কাকন রেজা। ফাইল ছবি
কাকন রেজা:
আমাদের দেশে ঘৃণার এক অদ্ভুত সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। একজন মানুষ মারা যাবার সাথে সাথে শুরু হয়ে যায় এই সাংস্কৃতিক মচ্ছব। হেফাজত প্রধান আহমদ শফীর মৃত্যুর পর আমরা যার নজির দেখেছি সামাজিকমাধ্যমে। মৃত্যু নিয়ে তাৎক্ষণিক ট্রল করাও এক ধরনের ‘ক্যানিবালিজম’। মৃত্যুকে প্রতিহিংসার জয় হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত যে সমাজ, সে সমাজ ‘ক্যানিবাল’।
আহমদ শফীর মৃত্যুর পরপরই সামাজিকমাধ্যমে একজনের স্ট্যাটাস পরবর্তী রিয়েকশনগুলি পড়ছিলাম। আমার পড়া পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ছয়’শ কমেন্ট ছিলো। যার মধ্যে গোটা বিশেক কমেন্ট ছিলো সেই স্ট্যাটাসের সাথে সহমত পোষণ করে। আর বাকিগুলো, সে কথা আর নাই বললাম।
একজনের মৃত্যুর সাথে সাথে তার বিরুদ্ধচারণ করে সামাজিকমাধ্যমে স্ট্যাটাস দেয়া মূলত ‘ক্যানিবাল’ চিন্তারই ফসল। আহমদ শফী মারা গেছেন। তার দাফন-কাফন শেষ হয়নি। ধর্মনিরপেক্ষদের উচ্চারণে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়নি। সে সময়টুকুও অপেক্ষা করা গেলো না! ভেতরের পুষে রাখা কুৎসিত প্রতিহিংসাকে আর মানানো গেলো না। উল্লাসধ্বনিকে তাৎক্ষণিক কৌশলী আলোচনার মোড়কে স্ট্যাটাস হিসেবে প্রকাশ করা হয়ে গেলো। এমন প্রকাশ ‘ক্যানিবাল’। এমন উল্লাসের চিন্তা ‘ডগমাটিক’।
জীবিত অবস্থায় আহমদ শফীর কাজকে তার পক্ষের লোকজন ভালো বলেছেন, অন্যপক্ষ বলেছেন খারাপ। কিন্তু মৃত্যুর সাথে সাথে এই বাহাস শুরু করে দেয়া বোকামি। আর আমাদের দেশে ভালো খারাপ ক্ষণে-ক্ষণে পরিবর্তনীয়। যারা আহমদ শফীকে ‘তেঁতুল হুজুর’ বলে নিন্দা করেছেন, তারাই মৃত্যুর পর তাকে ন্যায়ের পক্ষে নিরাপোস বলে প্রশংসা করেছেন। অর্থাৎ সময়ের ফেরে তেঁতুলের টক মিস্টিতে রূপান্তরিত হয়ে উঠেছিল।
হাটহাজারির চলমান ঝামেলা নিয়ে একজন বলছিলেন, ‘এক সময় শফী হুজুরের পক্ষে বললে ব্যাটন খাওয়ার সম্ভাবনা ছিলো আর এখন বিপক্ষে বললে।’ তাই বলি, আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ভালো-খারাপের পরিবর্তন হয় ক্ষণে-ক্ষণে। এরশাদের বেলায় যেমন হয়েছিল। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে আমাদের মতন অনেকেই তাদের যৌবনের রঙিন দিনগুলিকে উৎসর্গ করেছিলেন। গণতন্ত্র উদ্ধারের জন্য জীবনবাজি রেখেছিলেন। এখন তাদের পদে পদে প্রশ্ন ও বিস্ময় জাগে, কী লাভ হলো সেই দিনগুলিকে জলাঞ্জলি দিয়ে! তার চেয়ে যৌবনের রঙ উপভোগ করাটাই ভালো ছিলো।
শাপলা চত্বর ঘটনার আগে-পরে কারো কাছে শফী হুজুর মানেই ছিলেন র্যাডিকেল ইসলামের প্রতীক। অন্যদের কাছে দুঃশাসনকে রুখে দাঁড়াবার আইকন। অথচ দেখতে দেখতে সেই অবস্থান পুরোপুরি উল্টে গেলো। মৃত্যুর আগে নিজ লোকের কাছেই বিতর্কিত হয়ে উঠলেন আহমদ শফী। আর বিপক্ষের লোকের কাছে হয়ে উঠলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিরাপোস এক মানুষ। এখন অবশ্য আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন তাহলে ‘অন্যায়’ বিষয়টি আসলে কী? আমাদের দেশে এর উত্তর দেয়া শুধু কঠিন নয়, অসম্ভবও বলতে পারেন।
অনেকেই বলেন, শুদ্ধ ও অশুদ্ধের মধ্যে নাকি তিল পরিমাণ পার্থক্য নেই। আমাদের ধর্ম ও সংস্কৃতিতে যা অশুদ্ধ। অন্য ধর্ম ও সংস্কৃতিতে তার অনেকটাই শুদ্ধ। ‘অন্যায়’ বিষয়টিও সেরকম। আমাদের এখানে ‘লিভিং টুগেদার’ অন্যায়। পশ্চিমে এটা সিদ্ধ। আমাদের সমাজ পিতৃতান্ত্রিক, ট্রাইবাল সমাজ মাতৃতান্ত্রিক। তাদের ছেলেমেয়েদের নামের শেষে যোগ হয় মায়ের পদবি।
আমাদের রাজনীতিটাও সে রকম। এখানে শুদ্ধ-অশুদ্ধ, ন্যায়-অন্যায় গুলিয়ে যায় ব্যক্তি ও দলের মধ্যে। আপনার রাজনীতির সাথে রয়েছেন, অতএব সে ভালো। আগে কী করেছেন তা দেখার বিষয় নেই। এখন কী করছেন তাই বিবেচ্য। তবে ঝামেলা বাঁধে আকামে আটকে গেলে। যেমন সাহেদ-সাবরিনা-শামীম-সম্রাটরা। আকামে ধরা খেয়েছেন, ফলে হয়ে গেছেন অনুপ্রবেশকারী। আর ধরা না পড়লে, ‘চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা’।
হেফাজত প্রধান মাওলানা আহমদ শফীর মৃত্যুকে ঘিরেই দেখেন কতজনের কতরকম চেহারা দৃশ্যমান হলো। ‘তেঁতুল হুজুর’ বলে যাকে ব্যঙ্গ করা হয়েছে, সেও মিষ্টি হয়ে গেলেন। তবু এটা খারাপ নজির নয়। মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে কুতর্কের বিপরীতে এটাও একটা শিক্ষার বিষয়। যারা মারা গেছেন, তাদের নিয়ে যাতে তাৎক্ষণিক কুতর্ক শুরু না হয় বার্তাটা এমনি হওয়া উচিত। আমাদের সাংস্কৃতিক রীতি হলো মানুষের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ। না পারলে চুপ থাকা। নিজেদের রীতি-রেওয়াজটা মেনে চলাই উত্তম। সময় তো রয়েছেই একজন মানুষের কাজের মূল্যায়ন করার জন্য। আর চটচলদি প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে তা সময়ের হাতেই ছেড়ে দেয়া উচিত।
পুনশ্চ: চটচলদি প্রতিক্রিয়ায় অনেক সময় বিপাকে পরতে হয়। ‘না’ কে ‘হ্যাঁ’-তে রূপান্তর কিন্তু লজ্জা ও বেদনার।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামনিস্ট।