বলতে হবে। অবশ্য দুই বছর আগে তানজিন একবার বাচ্চার জন্য  উৎসুক হয়ে ডাক্তারের কাছে কয়েকদিন ঘোরাঘুরি করেছিলো। অনেক টেষ্ট করিয়ে ছিলো ওদের দুজনের। তখন আজাদের তেমন আগ্রহ ছিলোনা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে। নিজের ক্যারিয়ার, সংসার গোছানোতেই মন ছিলো। তাই সেই সময় তানজিনকে টেষ্ট, রিপোর্ট, ডাক্তার নিয়ে তেমন কিছুই জিজ্ঞেস করেনি, খুলেও দেখেনি রিপোর্ট গুলো। কথা প্রসঙ্গে অবশ্য একদিন তানজিন বলেছিলো, রিপোর্ট সব ঠিক আছে। কোন প্রব্লেম নেই ওদের।

আজাদের মা এখন মেয়ের বাসায়, ওর ছোট বোন নাজের বাচ্চার বয়স মাত্র একবছর। একা সামলাতে পারেনা। তাই মাঝেমধ্যে ওর মা গিয়ে মেয়েকে দেখে আসে। প্রতিদিন দুপুরের লাঞ্চের সময় মাকে ফোন করে খোঁজ খবর নেয়। আজও ফোন করেছিলো। জানতে পারে বোন আগামীকাল কুমিল্লায় যাচ্ছে শশুর বাড়িতে।যাবার আগে মাকে ওর বাসায় নামিয়ে দিয়ে তারপরে চলে যাবে।

সারাদিনের ক্লান্তি শেষে তানজিন অফিস থেকে বের হয়ে আজাদকে ফোন করে। আজ সপ্তাহের শেষ দিন একটু বাহিরে ঘুরে, খাওয়াদাওয়া করে তারপরে বাসায় ফিরবে। আজাদ একবাক্যে রাজি হয়ে যায় বউয়ের কথায়। অন্যদিন হলে অবশ্য আপত্তি করতো। আজ আর করে না, মনে মনে একটা প্ল্যান কষেছে সারাদিন ধরে। সেটাই বলবে তানজিনকে, তাই এককথায় রাজি হয়ে যায়।

খাবারের অর্ডার দেয়ার পড় পড়েই ওদের ভিতরে তুমুলঝগড়া শুরু হয়। আজাদ বাচ্চার কথা তুলতেই তানজিন রেগে একাকার হয়ে যায়। এখন কোনভাবেই মা হতে চায়না। এতোদিন টাকা পয়সা জমিয়ে ফ্ল্যাটের ইনস্টলম্যান্ট দিয়েছে। এখন এক দুই বছর ঘুরবে তারপরে চিন্তা ভাবনা করবে। আজাদ ওর উপর সবকিছু চাপিয়ে দেয় সেটা নিয়েও কথা তোলে। ঝগড়ার এক পর্যায় তানজিন খাবার না খেয়েই বেরিয়ে পড়ে। আজাদ টাকার মায়ায় খাবার নিয়ে বেরিয়ে আসে। দুজন আলাদা আলাদাভাবে বাসায় ফেরে। তারপর থেকে দুজনের বাক্যের মাধ্যমে ভাব বিনিময় বন্ধ।

সকালবেলা তানজিন ব্যাগ গুছিয়ে বাবার বাসায় বেরিয়ে যাবার আগেই শাশুড়ী এসে উপস্থিত, সাথে ওর ননদ নাজ। ননদকে বিদায় করে তানজিন শাশুড়ীর কাছে ঘরের চাবি রেখে বাবার বাসায় চলে আসে কিছু না বলেই।বড় বউয়ের এমন আচরনে আজাদের মা কিছুটা কষ্ট পায়। তানজিন প্রায় সময় আজাদকে এমন দ্বিধাদ্বন্দে  মাঝে ফেলে দেয়। তবে এবার একটু বেশী। মায়ের কাছে তানজিনের রাগের কারনটা বলতে পারেনা, মায়ের ভুলও ভাঙাতে পারেনা। ওর মায়ের ধারণা করে, তার ফিরে আসার কারনেই বৌমা বাবার বাসায় চলে গেছে।আজাদ কোন উপায় না পেয়ে নারীজাতির মহান ব্রতাচার গ্রহণ করে, বুক ফাটে তো মুখ ফুটে না। 

তানজিনের বাবার বাসায় প্রথমদিন ভালোই কাটে। অনেকদিন পরে মেয়ে আসার

তানজিনের বাবার বাসায় প্রথমদিন ভালোই কাটে। অনেকদিন পরে মেয়ে আসার কারনে ওর মায়ের আদিখ্যেতা একটু বেড়ে যায়। একটু পরপর কোমরের ব্যথা বলে কুঁকড়ে উঠে রান্নাঘরে যায়। মেয়ের পছন্দের খাবার রান্না করে। ওর মা সারাক্ষণ বাহিরে বাহিরে থাকে। নানারকম সমাজসেবামূলক কাজের সাথে যুক্ত। মেয়ে আসার কারনে সবকিছু থেকে নিজেকে ছুটি দিয়ে উনুন দেবতার কাছে নিজেকে সমর্পণ করে, আর বাবা অফিসটাকে বাসায় নিয়ে আসে।

পরদিন সকালে তানজিন অফিসে না গিয়ে শুয়ে শুয়ে টিভি দেখেছিলো, আলসেমিটা ওকে ভালোই পেয়ে বসে। তখনই কলিংবেলটা বলে দেয় দরজায় কেউ দাড়িয়ে আছে। বুয়াই দরজা খুলেই চিৎকার দেয়, দুলাভাই আইছে, দুলাভাই আইছে। খালাম্মা মেহমান আইয়া পড়ছে।

আজাদ এসেছে। শনিবার আজাদের অফিস বন্ধ। অন্যান্য সময় বউয়ের অফিস থাকার কারনে এইসময়টা বাসায় আরাম করে ঘুমিয়ে কাটায়। আজ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে শশুরবাড়ি চলে আসে। তানজিন যে আজ অফিসে যায়নি তা ওর মায়ের কাছে ফোন করেই জেনে নেয়। জামাইয়ের ফোন পেয়ে ওর মাও বুঝতে পারে ওদের ভিতরে মান-অভিমানের ঝড় চলছে। আজাদকে এতো সকালবেলা দেখে তানজিন কিছুটা অবাকই হয়। ছুটির দিনে এতো সকাল সকাল উঠার মানুষ আজাদ না।

--বাসায় সবাই ভালো আছে তো।

--আছে।

--তুমি এতো সকালে?? 

--এইদিকে একটা কাজে এসেছি,তাই এখানে এলাম।

--কি কাজ?

--আছে কিছু কাজ।

--ভালো করে গুছিয়ে মিথ্যা কথা বলতে পারোনা। মিথ্যা বলছো চোরের মতো। শোন মিথ্যা কথা বলতে হয় বুক ফুলিয়ে, যেন সবাই বিশ্বাস করে।

--তানজিন বাসায় চলো।মা বাসায় একা, আমার তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে।

--আমি যাবোনা। তুমি চলে যাও।

--যাবেনা মানে, তুমি কি এখানেই থাকবে।

-- হ্যাঁ, এখানেই থাকবো।

--কেন??

--আমার তোমাকে ভালোলাগেনা।

--ভালো না লাগার কারন? হঠাৎ করে আজ বলছো আমাকে ভালোলাগেনা। এটা কি ছেলেখেলা পেয়েছে নাকি।

--সারাজীবন তোমাকেই ভালোবাসবো এমন অঙ্গীকার করিনি তো কখনো।

--এটা কি ধরনের কথা। এতোদিন পরে এসে তুমি আমাকে এমন কথা বলতে পারোনা। সবকিছুই এককথায় শেষ হতে পারেনা।

--আমি যাবোনা, তুমি চলে যাও।

--তাহলে তুমি কি চাও, ডিভোর্স? 

--না, আমি তোমাকে ডিভোর্স দেবোনা কখনও।

--তুমি পাগল হয়ে গেছো তানজিন, পুরোপুরি পাগল। কি বলছো নিজেও জানোনা। 

তানজিন আর আজাদের কথার ফাঁকে ওর মা চা নিয়ে আসে। এসেই বুঝতে পারে মেয়ে জামাইয়ের ঝগড়া হচ্ছে। জামাই বেশ উত্তেজিত, মেয়ে খুবই শান্ত। তার মেয়ে রেগে গেলে খুবই ধীরে ধীরে কথা বলে। তবে কি নিয়ে রাগ সেটা বুঝতে পারেনা। উনি আসায় দুজনেই থেমে যায়। পরিবেশ স্বাভাবিক করতে 
তানজিনের মা তার বেয়াইনের কথা জানতে চায় আজাদের কাছে।

--বেয়াইন বাসায় একা, তাকে নিয়ে আসতে সাথে করে।

--বুয়া আছে, আমি না যাওয়া পর্যন্ত থাকবে।

আজাদ বেশ দাঁত চিবিয়ে কথাগুলো বলে। তারপরে চা টা খেয়ে চলে যায়। তানজিনের দিকে ফিরেও তাকায় না। যাবার পরে ওর মা ওদের ঝগড়ার কারন জানতে চায়। তবে তানজিন পুরোপুরি নিজেকে গুটিয়ে রাখে কিছু বলেনা। দরজা আটকিয়ে নিজের ঘরে বসে থাকে।

এইভাবে সপ্তাহখানেক কেটে যায়। যে যার দৈনন্দিন কাজগুলো চাবি দেয়া পুতুলের মতো করে আর ছুটতে থাকে। সপ্তাহের শেষের দিন আজাদ এসে দাঁড়ায় তানজিনের অফিসে। আজ তানজিনের সাথে ফাইনাল কথা বলতে হবে। কি চায় ম্যাডাম, মনে মনে বলে আজাদ। অনেকদিন পরে স্বামীর ফোন পেয়ে মনে মনে কিছুটা খুশী হয় তানজিন। তবে সামনে গিয়ে রেগে থাকার ভান করে। অনেকদিন পরে স্ত্রীকে দেখে আজাদের বুকের ভেতরে ডামাডোল বেজে ওঠে। কিছুক্ষণ দুজনে কোন কথা বলেনা। কি বলবে, সবই তো বলা সবই তো জানা।তবে আসল সত্যিটা একমাত্র তানজিনই জানে।

--আজ কি বাসায় যাবে??

--না, যাবোনা।

--কেন??

--একটা সমস্যা আছে আজাদ।
 
--কি, সেটাতো বলতে তো হবে, না বললে বুঝবো কিভাবে।

--আমি ডাক্তারের কাছে সব টেষ্ট করেছিলাম। ডাক্তার বলেছে, আমি কখনো মা হতে পারবোনা।

--কবে করিয়ে ছিলে।

--ওই যে করলাম। তোমার মনে নেই। তুমি আমি দুজনেই তো করলাম।

--তাহলে তুমি সেটা আমাকে আগে বলোনি কেন?

--এমনি বলিনি। তুমি কিভাবে নেবে ব্যাপারটা তাই।

--এটা কি ধরনের কথা বলছো, আজকাল মেডিক্যাল সাইন্স কত এগিয়ে গেছে। এটা এখন কোন সমস্যাই না, আমার উপর তোমার বিশ্বাস নেই। হয়েছে অনেক কথা বলেছো, এখন  বাসায় চলো, মা তোমাকে খুবই মিস করছে।

--আমি যাবোনা, তোমার মা আমাকে এই নিয়ে বাজে কথা বলবে। তুমি আমাকে ইগনোর করবে। এইসব আমি মেনে নিতে পারবোনা।

--তোমাকে কেউ কিছু বলবেনা, আমরা ডাক্তার দেখাবো। দরকার হলে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করাবো।তোমাকে ছাড়া আমার ভালো লাগেনা বাসায়, একা একা লাগে।

--আমি এই নিয়ে ডাক্তার, বিদেশ কোথাও যেতে চাইনা। বলতে পারো আমার এতো ধৈর্য্য নেই। আর এই নিয়ে কথাও বলতে চাইনা। আমাকে মাফ করো।

--আচ্ছা ঠিক আছে, এই নিয়ে পড়ে ভাবা যাবে। তুমি বাসায় চলো তো।

তানজিন চুপ করে থাকে, আজাদ ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবে নিয়েছে। এখন আর কোন সমস্যা নেই মনে মনে ভাবে।

--শুধু কি মা? তুমি করছো না?

--বাসায় গেলেই বুঝবে। কে কে তোমাকে মিস করেছে। এবার চলো।

আজাদের দুষ্ট চাহনি বলে দেয় কে কিভাবে ওকে মিস করেছে। তানজিন চোখে নামিয়ে নেয়। ওই চাহনি কেমন যেন ওর এলোমেলো লাগে। কতটা নিঃসঙ্গ প্রহর কাটিয়েছে ওরা দুজনে সেটা ওদের নিরবতার সলাজের চাহনি বলে দেয়।

-- দাঁড়াও মাকে ফোন করে বলি আমি বাসায় যাচ্ছি। তা না হলে চিন্তা করবে। পরে গিয়ে কাপড়গুলো নিয়ে আসবো।

--আগামীকাল নাজ ওর শশুর বাড়ী থেকে ফিরছে। বিকেলে ফোন করেছিলো। মাকে নাকি আবার নিয়ে যাবে।আমি বলেছি কয়দিন পরে যাবে।

--ঠিক বলেছো, নিজের বাচ্চা নিজে এবার একটু লালনপালন করুক। সারাক্ষণই মাকে নিয়ে টানাটানি। মেয়ের তো একবছর হয়ে গেলো।

আজ আবার দুজনে একসাথে বাসায় ফিরছে, আগের মতো খুনসুটি করতে করতে। তবে আজাদ ভিতরে ভিতরে ছটফট করতে থাকে। এইকথা এতোদিন ওর কাছে গোপন করে রাখলো। তানজিন কখনোই কিছু লুকিয়ে রাখেনা ওর কাছ থেকে, নিজের সমস্যা তাই হয়তো লুকিয়ে রেখেছে, মনে মনে তাই ভাবে আজাদ।

পরেরদিন শুক্রবার সকালে আজাদ বেশ আয়েশ করে বউ আর মাকে নিয়ে সকালের নাশতা করতে বসেছিলো, তখনই ফোনটা আসে। দাউদকান্দিতে একটি প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশের খাদে পড়ে যায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই গাড়ীটি ওর বোন নাজের। আজাদ, তানজিন ছুটে যায় দুর্ঘটনাস্থলে, সিলেট থেকে ওর ছোট ভাইও ছু

পরেরদিন শুক্রবার সকালে আজাদ বেশ আয়েশ করে বউ আর মাকে নিয়ে সকালের নাশতা করতে বসেছিলো, তখনই ফোনটা আসে। দাউদকান্দিতে একটি প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশের খাদে পড়ে যায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই গাড়ীটি ওর বোন নাজের। আজাদ, তানজিন ছুটে যায় দুর্ঘটনাস্থলে, সিলেট থেকে ওর ছোট ভাইও ছুটে আসে। কিন্তু সবার আসার আগেই নাজ আর ওর স্বামী ঘটনাস্থলেই মারা যায়। বেঁচে থাকে শুধু ওদের একবছরে মেয়ে তিতলী।

এতো বড় দুর্ঘটনায় পুরো পরিবার একেবারে ভেঙে পড়ে। তানজিন অফিস থেকে ছুটি নিয়ে তিতলীকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মেয়ের মৃত্যুতে ওর শাশুড়ী অসুস্থ পুরোপুরি  হয়ে পড়েছে। এতো ছোট বাচ্চাকে সামলানোর আর কেউ নেই।দিন গড়িয়ে মাসে যায়, আস্তে আস্তে সবকিছু একটু একটু করে স্বাভাবিক হয়ে আসে। তানজিন আবার ওর অফিস শুরু করে। সারাদিন তিতলী নানুর কাছে থাকে, আর মামী ফিরলেই মামীর কোলে গিয়ে সারাদিনে সব অভিযোগ ওর আহ্লাদী শিশুতোষ সুরে বলতে থাকে। তিতলী কারনে পুরো বাড়ীটা আবার নতুন করে সেজে উঠে। তানজিন তিতলীর মাঝেই ওর সবকিছু  খুঁজে পায় আর ধীরে ধীরে ওর মামী ডাকটা মা তে চলে আসে।

একদিন তানজিনের বাসায় তিতলীর অভিভাবকত্ব নিয়ে পারিবারিক মিটিং হয়। সেখানে তানজিন আর আজাদ তিতলীকে ওদের মেয়ে হিসাবে গ্রহণ করে। আজাদ মনে মনে খুশী হয়, তানজিনের মাতৃত্বের স্বাদ পূরন হওয়ার জন্য। ওর মতো এমন এলোমেলো, খামখেয়ালি, ঝগড়ুটে মেয়েটা মা হয়ে কেমন যেন গোছানো হয়ে গেছে। সারাক্ষণই তিতলীকে নিয়ে চিন্তা। দেখতে দেখতে তিতলীর একবছর গড়িয়ে দুই বছরে গিয়ে পড়ে।তিতলী এখন আধো আধো করে অনেক কথা বলে।

অন্যদিকে আজাদ একটু একটু করে তানজিনের কাছ থেকে দুরে সরতে থাকে। স্বামীর কোন কাজে এখন আর তেমন গায়ে মাখায় না তানজিন, ওদের সম্পর্কটা এখন অনেকটা দুইপাশে দাড়িঁয়ে থাকা দেয়ালের মতো হয়ে গেছে।পাশাপাশি আসি, পাশাপাশি থাকবো সারাজীবন, তবে কোনরকম কেমিস্ট ছাড়াই। এইদিকে ওর শাশুড়ী বাচ্চা নেয়ার জন্য চাপ দিতে শুরু করে। আজাদ শুনেও না শোনার ভান করে।একদিন তানজিন রাগের মাথায় শাশুড়ীকে সব খুলে বলে শাশুড়ীর মুখ বন্ধ করায়। মায়ের বাচ্চা নিয়ে  কথাবলা এতো দ্রুত বন্ধ করার জন্য মনে মনে বউকে  ধন্যবাদ দেয় আজাদ।

আজাদের অফিসে নতুন একটা মেয়ে এসেছে,নাম তুলি। মাঝেমাঝে মিটিংয়ে বের হলে  মেয়েটা সাথে নিয়ে যায়। কয়েকদিনে মধ্যে ওদের  ভিতরে একটা কমফোর্ট জোন তৈরি হয়ে যায়। আজাদ ওর কথা বলে তুলি ওর। অন্তরঙ্গতা বাড়ে দুজনের ভেতরে,তবে বাহিরে সমান্তরাল ধারায় এগিয়ে যায় সম্পর্কটা। অফিসের নাম করে  কিছুদিন আগে দুজনে থাইল্যান্ডে ঘুরে আসে।ব্যাপারটা তেমন কেউ টের পায়না।

 তানজিনের হঠাৎ করে পাগলামি পেয়ে বসে। তিতলীর জন্য একটি খেলার রুম লাগবে। আজাদ তো খুঁজে পায়না কিভাবে তিতলীর জন্য খেলার রুম আনবে ওদের ১৫৫০ স্কয়ার ফিটের বাসায়। পরে মেয়ের মা সেটার সমাধান করে। ওদের বাসায় একটি রুম আছে ছোট। যেখানে ওদের সব বইপত্র দিয়ে ঢাসা। যার অধিকাংশই নষ্ট হয়ে গেছে। সেগুলো ফেলে দিয়ে রুমটাকে নতুন করে ডেকোরেশন করতে বলে আজাদকে। বউয়ের কথা মতো ছুটির দিনের সকালে পরিষ্কার পরিচ্ছনতা অভিযানে নেমে পরে আজাদ। ধীরে ধীরে সব ফেলে দিয়ে রুমটাকে নির্ঝঞ্জাট করে তোলার মুহূর্তে ওর হাতে আসে কিছু ডাক্তারী রিপোর্ট। যার উপরে ওর নাম লেখা।একটু উৎসাহী হয়ে খোলে রিপোর্টটা।যার ভিতরে ডাক্তারী ভাষায় অনেক কিছু লেখা, যার কিছু আজাদ বোঝে কিছু একটু কম বোঝে। লাল কালি দিয়ে আবৃত একটি জায়গায় ওর চোখ আটকে যায় "ওলিগোসপারমিয়া"।
 
আজাদ কিছুসময় চুপচাপ বসে থাকে ওর রুমে। তুলি দুইদিন আগে ওকে একটি কথা বলেছে। সেইজন্য দুইদিন যাবত ওর কাজকর্ম সব এলোমেলো তাহলে তুলি এক্সপেক্টিং হয় কিভাবে? তুলি কাছে ওই কথা শোনার পর থেকে ওর ঘুম হারাম হয়ে গেয়েছে, কিভাবে কি করবে সেই ভেবে। এখন এই রিপোর্ট তো ওকে পুরোপুরি মাঝ সমুদ্র ফেলে দিলো। কাকে বিশ্বাস করবে, তুলির কথা না তানজিনের রিপোর্ট।
 
তানজিন কি এতোদিন নিজের সমস্যা বলে ওর সমস্যা লুকিয়ে রেখেছিলো। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে? আগে বললে কি হতো, তাই ভাবতে থাকে আজাদ। হয়তো আরো আগেই চিকিৎসা শুরু করতো ওরা, দুজনে এতো দুরে সরে আসতোনা নিজেদের কাছ থেকে। এখনই তানজিনকে জিজ্ঞেস করতে হবে, কেন এতোদিন লুকিয়ে ছিলো এই রিপোর্ট। ওর এই খামখেয়ালিপানার জন্যই আজ এই দশা। আজাদ রেগে যায় তানজিনের উপর। মায়ের রুমে আছে ওরা,তিতলী খেলছে ওখানে। তবে রুমে ঢোকার আগে আজাদ থমকে দাড়িয়ে যায় ওর বউ আর মায়ের কথপোকথনে।
 
--তুৃমি অনেক মহৎ বউমা। আগে তোমাকে আমি অনেক ভুল বুঝতাম। তোমার মতো এমন ত্যাগ কেউ করবেনা।

--আমি মহৎ কিনা জানিনা মা। তবে আমি আমার স্বামীকে তার অক্ষমতার জন্য কষ্ট দিতে চাইনি। আজাদ অনেক খুঁতখুঁতে স্বভাবের  একটা মানুষ। নিজেকে সবসময় পারফেক্ট দেখতে চায়। সেই মানুষটা যদি জানে পারে, ও কখনও বাবা হতে পারবেনা। তখন একেবারেই ভেঙ্গে পড়তো। আমি ওকে ভেঙ্গে পড়তে দিতে চাইনি আর কখনও দেবো না।সারাজীবন আগলে রাখবো এভাবে।

আজাদ পর্দার ফাঁক দিয়ে তানজিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। দেখে ওর জন্য মায়া ভরা দৃষ্টি  নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক নারী, যে তার মাতৃত্বের আজন্ম ইচ্ছাকে ভালোবাসার জন্য জলাঞ্জলী দিয়েছে। আর তুলি সে কি বলছে,
প্রতারণা না স্বার্থসিদ্ধি।

লেখক : সমাজসেবী ও লেখিকা।

সংশ্লিষ্ট বিষয়

গল্প ইশরাত জাহান

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
Page rendered in: 0.1635 seconds.