ছবি : সংগৃহীত
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন অধ্যাপক ড. মাকসুদ কামাল। দেশে শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং শিক্ষকদের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছেন। এক সাক্ষাৎকারের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন অধ্যাপক ড. মাকসুদ কামাল।
উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) হিসেবে আপনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী?
ঢাবি প্রো-ভিসি ড. মাকসুদ কামাল: এ পদে আমাকে নিয়োগ দেয়ার জন্য প্রথমেই রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও একাডেমিক সব পদেই ছিলাম। পাশাপাশি বহু দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছি। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমার রিসার্চ কোলাবোরেশন রয়েছে। বৈশ্বিক উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতার আলোকে আমার প্রধান লক্ষ্য থাকবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষকে সামনে রেখে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্তঃসম্পর্ক বাড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রমকে যুগোপযোগী করা। এছাড়া একাডেমিক ক্যালেন্ডার আরও নিয়মতান্ত্রিক ও সময়বদ্ধ করা, ইন্ডাস্ট্রি-ইউনিভার্সিটি-সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করে একটি বাস্তবধর্মী গবেষণাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করা। যাতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা গবেষণা কাজে উৎসাহবোধ করেন। বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের স্বার্থে প্রযুক্তিনির্ভর লাইব্রেরির আধুনিকায়নসহ সব শিক্ষা-উপকরণের সুবিধা বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। গবেষণাকর্মের জন্য গবেষণা যন্ত্রপাতি ও আর্থিক জোগান প্রদানও আমাদের দীর্ঘদিনের লক্ষ্য। বিভিন্ন বিভাগ ও ইন্সটিটিউটের শিক্ষা কারিকুলাম ও শিক্ষাবান্ধব পরিবেশকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে আসা, যাতে করে শিক্ষার্থীরা শুধু বাংলাদেশের বাজারেই নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও প্রতিযোগিতা দিয়ে চাকরি পেতে পারে, উদ্যোক্তা হতে পারে, এ ধরনের একটি মৌলিক ও প্রায়োগিক শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি করা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতা কী কী বলে আপনি মনে করেন?
ঢাবি প্রো-ভিসি ড. মাকসুদ কামাল: প্রতিবন্ধকতা খুব বেশি আছে বলে আমি মনে করি না, দরকার বাস্তবধর্মী এবং আমাদের যা কিছু আছে সেগুলো গুছিয়ে এনে উদ্যোগ নেয়া। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু শিক্ষক আছেন যাদের আন্তর্জাতিক মানসম্মত জার্নালে অসংখ্য গবেষণা প্রবন্ধ আছে। প্রথম প্রতিবন্ধকতা হিসেবে যেটি আমার নজরে এসেছে, তা হল গবেষণার জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ এবং গবেষণা উপকরণের স্বল্পতা রয়েছে। এগুলো পূরণ করা গেলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বহুলাংশে গবেষণামুখী হবে।
দ্বিতীয়ত, উন্নত বিশ্বের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের যুগোপযোগী কার্যকর গবেষণা সহযোগিতারও স্বল্পতা রয়েছে। উল্লিখিত দুটি বিষয় পূরণের জন্য প্রয়োজন সময়মতো আর্থিক জোগান। ঘাটতিগুলো পূরণ করার মধ্য দিয়ে মানসম্মত গবেষণা কার্যক্রম বাড়ানোর চেষ্টা করব। ইন্ডাস্ট্রি ইউনিভর্সিটির সম্পর্ক আরও জোরদার করার মাধ্যমেও গবেষণার সংখ্যা ও মান বাড়ানো সম্ভব। বিভিন্ন একাডেমিক ও প্রশাসনিক পদের বিপরীতে Key Performance Indicator (KPI) নির্ধারণ করে একটি সমন্বিত ও বাস্তবমুখী নীতিমালা তৈরির চেষ্টা করব।
বর্তমানে অনলাইন ক্লাস নিয়ে ঢাবির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে। এগুলো থেকে উত্তরণের পথ কী?
ঢাবি প্রো-ভিসি ড. মাকসুদ কামাল: করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হওয়ার পরপরই স্বল্প পরিসরে অনেক বিভাগ/ইন্সটিটিউট অনলাইন ক্লাস শুরু করে। অনেকে এখন আবার শুরু করতে যাচ্ছে। এ বিষয়ে উপাচার্যের সভাপতিত্বে ২৫ জুন বিভিন্ন অনুষদের ডিন ও বিভাগীয় চেয়ারম্যানের সঙ্গে সভা হয়েছে। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ থেকে পরিকল্পিতভাবে অনলাইন ক্লাস শুরু করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আমাদের সিংহভাগ শিক্ষার্থী গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করছে, যাদের অনেকের স্মার্টফোন নেই, বিদ্যুতের অসুবিধা রয়েছে। আবার দুটোই আছে কিন্তু নেটওয়ার্কের বাইরে, আবার কিছু শিক্ষার্থী আছে যাদের ডাটা কেনার সামর্থ্য নেই। ইতোমধ্যে আর্থিকভাবে দুর্বল শিক্ষার্থীদের অসুবিধা দূর করার জন্য বিভিন্ন বিভাগ, বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক সংগঠন, শিক্ষক সমিতি ও অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন পদক্ষেপ নিয়েছে। এরপরও যারা আর্থিকভাবে অসুবিধায় রয়েছে তাদের এ অসুবিধা দিয়ে আমরা অনলাইন ক্লাসে যাচ্ছি। বর্তমান সরকারের সময়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারে বাংলাদেশ বহুদূর এগিয়ে। আমাদের বসে থাকার কোনো সুযোগ নেই। তবে অনলাইন শিক্ষায় ইন্টারনেট ফি কমাতে হবে। অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যোগসূত্রতা স্থাপন করে তাদের শিক্ষা কার্যক্রমে নিয়ে আসা এবং মানসিকভাবে উজ্জীবিত রাখা আমাদের দায়িত্ব।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা সঠিক সময়ে তাদের পরীক্ষার ফলাফল পায় না। ফলাফল প্রকাশের দীর্ঘসূত্রতা কাটানোর জন্য আপনি কী পদক্ষেপ নেবেন?
ঢাবি প্রো-ভিসি ড. মাকসুদ কামাল: বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু বিভাগে দু’জন করে শিক্ষক খাতা মূল্যায়ন করেন। দু’জন শিক্ষকের খাতা মূল্যায়নে যদি ২০ শতাংশের বেশি নম্বরের ব্যবধান হয় তাহলে পুনরায় মূল্যায়নের জন্য তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে যায়। এভাবে মূল্যায়নের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে লম্বা সময় লেগে যায়। খাতা মূল্যায়নে বিলম্ব বা অন্যান্য মেকানিজমের দুর্বলতার কারণে ফলাফল পেতে বিলম্ব না হওয়ার বিষয়ে আমি সব অনুষদের ডিনদের সঙ্গে আলোচনা করে একটি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করব। তবে বর্তমান সময়ে ফলাফল প্রকাশের দীর্ঘসূত্রতা বহুলাংশে কমে এসেছে। আমরা এটিকে আরও সময়োপযোগী ও শিক্ষার্থীবান্ধব করব। ইতোমধ্যে পরীক্ষা কার্যক্রম Automation প্রক্রিয়ায় আনার মধ্য দিয়ে ফলাফল প্রকাশের দীর্ঘসূত্রতা হ্রাস পাওয়ার পথে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে নানা ধরনের অভিযোগ পাওয়া যায়। মানসম্পন্ন ও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগের জন্য আপনার পরিকল্পনা কী?
ঢাবি প্রো-ভিসি ড. মাকসুদ কামাল: শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যথেষ্ট স্বচ্ছতা আছে, তথাপিও অনেক সময় কথা ওঠে। প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা যেন আরও নিশ্চিত করা যায়, সেদিকে আমার দৃষ্টি থাকবে। আমি মনে করি, পরীক্ষার ফলাফলের পাশাপাশি কোনো candidate-এর প্রকৃত মূল্যায়নের জন্য যে বিষয়গুলো দেখা দরকার তা হল গবেষণার গভীরতা, উপস্থাপনায় সাবলীলতা ও দক্ষতা এবং শিষ্টাচার। উপস্থাপনার দক্ষতা ও মেধা যাচাইয়ের জন্য মৌখিক ইন্টারভিউয়ের পাশাপাশি দরকার সময় নিয়ে বিষয়ভিত্তিক প্রেজেন্টেশন গ্রহণের ব্যবস্থা করা। আমি চেষ্টা করব entry point-এ নিয়োগের ক্ষেত্রে বর্তমান নীতিমালাকে আরও স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য করা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষকের রিসার্চ পেপার সমৃদ্ধ নয় এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে পিএইচডি ছাড়াও অনেক শিক্ষক অধ্যাপক হয়ে যাচ্ছেন। বিষয়গুলো আপনি কীভাবে দেখছেন?
ঢাবি প্রো-ভিসি ড. মাকসুদ কামাল: বর্তমানে পদোন্নতি বা পদায়নের যে নীতিমালা আছে, বৈশ্বিক বিবেচনায় তার সংস্কার করা সময়ের দাবি। উন্নত বিশ্বে এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও পিএইচডি ব্যতীত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় প্রাথমিক পর্যায়েই নিয়োগপ্রাপ্ত হয় না। পদোন্নতির জন্য অবশ্যই প্রয়োজন উচ্চতর গবেষণা ডিগ্রি এবং মানসম্মত জার্নালে প্রকাশনাসহ গবেষণা কার্যক্রম। পদোন্নতির জন্য বর্তমান নীতিমালায় পরিবর্তন আনা অনস্বীকার্য, তা না হলে আমরা বহির্বিশ্ব থেকে পিছিয়ে যাব।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিং নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। র্যাঙ্কিং ভালো করার জন্য আপনি কী পদক্ষেপ নেবেন?
ঢাবি প্রো-ভিসি ড. মাকসুদ কামাল: যদিও র্যাঙ্কিয়ের ধারণা কর্পোরেট জগত থেকে আসা, কিন্তু বাজার এবং জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির এ যুগে উক্ত ধারণাকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যে সব সূচকের ওপর ভিত্তি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিং করা হয় তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে- বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক আউটলুক, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত, পিএইচডিধারী শিক্ষকের সংখ্যা, শিক্ষকদের গবেষণা কাজ ও সাইটেশনের সংখ্যা, বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বরাদ্দের পরিমাণ ও মূল বরাদ্দের সঙ্গে এর অনুপাত এবং গ্র্যাজুয়েটদের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা, বিদেশি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ইত্যাদি। ইন্ডাস্ট্রি-ইউনিভার্সিটি সম্পর্ক এবং র্যাঙ্কধারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে কার্যকর গবেষণা কোলাবোরেশন, এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামও গুরুত্ব বহন করে। র্যাঙ্কিংয়ের এ সূচকগুলোর প্রতিটির ক্ষেত্রে আমাদের দুর্বলতা আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষকে সামনে রেখে ঘাটতিগুলো পূরণের জন্য ইতোমধ্যে সব পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোপূর্বে অনুষদের ডিনসহ বিভিন্ন দায়িত্বে থাকার কারণে বিষয়গুলোর ব্যাপারে আমি অবগত আছি। আশা করি, পরিকল্পনাসমূহ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে শতবর্ষী এই বিশ্ববিদ্যালয়কে নিকট ভবিষ্যতে উচ্চতর মর্যাদায় উন্নীত করতে আমরা সক্ষম হব। প্রয়োজন শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি, শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং অ্যালামনাইসহ সবার সহযোগিতা। এক্ষেত্রে চীনের চি-নাইন বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের উদাহরণ আমরা অনুসরণ করতে পারি।
উল্লেখ্য, অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল ২০০০ সালে ঢাবির ভূতত্ত্ব বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। এর আগে তিনি বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠানের (স্পারসো) বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে ছয় বছর কর্মরত ছিলেন। ২০১২ সালে তিনি আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদভুক্ত দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হন। আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদের নির্বাচিত (চারবার) ডিন হিসেবে তিনি দায়িত্বে আছেন। মাস্টারদা সূর্যসেন হলের প্রাধ্যক্ষ হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট ও সিনেট সদস্য ড. মাকসুদ কামাল ঢাবি শিক্ষক সমিতির তিনবার সাধারণ সম্পাদক এবং চারবার সভাপতি পদে নির্বাচিত হন। অধ্যাপক মাকসুদ কামাল বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিব ছিলেন এবং সভাপতি (পরপর তিনবার) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।