কাকন রেজা। ফাইল ছবি
কাকন রেজা:
বুদ্ধিজীবী হওনের খায়েশ হাল আমলে বৃদ্ধি পাইছে এইটা পরিষ্কার। দেখেন অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মইরা গেলেন। তারে লইয়া ফেসবুক হইয়া উঠলো শোকসাগর। কুনো আপত্তি নাই। একজন প্রতিভাবান মানুষের মৃত্যুতে শোক জানানোতে দোষ নাই। দোষ নাই প্রতিভাহীন একজন সাধারণ মানুষের মৃত্যুতে শোক প্রকাশেও। বরং এইটা মানুষ বইলা নিজেরে প্রমাণের বিষয়। মানুষের এইখানেই অ্যাডভান্টেজ যেইটা পশুগো নাই। হ্যাগো ফেসবুক-টুইটার নাই। সুতরাং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে শোক জানানোটাই উচিত কাম।
তয় এইখানে কথা আছে। আপনি শোক জানান ভালো কথা। আপনি সৌমিত্ররে চিনেন তার অভিনয় দিয়া। বাংলাদেশের মানুষের মনে সৌমিত্র বিশেষ দাগ কাটছে ‘হীরক রাজার দেশে’ দেইখা। সত্যজিত তার সিনেমা দিয়া আর সৌমিত্র অভিনয় দিয়া, এই দেশের মানুষের চিন্তার জায়গাটা ছুঁয়া গেছে। কইতে পারেন, এই দেশের মানুষের ভাবনার সাথে মিল্লা গেছে। আপনে সৌমিত্রের আলাপ করেন সেই অভিনয়ের কথা বইলাই। তারে নিয়া ক্যান আগলা বুদ্ধিজীবীতা দেখাইতে যান। না বুইঝাই হ্যারে ‘কমরেড-বেশিরেড’-এ আখ্যায়িত করেন।
সৌমিত্র অভিনয়ে কোনো বিপ্লবী আছিলেন না, রাজনীতিতে তো নয়ই। কুনো প্রতিবাদ বা সমর্থন পত্রে একটা স্বাক্ষর দিলেই মানুষ বিপ্লবী হইয়া যায় না। আমাগো দেশের অনেক বুদ্ধিজীবীই তো পাকিস্তান রক্ষার লাইগা নানা কাগজে স্বাক্ষর দিছিলেন হ্যাগো স্বাক্ষরের জোরে তো পাকিস্তান টিকে নাই। পাকিস্তান টিকতে পারে নাই তারা যুদ্ধে হারছে বইলা। বিপ্লব হইলো যুদ্ধ। যুদ্ধের অনেকগুলান ধাপ বা পর্যায় আছে। আমাগো স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে তাকাইলেই সেই ধাপগুলান বোঝা যাইবো। যুদ্ধ হইলো বিপ্লবের সর্বশেষ ধাপ। আর যখন কুনো রাস্তা থাকে না তখন সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ণ হইতে হয়।
না বুইঝা কোনো স্বাক্ষরদাতারে বিপ্লবী কওন যায় না। যিমুন অনেকে এখন কন পাকিস্তান আমলে উপায় আছিল না কিংবা চাপ কুলাইতে না পাইরা স্বাক্ষর দিছি। কথাটা কিন্তু মিছা না। অনেক ক্ষেত্রেই দুর্বলচিত্তের মানুষ চাপে পইড়া নানান কিছিমের কাগজে স্বাক্ষর দেয়। বাংলা সিনেমায় দেখেন না ভিলেন না কীভাবে জোর কইরা স্বাক্ষর নেয়। ভারতীয় তামিল সিনেমা তো আরো মশহুর এইসব দেখানোতে। সুতরাং স্বাক্ষর ধইরা বিপ্লবী বা প্রতিবিপ্লবী আখ্যা দেয়া কঠিন। আর স্বাক্ষর বিপ্লবের বিশেষ কোনো ধাপও না। যারা এইডারে বড় কইরা দেখেন তাগো সাহস নাই বইলাই দেখেন। হ্যাগো দিয়া মূল বিপ্লব কখনো সম্ভব না। এই যে দেখেন আমাগো মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যুদ্ধে না গিয়া হইছেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ এই কথাটাই সত্য। যৌবনে যারা যুদ্ধে না গিয়া সংগঠক হইছেন তাগো শ্রেষ্ঠ সময়ের নিম-শ্রেষ্ঠ কাম লইয়া কথা উঠতেই পারে। এই ব্যাপারে ব্যাখ্যা হইতে পারে, পিছুটানের কারণে যুদ্ধে যাইতে পারেন নাই। যুদ্ধে যাওনের ব্যাপারে পিছুটান কেন, কুনো কিছুই অজুহাত হইতে পারে না। নিজের প্রাণটার উৎসর্গ করতে যিনি পারেন, তার আবার পিছুটানের চিন্তা কী!
সৌমিত্ররে লইয়া অনেক আদিখ্যেতা দেখলাম। তিনি যে বিপ্লবী হ্যাইডা বুঝাইতে গিয়া অনেকে অনেক বিশেষণ লাগাইলেন। জিগায়, যে নিজ অভিনয়েই বিপ্লবী হইতে পারলেন না। সারা জীবন নরম মানুষের ভূমিকায় অভিনয় কইরা গেলেন। কঠিন-রাগী কোনো চরিত্র তারে দেখা গেলো না, এমন কী ‘হীরক রাজার দেশে’ও না। হ্যাইখানেও সে চাপে পইড়া হীরক রাজার উন্নয়নের মন্ত্র পড়ছেন। ঘুইরা দাঁড়ানোর মতন প্রতিবাদী রাগী চরিত্র তার ছিলো না। যাওনের কথা না, তার চরিত্রের সাথে, তার অভিনয়ের সাথে এই রাগী চরিত্র যায় না। তিনি আপাদমস্তক একজন নিপাট ভদ্রলোক মানুষ ছিলেন। রাগী বিপ্লবী ছিলেন না। তারে স্মরণ করেন তার এই চরিত্র দিয়াই। তারে শ্রদ্ধা জানান একজন ভালো মানুষ ও অভিনেতা চিন্তায়। ভারতের ক্ষেত্রে পদ্ম ভূষণ পাওয়া একজন মানুষ তার প্রতিভার গুনেই আলোচিত হইতে পারেন। কেন কষ্ট কইরা অহেতুক আরোপিত বিষয় টাইনা আনেন। এতে তারো অপমান হয়, আপনারও নির্বুদ্ধিতা প্রমাণ পায়।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।