ছবি : সংগৃহীত
কাকন রেজা :
রাজনীতিতে ট্রাক যে একটা বিশেষ বিষয় তা উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কথাতেও। গণমাধ্যমের শিরোনাম অনুযায়ী ট্রাম্প অভিযোগ করেছেন, ‘নির্বাচনের রাতে খারাপ কিছু হয়েছে, ট্রাক দিয়ে দরোজা অবরুদ্ধ ছিলো।’
আমাদের দেশেও ট্রাক জিনিসটি রাজনীতির একটি বিশেষ জায়গা দখল করেছে। বালুর ট্রাকের কথা নিশ্চয়ই কেউ ভুলে যাননি। তবে ট্রাম্প এ বিষয়ে বেদনার্ত হতেই পারেন, যেহেতু তিনি ক্ষমতায় থাকা সত্বেও ট্রাকের সঠিক ব্যবহার করতে পারেননি। উল্টো করেছে বিরোধীদল। এটা রাষ্ট্রপতি হিসেবে ট্রাম্পের সম্ভবত সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।
মজা লেগেছে ট্রাম্পের বক্তব্যে। তার মুখে সারাক্ষণ ছিলো ভোট চুরির কথা। এখনো তিনি ক্ষান্ত দেননি সে কথায়। আমাদের দেশের অনেকে তার বক্তব্যকে বিএনপির বক্তব্যের সাথে গুলিয়ে ফেলেছিলেন। তারা ভুলে গিয়েছিলেন ট্রাম্প ক্ষমতায়, বিএনপির মতন ক্ষমতাহীন নন। অবশ্য যারা বলেছেন তাদেরও দোষ দেয়া যায় না, কারণ তারা বিএনপির মতন ক্ষমতাহীন দলের চুরি হওয়া বিষয়ক কাঁদুনিই শুনেছেন। দীর্ঘদিন এতেই তারা টিউনড। ক্ষমতায় থেকে কেউ চুরির কথা বলবেন, এমন ভাবনা হয়তো তাদের মাথায় কাজ করেনি। না হলে এমন ভুলভাল উদাহরণ দিয়ে ট্রাম্পের মতন হাসির পাত্র নিশ্চয়ই হতে চাইতেন না। বরং তারা যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল নির্বাচন কমিশনারকে উদ্ধৃত করে বলতেন, ‘ভোট জালিয়াতির কোনো প্রমান নেই।’ আমাদের সাথে অ্যামেরিকার নির্বাচন বিষয়ক সবচেয়ে বড় মিলটাই এখানে।
ট্রাম্প নিজেকে আগাম জয়ী ঘোষণা করেছিলেন। দক্ষিণ এশিয়ায় মাত্র ভারতেই এসেছিলেন ট্রাম্প। ঘোরাঘুরিটা আরেকটু বেশি করলে হয়তো, তিনি ঘোষণাতেই ক্ষান্ত থাকতেন না, জয়ী হয়ে বিরোধীদের এক নয় দু’হাত দেখিয়ে দিতেন। এজন্যই ভ্রমণকে চিকিৎসকরা এত গুরুত্ব দেন। ট্রাম্প কেনো যে এমন কাজটা করলেন না!
বাংলাদেশের কতিপয় বুদ্ধিজীবীর নানা মন্তব্যে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম। তারা যেভাবে অ্যামেরিকার নির্বাচন বিশ্লেষণ করছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল সে মুহূর্তে তারা খোদ অ্যামেরিকাতেই অবস্থান করছেন। কারণ দেশে থাকলে তাদের এভাবে নির্বাচন নিয়ে খোলাখুলি মত প্রকাশ আর বিশ্লেষণ কতটা সম্ভব হতো তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
এমন প্রশ্ন যে অস্বাভাবিক কিছু নয় তা নিজেদের নির্বাচনকালীন সময়েই উপলব্ধি করেছি। অ্যামেরিকার নির্বাচন নিয়ে তারা যেভাবে কথা বলেছেন, তার শতভাগের দশ ভাগ কেনো দুই ভাগও বলেননি নিজেদের নির্বাচন নিয়ে। ইলেক্টোরাল পদ্ধতির সমালোচনা থেকে গুনতে এত সময় লাগলো কেনো- এমন কোনো প্রশ্নই বাদ দেননি দেশীয় বিশ্লেষকরা। সামাজিকমাধ্যম থেকে শুরু করে গণমাধ্যম কোনো মাধ্যমই বাদ যায়নি তাদের বিশ্লেষণের আওতা থেকে। কেউ তো সামাজিকমাধ্যমে ফক্স নিউজের থেকেও বেশি অ্যাকটিভ ছিলেন। এভাবে পরের বউ সুন্দর না অসুন্দর না ভেবে যদি নিজের বউয়ের কথা থুড়ি নিজের দেশের কথা ভাবতেন তাহলে বড়ই ভালো হতো।
এসব বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ এখন আবার ট্রাম্পের সুরে গাইতে শুরু করেছেন। প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করছেন অ্যামেরিকার ভোটেও চুরি হয়। অনেকটা এ গল্পের মতন আর কী। ‘কয়েকজন সুন্দরী ঘাটে গোছল করতে গেছেন। তাদের শুকনো কাপড় ঘাটের উপর রাখা। এক দুষ্টু বাঁদর এসে তাদের শুকনো কাপড়গুলো নিয়ে উধাও। উপায় নেই তাই ভেজা শরীরে একখন্ড কাপড়েই তাদের ফিরতে হবে। ফেরার পথে কয়েকজন যুবকের সাথে দেখা। দলের অগ্রভাবে থাকা সুন্দরীকে দেখতে পেয়ে যুবকরা বললো এ কি তোমার এ অবস্থা কেনো। সে বাঁদরের বিষয়টি না বলে বললো, আমার শুধু নয় পেছনে যারা আসছে তাদেরও একই অবস্থা।’ অর্থাৎ অন্যের বস্ত্রহীনতা দেখিয়ে নিজের লজ্জা কাটিয়ে উঠতে চেয়েছে সেই রমণী। আমাদের বুদ্ধিজীবীরাও সেই রমণীর মতন লজ্জা ঢাকতে চাচ্ছেন কিনা কে জানে। অবশ্য না ঢাকলেই বা কী। নুডিজমের ভাষায়, ‘প্রাকৃতিক ভাবে কাপড় জরুরি কিছু নয়।’
অ্যামেরিকার নির্বাচন কীভাবে হলো সেটা দেখার চেয়ে বেশি জরুরি হলো এই নির্বাচন বিশ্ব রাজনীতিকে কতটা প্রভাবিত করবে। যে রাজনীতির বাইরে আমরাও নই। আমাদের জন্য সে প্রভাব মঙ্গলকর হবে না অমঙ্গলের তা দেখাই এখন জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতায় গেলে যুদ্ধ-বিগ্রহ বেড়ে যায়। প্রচলিত এমন কথা একেবারে অমূলক নয়। আর রিপাবলিকানরা ক্ষমতায় থাকলে দেশে দেশে অগণতান্ত্রিক পন্থায় দুঃশাসকদের উত্থান ঘটে এমন কথাও অনেকে বলেন। বিশ্ব রাজনীতির মোড়ল হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের একটা ভূমিকা অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই। সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই, স্নায়ুযুদ্ধের আপাত শেষ হয়েছে। কিন্তু নতুন করে শুরু হতে যাচ্ছে চীনের সঙ্গে শীতল যুদ্ধের। এমন অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় যিনি যাচ্ছেন তার মনোভাবের উপর অনেকটাই নির্ভর করছে বিশ্ব শান্তির বিষয়টি।
জো বাইডেন সম্পর্কে সাধারণ ধারণা হচ্ছে সত্তরোর্ধ একজন মানুষ, যার মাথাটা যথেষ্ট ঠান্ডা। যা বলেন এবং করেন চিন্তা ভাবনা করে। আমরা চাই এই সাধারণ ধারণা সবক্ষেত্রেই সত্যি হোক। তিনি যেনো যুক্তরাষ্ট্রের মঙ্গলের সাথে সারা বিশ্বের মঙ্গলের কথা ভাবেন। সব দেশের সরকার সঠিক ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসুক, এমন ভাবনা যেনো তার ভেতর কাজ করে। আর নির্বাচিতরা যেনো তার মতই বলেন, ‘যারা ভোট দিয়েছেন আর যারা দেননি আমি তাদের সবার প্রেসিডেন্ট।’ মূল কথা সঠিক নির্বাচনই হয়ে ওঠে যেন ক্ষমতা পরিবর্তনের একমাত্র পন্থা।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।