কাকন রেজা। ফাইল ছবি
কাকন রেজা:
মঈনুদ্দিন-ফখরুদ্দিনের সরকার চালু করেছিল, ‘বেশি করে আলু খান, ভাতের উপর চাপ কমান’- এমন স্লোগান। সে সময় হঠাৎ করে চালের দাম বেড়ে গিয়েছিল বলে তারা এমন স্লোগান প্রবর্তন করেছিলেন। সাথে নানা রকম আলু দিয়ে তৈরি খাবারের রেসিপি নানা ভাবে জানান দিয়ে যাচ্ছিলেন।
এখন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। চালের দাম তো কমেইনি, মাঝখান থেকে বেড়ে গেছে আলুর দাম। পঞ্চাশ টাকা কেজির উপরে বিক্রি হচ্ছে আলু। খ্যাত লেখক মঈনুল আহসান সাবের সামাজিকমাধ্যমে লিখলেন, ‘আলু শুনলাম ভাগে বিক্রি হচ্ছে। যেমন বড় সাইজের আলু কেটে দুজন করে নিচ্ছেন।’ এখন সম্ভবত ‘বেশি করে আলু খান’ এমন কোনো স্লোগান চালু করা সম্ভব না। বিকল্প খাদ্যের দিকে ঝুকতে হবে। সেই বিকল্প খাদ্যটা কি? জানা মতে, তেমন বিকল্প আছে কি?
গত এক যুগে চালের দাম বৃদ্ধির হার কত এমন হিসেবে জানতে চেয়েছিলাম এক বুদ্ধিজীবীর কাছে। তার আগে তিনি আমাকে জানিয়ে দিলেন গাড়ির দাম বাড়ছে। বুঝলাম তার উন্নয়ন ঘটেছে। চালের কেজি কত, জানার প্রয়োজন তার নেই। সেদিন আলাপ হচ্ছিলো নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক পরিচয়’র সম্পাদক নাজমুল আহসান ভাইয়ের সঙ্গে। তিনি চমৎকার একটা কথা বলেছিলেন, বিচার, শিক্ষা ও সাংবাদিকতায় যারা কাজ করে তাদের বিত্তের নেশা থাকতে নেই। কারণ এই তিন পেশায় বিত্ত-বৈভবের মালিক হওয়া যায় না। কথাটা হয়তো নিউইয়র্কের জন্য সত্যি। কিন্তু আমাদের অনেক ক্ষেত্রেই তা উল্টো। গাড়ির দাম বাড়া নিয়ে ভাবনাই তার প্রমাণ।
কথা উঠতে পারে, আলুর দাম বেড়েছে তাতে কি, পাবলিক তো আপত্তি জানাচ্ছে না। মুশকিলটা এখানেই। পাবলিকের আপত্তি জানানোর জায়গাগুলোর দিকে তাকান। প্রথমত গণমাধ্যম। মানুষের অভাব-অভিযোগ সঙ্গতই যেখানে প্রতিফলিত হয়। আর আমাদের গণমাধ্যমের অবস্থা তো অনন্ত জলিল, শমী কায়সারের বিয়ে আর ভিপি নূরের আউলা-বাউলা কথার মধ্যেই আটকে আছে। আর যারা গণমাধ্যমের মালিক তাদের চাল আর আলুর কেজি নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই। তাদের কাছে ‘টাইম ইজ মানি’।
সময় এবং টাকা আমাদের সমাজকে দুটি অংশে পরিষ্কার ভাগ করে দিয়েছে। এক অংশে রয়েছে নিয়ন্ত্রকরা, যাদের টাকার অভাব নেই। বিপরীতে রয়েছেন অভাগা নিয়ন্ত্রিতরা, যাদের অভাব থাকলেও বলার উপায় বা জায়গা নেই। ওই যে বললাম, বলার জায়গাগুলো নিয়ন্ত্রকদের দখলে। আর ওনাদের কাছে আলু পঞ্চাশ টাকা হলেও যা, পাঁচশো হলেও তাই। সাধারণ মানুষের কথায় তাদের কিছু আসে যায় না। সাধারণের অভাব-অভিযোগ তাই গণমাধ্যম সে ভাবে ধারণ করে না। নিয়ন্ত্রকদের কাছে আলুর দামের চেয়ে ভিপি নূরকে আলু ভর্তা বানানোর প্রজেক্ট বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী। পৃথিবীটাই এখন করপোরেট। সুতরাং কি আর করার আছে!
তবে বিকল্প হিসেবে যে সামাজিকমাধ্যম। যেখানে মঈনুল আহসান সাবেরের মতন মানুষেরা মাঝে-মধ্যে কৌশলে কষ্ট-বিসম্বাদের জানান দেন, সেই পরিসরও ছেটে দেয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। গণমাধ্যম বলতে কাগজ গেছে। কাগজের যে মূল জায়গা, সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয়ের পাতা তার বেশিরভাগই এখন ব্রাত্য রাইসুর ‘কু-তর্কের দোকান’। জনগণের আকঙ্ক্ষার চেয়ে সেখানে প্রতিফলিত হয় রাজনীতির বাহাস। সোজা বাংলায় ‘কাইজ্জা’। অবশ্য এটাকে ঠিক বাহাসও বলা যায় না। একপাক্ষিক কোনো কিছুকে বাহাস বলা কষ্টকর। টেলিভিশনের টকশোগুলোও এখন একপাক্ষিকতায় ভীষণ হয়ে উঠছে। নিউজ পোর্টালগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। এরমধ্যেও যে কয়টা মাধ্যম কিছুটা মানুষের কথা বলার চেষ্টা করছে, তাদেরও ভাতে মরার অবস্থা। অর্থ সংকট এবং ভয় দুটোই তাদের কাবু করার চেষ্টায় রয়েছে প্রতিনিয়ত।
সুতরাং মাধ্যমে বড় শিরোনামে নানা খবর থাকলেও আলু-চাল-ডালের খবর নেই। থাকলেও ক্ষুদ্রতায় চোখে পড়ে না। অপরাধ বাড়ছে। দারিদ্রের সঙ্গে অপরাধের একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। অভাব বাড়লে অপরাধ বাড়বে এটা অপরাধ বিজ্ঞানের সহজ সূত্র। সেই অভাব দৃশ্যমান না হবার কারণগুলোও মোটাদাগে কিছুটা বলার চেষ্টা হলো। এরপরেও যদি, ‘মানুষ তো জানান দিচ্ছে না’, এমন প্রশ্ন করেন তবে আপনার অবস্থান নিয়ন্ত্রকদের স্তরে। আপনার সাধারণ মানুষের অভাব-অভিযোগ জানার প্রয়োজন নেই। করপোরেট বিশ্বের ফিট মানুষ আপনি। আপনি লিফ্ট করার পজিশনে আছেন, নিচে তাকানোর দরকার নেই।
তবে আমাদের মত ছা-পোষাদের, যাদের আলুর কেজি পঞ্চাশে উঠলে প্রেসারও একশ পঞ্চাশে চলে যায়, তাদের পরিস্থিতি ভয়াবহ। অন্তত কথা বলে সান্ত্বনা পাবার জায়গাটাও তাদের নেই। শেয়ার করলে কষ্ট কমে। সেই শেয়ারিংয়ের জায়গাটাও আজ নিয়ন্ত্রকদের দখলে। সুতরাং ছা-পোষাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ছাড়া আর গতি কি?
লেখক: সাংবাদিক ও কলামনিস্ট।