কাকন রেজা। ফাইল ছবি
কাকন রেজা:
প্রথম আলো’য় প্রকাশিত আমার একটি কলামে বলেছিলাম, ‘যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেউ তা পোস্ট করে এবং ভাইরাল হয়, তখন আমাদের গাত্রোত্থান ঘটে। ‘চোর গেলে বুদ্ধি বাড়ে’র মতো। আমাদের গণমাধ্যমগুলো তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পিছু পিছু ছোটে।’ আমার জেলা শেরপুরে এক গর্ভবতী নারীকে গাছে বেঁধে পেটানোতে তার গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই বলেছিলাম। ঘটনা ঘটে যাবার বেশ কয়েকদিন পর সামাজিকমাধ্যমে ভাইরাল হলে বিষয়টি ‘কর্তৃপক্ষে’র নজরে আসে!
নোয়াখালীর নারী নির্যাতনের ঘটনায় অনেক প্রতিবাদ চোখে পড়ছে। এ ঘটনাও ঘটে যাবার বত্রিশ দিন পর নজরে এসেছে। তাও সেই ভাইরালের কৃপায়। হায় ভাইরাল, হায় প্রতিবাদ। এর প্রতিবাদে যাদের মাঠ কাপিয়ে দেয়ার কথা। আল্টিমেটাম ছুড়ে দেয়ার কথা, তাদের আজ দেখা যাচ্ছে না। অথচ তিলকে তাল করে তা দিয়ে পিঠা বানাতেও ওস্তাদ তারা। সেই ওস্তাদজনদের আজ দেখা নেই। তাদের মধ্যে দু’একজন যারা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছেন তারাও বিষয়টিকে নানা কিছুর সাথে পেঁচিয়ে ফেলছেন। উদ্দেশ্যটা হলো কাঁচিয়ে ফেলা। অর্থাৎ প্রকাশটাকে ভিন্ন করে দিয়ে, দৃষ্টি আর চিন্তাটাকে বিভক্ত করে দেয়া। আর বিভক্তির পরিণতি তো সবারই জানা ও দেখা।
কিছু প্রতিবাদ আবার প্রশ্নের উদ্রেক করে। মনে হয়, আমরা কাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছি। নির্যাতন বন্ধের দাবি মূলত কার কাছে। আপনিও নিজের ভেতর প্রশ্নটা তুলে দেখুন, উত্তর কী আসে। তবে কি আমরা প্রশ্ন করতে এবং দাবি জানানোর দিক আর কৌশলটাও ভুলে গেছি! ভুলে গেছি প্রতিবাদের ভাষা, স্লোগানের বাণী! এক দিনাজপুরের ইয়াসমিন এক সময় আমাদের ঐক্যবদ্ধ করেছিলো। এক ইয়াসমিন। এখন শত ইয়াসমিন লাঞ্ছিতা হয়, নির্যাতিতা হয়, খুন হয়। আড়ালে নয় প্রকাশ্যে হয়। শুধু তাই নয় সেই বিভৎসতার ছবি আবার গর্বভরে সামাজিকমাধ্যমে পোস্ট করে নির্যাতকরা স্বয়ং। জানান দেয় তাদের নিষ্ঠুরতা আনলিমিটেড। ভাবা যায়, যায় না।
কেন যেন মনে হয় স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন ছিলো ভুল। আমাদের যৌবনের সোনালী দিনগুলোকে বিসর্জন দিয়ে আমরা কি এই দেশ দেখতে চেয়েছিলাম? আমাদের পূর্বসুরিরা, যারা দেশকে শৃঙ্খলমুক্ত করতে জীবন দিয়েছিলেন তারা কি এমন দেশ চিন্তা করেছিলেন? এই দেশ কি বিপ্লবী আর শহীদদের? মা’রে আমাদের রক্ত, অশ্রু, ঘাম কি বৃথা গেলো? জানি না। এমন প্রশ্নের উত্তর জানা নেই। আর যে উত্তর জানা রয়েছে তাতেও কোনো প্রশ্ন নেই। রয়েছে শুধু শঙ্কা। রয়েছে ভয় আর অনিশ্চিয়তা।
নবারুণ ভট্টাচার্য আমাদের দেশে জন্মালে হয়তো আবার নতুন করে লিখতেন, ‘ভয়ের ফ্যাকাশে মুখ কেমন অচেনা লাগে…’। সত্যিই বড় অচেনা লাগে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।