• ১৮ অক্টোবর ২০২০ ২০:০৪:১৮
  • ১৮ অক্টোবর ২০২০ ২০:০৪:১৮
অন্যকে জানাতে পারেন: Facebook Twitter Google+ LinkedIn Save to Facebook প্রিন্ট করুন
বিজ্ঞাপন

দৃষ্টি ফেরাতে হবে উৎসের দিকে, বিষবৃক্ষের গোড়ার দিকে

কাকন রেজা। ফাইল ছবি


কাকন রেজা:


লংমার্চ’টা কেন, এই ব্যাখ্যাটা কারো কাছে পেলাম না। না, যারা করছেন তাদের ব্যাখ্যা নয়, ক্রিটিকদের ব্যাখ্যা। সব বিষয়েই ক্রিটিসিজম’টা জরুরি। একটা বিষয়কে স্বচ্ছ করার ছাঁকনির প্রক্রিয়া হলো ক্রিটিসিজম। ধর্ষণবিরোধী লংমার্চের কথা বলছি। অধ্যাদেশ হয়ে গেছে, ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি। ফাঁসি প্রিয় রাজনীতির আকাঙ্ক্ষা তো পূরণ হয়েছে। তারপরেও এমন লংমার্চের দু’টো উদ্দেশ্য থাকতে পারে, এক হলো, ফাঁসির ব্যবস্থা যে হয়েছে তা জানান দেয়া। যাতে মানুষ ধারণা পায় একটা কিছু হয়েছে। তাদের চিন্তা যাতে অন্যদিকে প্রবাহিত না হয়।

দ্বিতীয়ত নিজেদের অবস্থানের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা। মানে ‘আমরা আছি’। এই ‘আমরা আছি’র আবার দুটো ভাগ রয়েছে। প্রথমত ‘আমরা আছি’ আপনাদের কাছাকাছি। দুই নম্বর ‘আছি’ হলো ক্ষমতার কাছাকাছি। ‘আমাদের কথায় হয়, হয়েছে অনেক কিছুই’, এমনটা।

গণমাধ্যমের পরিচিত মুখ আরিফুজ্জামান তুহিন এই বিষয়টাকে ছুঁতে গিয়ে সামাজিকমাধ্যমে লিখেছেন, ‘লক্ষ্যহীন আন্দোলন বস্তুত খুব ক্ষতিকর’। কথাটা খুব ভুল কি? ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলন টাইপ মুভের লক্ষ্য থাকে বিচার বিষয়ে। সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা হয়েছে। এর প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রগুলিতেও গুরুত্বের কথা বলা হয়েছে। লক্ষ্য অর্জিত হবার পর, যেটা হয় সেটা ‘সেলিব্রেশন’, জয় উদযাপন। কিন্তু লংমার্চ নিয়ে কথা বলার ধরন তেমনটা বলে না। তবে লংমার্চের অর্থ ও লক্ষ্য কী?

এই যে সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি এর ভালোমন্দের ব্যাখ্যা কি লংমার্চ? না। হলে বলা হতো, ধর্ষণের পরও অনেক নারী বেঁচে যান। এতে যদি ফাঁসি হয়, তবে খুনের শাস্তিও ফাঁসি। সুতরাং ফাঁসি’র চিন্তা ধর্ষিতা নারীকে মৃত্যুমুখীও করতে পারে। এমন কথাও বলতে পারতো লংমার্চ। এমন প্রশ্ন অনেকেই তুলছেন। এমন প্রশ্ন উঠবে। একটা আইন হলে তা নিয়ে ভালোমন্দের বিশ্লেষণ হয়, হওয়া উচিত। আইন পাল্টায় এমন বিশ্লেষণেই। না হলে, আইন সভা অর্থাৎ পার্লামেন্টের প্রয়োজন হতো না। 

অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, আইন করে কি অপরাধ বন্ধ করা যায়। যারা ‘যায়’ এর পক্ষে, তারা উদাহরণ দিয়েছেন এসিড সন্ত্রাস বন্ধের। আবার যারা ‘যায় না’ এর পক্ষে তারা উদাহরণ দিয়েছেন ফাঁসি ঘোষণার পরও গাড়িতে পার্লার কর্মী ধর্ষিতা হয়েছেন। সুতরাং দ্বৈততা রয়েছে মতের। এই দ্বৈত মতের কথা মাথায় রেখেই বলি, আমরা আমাদের সমাজকে কীভাবে গড়েছি সেটা ভেবে দেখেছি কি কখনো? সমাজ কি আইনের প্রতি আস্থা রাখে? সমাজ কি তৈরি?

জবাবটা দিই আলুর দামের প্রশ্নে। সরকার ত্রিশ টাকা দর বেঁধে দিয়েছেন। কিন্তু দর মানা হয়নি। বলবেন, কঠিন আইন নেই, তাই মানা হয়নি। তবে কি আলুর দাম নিয়ন্ত্রণেও ফাঁসির চিন্তা করবেন? কারণ সমাজকে তো আপনি ফাঁসি মন্ত্রে দীক্ষা দিয়ে ফেলেছেন। হত্যা যজ্ঞে উৎসাহিত করেছেন। আপনি কথায় কথায় দাবি তুলছেন ফাঁসি। মানুষের কান ও মস্তিষ্ক আক্রান্ত আপনার দাবিতে। মনোবিজ্ঞান বলে মানুষ মূলত আত্মহত্যা প্রবণ। মৃত্যু দাবী সেই প্রবণতাকে উস্কে দেয়। মানুষ নিজের অজান্তেই মানসিক ভাবে এর প্রতি আকৃষ্ট হয়। কাচের গ্লাস ভাঙার শব্দ মানুষকে আকর্ষণ করে। ধ্বংস প্রবণতাও মানুষের ভেতর লুকায়িত। সুতরাং অপ্রয়োজনে মৃত্যু আর ধ্বংসের কথা মনে করিয়ে দেয়া আত্মঘাতের সামিল। লক্ষ্যহীন আন্দোলনও তাই।

আমাদের প্রচলিত আইনেই বিচার সম্ভব এবং সাথে অপরাধকে নিয়ন্ত্রণ করাও। কেন হয় না, এই প্রশ্নটা তোলাটাই ছিলো মূল প্রয়োজন। আন্দোলনের মাধ্যমে মানুষকে এবং সাথে বিচারিক প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের সাথে যুক্ত ব্যবস্থাটাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়োজন ছিলো। জানান দেয়া উচিত ছিলো, কেন প্রচলিত আইন ব্যর্থ হচ্ছে। আইন যতই কঠোর হোক প্রায়োগিক দিক ব্যর্থ হলে সে কঠোরতা মূল্যহীন। মাদক ব্যবসা বিষয়ে কঠোর আইন রয়েছে। চলেছে ‘লিঞ্চিং’ মানে ‘ক্রসফায়ার’ও কিন্তু আজ অবধি বন্ধ হয়েছে কি? হয়নি। কেন হয়নি, এই প্রশ্নটাই হলো মূল।

মূল জায়গাটাকে ধরতে না পারলে সবকিছুই বৃথা। আপনি গোড়ায় জল ঢালবেন, আর ডালপালা কাটায় ব্যস্ত থাকবেন তাতে তো উল্টো ফল হওয়া স্বাভাবিক। যেহেতু গোড়ার জলে নতুন সতেজ ডাল ও পাতা গজানোটাই স্বাভাবিকতা। গোড়া না কেটে ডালপালা ছাটার প্রক্রিয়া হলো বৃক্ষকে আরো সুবিন্যস্ত করা। আমরা যেমন বাগানের গাছের বেলায় করি। রফিক আজাদ বলেছেন, ‘বনকে বিন্যস্ত করে তবেই উদ্যান।’ কিন্তু বিষবৃক্ষের বেলায় এমন হলে মুশকিল। আর সেই মুশকিল রীতিমতো আছানহীন। তাই বিষবৃক্ষকে বিন্যস্ত হতে দেবার কোনো সুযোগ নেই। সে কারণেই গোড়ার দিকে অর্থাৎ উৎসের দিকে নজর দেয়াটা এখন সবচেয়ে বা একমাত্র প্রয়োজনই বলতে পারেন।  

ফুটনোট: এক ধরনের আগাছা জাতীয় গাছ রয়েছে। দেখতে সুন্দর। ছোট সাদা ফুলও হয়। বৈজ্ঞানিক নাম পার্থেনিয়াম। আমাদের দেশেও প্রচুর দেখা যায়। কিন্তু বলা হয় এ গাছ দেখামাত্র উপড়ে ফেলুন। কারণ এ গাছ পরিবেশ ও প্রাণি দুটোরই ক্ষতি করে। মারাত্মক টক্সিক, মানে বিষ রয়েছে এই গাছে। আর বিষ থাকলে বিষবৃক্ষ। বিষবৃক্ষের সৌন্দর্যটা ধোঁকা। বোকা বানানোর কৌশল। সে কারণে বিজ্ঞানও বলে মানুষ ও পরিবেশ বাঁচাতে বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলতে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামনিস্ট।

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
Page rendered in: 0.1671 seconds.