• ০৭ অক্টোবর ২০২০ ১৫:১৯:১২
  • ০৭ অক্টোবর ২০২০ ১৫:১৯:১২
অন্যকে জানাতে পারেন: Facebook Twitter Google+ LinkedIn Save to Facebook প্রিন্ট করুন
বিজ্ঞাপন

‘এখন আমরা পৃথিবীর কবরে বসে মুনকির-নাকিরের অপেক্ষায়’

সোহেল আরমান। ছবি : সংগৃহীত

সোহেল আরমান। পড়ছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের স্নাতকোত্তর পর্বে। শৈশব কৈশোর কেটেছে উত্তরের লালমনিরহাট জেলার হাতিবান্দার কেতকিবাড়িতে। শিক্ষার হাতেখড়ি ওই গ্রামেরই স্কুলে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রবেশের পর দুরন্তপনার সাক্ষী সেই গ্রামে আর সেভাবে থাকা হয়নি। মহামারী করোনা দীর্ঘ সাত মাস ধরে আবার তাকে সেই গ্রামে থাকার সুযোগ করে দিয়েছে। আর এই সময়ে যেসব চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেয়েছে, তাই লিপিবদ্ধ করে রাখার চেষ্টা করেছেন তিনি।

 

খুন

গতকাল রাতে খুন হয়েছে

যে শীর্ণকায় মানুষটি,

সে আমার ভাই।

যার ছায়ার উপর দিয়ে

হেঁটে যেতে পারিনি কখনো,

তার রক্তের উপর দিয়ে হেঁটে গেছি নির্দ্বিধায়।

 

চোখে চোখ রাখতেই দেখি চিরতরে

চোখ বন্ধ করেছে সে লজ্জায়।

এখানে এখন আঁধারের মতোন নীরবতা।

আর এই নীরবতার সাক্ষী হয়ে

দাঁড়িয়ে আছে আমার পরিবার।

 

গতকাল রাতে যে খুন করেছে আমার ভাইকে,

সে আজ অজান্তে খুন করে ফেলেছে গোটা পরিবার।

এখন আমরা পৃথিবীর কবরে

বসে মুনকির-নাকিরের অপেক্ষায়।

 

কাঁটাতার

তোমার আমার বাড়ির মাঝখানে

যে কাঁটাতারের বেড়া,

গত পরশু থেকে সেখানে

ঝুলে আছে এক কিশোরের লাশ।

 

কিশোরের পরিচয় কেউ জানে না।

লাশ দেখতে ভীড় করেছে যে উৎসুক জনতা,

তাদের একজন দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠলো,

তার পরিচয়, সে মানুষ।

 

একটু পরেই, জোরে কান্না করতে করতে

এলো কিশোরের পরিবার।

 

ফল হারানো গাছের মতোন বেদনার

ছাপ পড়েছে মায়ের চোখে-মুখে।

মায়াভরা মৃত চোখে তিনি দেখতে পেলেন

ছেলের খুন হওয়ার দৃশ্য।

 

সেই সাথে তার কানে ভেসে আসলো

একটি দেশের খুন হওয়ার শব্দ।

দেশটির নাম বাংলাদেশ।

 

কিশোরের খুন হওয়ার শব্দ শুনতে পেলেও

দেশটির খুন হওয়ার শব্দ

কখনো শুনতে পাইনি আমি।

তোমার বাড়ি থেকে কি শোনা গেছে?

 

খেলা

প্রেমিকার সাথে আমার মনের

খেলা চলছে বেশ কিছুদিন থেকে।

ভুলে থাকার খেলা

 

গ্রামের দুজন ছোটো কৃষক

শুরু করেছে মামলা মামলা খেলা।

দুজন ব্যবসায়ী খেলছে টাকার খেলা।

কয়েকজন ধর্মান্ধ খেলছে জীবন নিয়ে খেলা।

 

আমরা সবাই দর্শক,

আবার সবাই খেলোয়ার।

আমি অন্যের পরাজয়ে হাসি,

অন্যরা আমার জয়ে কাঁদে।

শুধু ইশ্বরের সাথে খেলায়,

আমরা সবাই মিলে কাঁদি

আর ইশ্বর একাই হাসেন।

 

মৃত

ভালোবাসার অভাবে মরে গিয়েছে যে ফুলেরা

তাদের শহরে আমি একা মানুষ।

হৃদয়ে জমে থাকা কালো কালো রক্তের ছোপ,

এখন ভেসে উঠেছে তাদের পুরো শরীরে।

 

অচেনা মাটিতে মিশে গিয়ে

একেবারেই মরে যাচ্ছে কেউ কেউ।

 

প্রচণ্ড অবহেলার কথা বলতে না পেরে

হার্ট অ্যাটাকে মরে গিয়েছিলো যে ফুলটি,

আমাকে দেখে পরম ভালোবেসে জিজ্ঞাসিলো

মৃত মানুষদের পৃথিবী কেমন?

আমাদের মতোন?

 

চলো মৃত মানুষদের দেখে আসি

 

অনন্তকাল ধরে যে বৃত্তের মাঝে

দাঁড়িয়ে আছি সবে

চলো সেই বৃত্তের বাইরে গিয়ে

দাঁড়িয়ে কথা বলি মানুষের।

 

আমাদের দৃষ্টির সীমানা বাড়িয়ে

দেখি দিগন্তের ওপারে কতো

বরফ দুঃখকে সাথে নিয়ে

মিশে গেছে পৃথিবীর মহাসাগরে।

 

তারপর চলো খুব কাছে গিয়ে

দেখে আসি আমাদের বাঁচিয়ে রাখা

প্রভু কৃষক আর শ্রমিকদের।

চলো দেখে আসি কীভাবে

গাছদের মতোন করুণভাবে

মরে যাচ্ছে তারা মানুষের হাতে।

 

স্মৃতি

একখণ্ড জীবন

উড়ে গেলো মৃদু বাতাসে

আকাশে মেঘেরা হঠাৎ

থমকে দাঁড়ালো

সাধনার অবসান ঘটিয়ে

দুচোখ বন্ধ করলো চাতক

সঙ্গম শেষে

মাত্রই উঠে দাঁড়ালো নববধু

কা-কুহু বন্ধ করে

ধরণীর পানে চেয়ে থাকলো

কোকিল আর কাক।

 

যেনো ফুলেরা

বিবর্ণ হয়ে পড়ে আছে

ভালোবাসার অভাবে,

নদীরা মরে গেছে

দুরন্ত বালকের দেখা না পেয়ে

ক্ষেতের ফসলে ভেসে উঠেছে

তীব্র হাহাকার

পাহাড়ে অরণ্যে শহরে

নেমে এসেছে গভীর নীরবতা।

 

স্বপ্নের দেয়ালে ঘেরা

কোনো মৃত কুটির থেকে

চেয়ে সেই জীবনের দিকে

অপলক স্মৃতির পাহাড়ে

বেজে ওঠে অচেনা সুরে

গাওয়া কোনো বিষাদগীতি।

 

অতলে হারিয়ে যায়

চেনা মুখ, চেনা পৃথিবী;

শুধু স্মৃতিটুকু থাকে চির অম্লান।

 

আম্মা

সাতহাজার মাইল দূরে থেকেও

টেলিফোনের হ্যালো না শুনেই

অপর প্রান্ত থেকে

আম্মা বলে ওঠে,

খোকা, তোর মন খারাপ?

না কি গতরাতে একটুও ঘুম হয়নি?

 

আমি চমকে উঠি!

ছেলের মনের সাথে

আম্মার মনের যোগাযোগ

কখন, কীভাবে হয়?

আমি জানি না।

 

কথা থেমে যায়,

শব্দের বমিগুলো

গিলে ফেলি খুব সন্তর্পনে

হঠাৎ মনে হয়

ভেতরটা ধু-ধু করছে

নেই কোনো কথাদের আন্দোলন।

 

তারপর, বহুদিন

আম্মার মনের কথা

ধরতে চেয়েছি বহুবার

তার ভেতরের দুঃখগুলোকে

বের করে আনতে

যখনই বলেছি,

আম্মা, তোমার কি মন খারাপ?

তখনই সোজা উত্তর,

ধুর বোকা!

আম্মার কি মন খারাপ থাকে!

 

কেবল তোর যখন মন খারাপ থাকে

শুধু তখনই

মনের ওপর দিয়ে বয়ে যায় সাইক্লোন

কে যেন ছটফট ছটফট করে

আর ঘুমাতে পারি না।

কিংবা ঘুমের ভেতর থাকলে

হঠাৎ জেগে উঠি।

 

ধীরে ধীরে হাতে থাকা সময়গুলো

যৌবনা নদীর মতোন

চলে যায় খুব তাড়াতাড়ি।

 

আজকাল বয়সের ভারে

আম্মার কথা চলে চোখের ইশারায়

এখন তাই চোখ জোড়ার দিকে

তাকাতে সাহস পাই না কখনো

ভুল করে যদি চোখে পড়ে যায় চোখ

যদি জানতে চায়,

আমার কি মন খারাপ?

 

দুঃখ বিনিময়

মরি মরি মরি,

কী সুন্দর তোমার ভেতর

তুমি দেহ দিলে আমি মিশে গেলাম,

কাটলো প্রহর।

 

তোমার দেহে এঁকে দেই কতো

পাল তোলা নৌকোর ছবি

শব্দ দিয়ে কবিতা এঁকে

হয়ে যাই রাতের কবি।

 

কতো স্রোতস্বিনী বেয়ে

চলে তোমারই রঙ্গিন চোখে

জাল ফেলে রেখেছি খুব

খামখেয়ালে, অজানা শোকে

আনাড়ি হাত কাঁপে থরোথরো

ছুঁ'তে ভীষণ ডর

ছুঁয়ে দেয়ার পর মরে যাই

আবার তোমার ভেতর।

 

মরে যাই, তুমি বেঁচে ওঠো,

ঠোঁট ওঠে মৃদু কেঁপে

ব্যাকুল হয়ে ঠোঁটে ঠোঁট রেখে

দেই নিজেদের সঁপে

কানে কান লেগে থাকে তবু

ফুলেরা কথা কয় না

তোমার বুকে রেখে দেই

ভালোবেসে আমার সকল যাতনা।

 

বিষাদ

বিষাদ ছুঁয়েছে আজ এই

ঘন বর্ষণের দিনে

তরঙ্গিণী পেয়েছে নতুন জীবন

সুখ আছড়ে পড়ছে গগণে।

 

আমাদের সব কথা,

সব অভিমান আকাশ নিয়েছে কিনে

কিছু অভিমান নিজে পুষে রেখে,

কিছু দিয়েছে আমায় এনে।

 

হৃদয় পুড়ছে ভীষণ অনলে

তোমার চির প্রস্থানে

বিষাদ বেড়েছে তাই ঢেউয়ের

মতোন বৃষ্টির আগমনে।

 

আমি উড়ে যাই, আমি মিশে যাই

ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির ধারায়

তোমার জানালায়, গিয়ে

ফিরে আসি, চোখ মুদে আসে অবসাদে।

 

তোমার শহরে বিষাদ ছুঁয়েছে,

না কি ছুঁ'তে পারেনি কভু?

আমাকে জানার সুযোগ দেয়নি,

তোমার প্রেমিক প্রভু।

 

তবু বিষাদ ছুঁয়েছে আজ

স্বপ্নবাজ পাখিদেরও চোখ

তাদের আর আমার পৃথিবীতে

নেমেছে ভীষণ শোক।

 

মরীচিকা

ডেকে যায় মহাকাল মহাপ্রলয়ের তরে

সবাই চলে যায় পড়ে থাকি একা

গাঁয়ের কৃষকের মতোন মাটি আঁকড়ে ধরে।

 

নক্ষত্রের কাছে আমাদের যত ঋণ

সবটুকু গায়ে মেখে

ভেঙে ফেলি সব অদৃশ্য শৃঙ্খল

ছুঁয়ে ফেলি সব অস্পৃশ্য জঞ্জাল।

 

তারপর পৃথিবীর বুকে

গুহার ভেতরে গুহা এঁকে

ভালোবাসার অজস্র ঘর বানিয়ে

কোটি বছর তোমার সাথে কাটিয়ে

অবশেষে সবকিছু হয়ে ওঠে

মরীচিকার মতোন ফিকে।

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
Page rendered in: 0.1545 seconds.