ইহসান ইবনে রেজা ফাগুন। ফাইল ছবি
কাকন রেজা:
দেড় বছর। আঠারো মাস কেটে গেছে। ফাগুন নেই। ইহসান ইবনে রেজা, ফাগুন রেজার কথা বলছি। আমার সন্তান। একজন তরুণ গণমাধ্যমকর্মী। যিনি খুন হয়েছেন আততায়ীর হাতে দেড় বছর আগে। নিখোঁজ হবার পর তার লাশ পাওয়া গেছে রেললাইনের পাশে। মানুষ বলেন, যত সময় যায় তত কষ্ট কমে। নিশ্চিত থাকুন এমন কথা সবক্ষেত্রেই সত্যি নয়। যতদিন যায় কিছু শোক আরো জুড়ে বসে বুকের গহীনে। রাত যত গভীর হয় তত অন্ধকার যেমন গাঢ় হয়ে ওঠে। আর সেই শোক যদি হয় পুত্রহারা একজন বাবার; সেই শোকের গাঢ়ত্ব প্রকাশের কোনো রং আজো সৃষ্টি হয়নি।
বিশ্বাস করুন, কোনো শোকই এর সমুখে কিছু নয়। আমি অনেক মৃত্যুর ভেতর দিয়ে গেছি। বাবা, মা, ভাই, বন্ধু, নিকট আত্মীয়, প্রিয়জন। গেছি অনেক বিচ্ছেদের ভেতর দিয়ে। বিরহ ছুঁয়ে গেছে একান্তে। কিন্তু কিছুই এই শোকের সমুখে দাঁড়াতে পারবে না। সন্তানহারা পিতার শোক কোনো কিছুর সাথেই তুল্য নয়।
অনেক খারাপ মানুষের মাঝে খারাপ বাবা একজনও নেই। একদম। একসময় আমারও দ্বিমত ছিলো এমন কথার সাথে। পুত্র হারানোর পর বুঝেছি বাবারা কখনো খারাপ হয় না। আর যারা হয় তারা মানসিক ভাবে অসুস্থ। মানসিক ভাবে অসুস্থ একজন আর মানুষ থাকে না। মানুষের পরিচিতিই তার চিন্তায়। অসুস্থ মানুষের চিন্তার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়, পশুর সাথে তার কোনো পার্থক্য করা যায় না।
শীত এসে গেছে ঠাণ্ডা লাগছিলো ফাগুনের মাকে বললাম, হুডিগুলো বের করে দিতে। হুডিগুলো দেখতেই চোখ ভিজে গেলো। হুডির রঙ ঝাপসা দেখাচ্ছে। আমার সবগুলি হুডিই ফাগুন পরতো। ও নিজের জ্যাকেট বা হুডি নয় যখন থেকে আমার কাপড় ওর গায়ের মাপে হয়ে উঠেছে ততদিন আমারগুলো পরেই শীত কাটিয়েছে। যেমন ওর নিজের জুতা না পরে আমারগুলো পরতো। তেমনি আমার জ্যাকেটগুলোও ছিলো ওর প্রিয়। ফাগুন ভেতরে ক্রমেই আমি হয়ে উঠছিলো। বন্ধুদের কাছে বলতো, ‘দেখ আমি আমার আব্বুজির মতো।’ আর এখন আমি ক্রমেই ফাগুনের মতো হয়ে উঠছি। কোনো আপোস নেই। কোনো ছাড় নেই। কঠিন সন্ত চরিত্র এক।
ফাগুন রেজা। ইহসান ইবনে রেজা। তরুণ গণমাধ্যমকর্মী। একটি গণমাধ্যমের ইংরেজি বিভাগের সাব এডিটর। শুধু তাই নয় অল্প দিনেই হয়ে উঠেছিলো ঝানু রিপোর্টার। অনুসন্ধানী প্রতিবেদক। যখন কথা বলতাম ওর সাথে, আমার দু’যুগের অভিজ্ঞতা অনেক সময়ই বিস্মিত হতো। ভাবতাম এত অল্প বয়সে এতটা কী করে জানে ও, এতসব! এই বয়সে কীভাবে সম্ভব! যার প্রশংসা দেড় বছর পরেও করেন তার সহকর্মীরা। কর্মক্ষেত্রে তার অগ্রজরা। এমন মেধাবী একজন তরুণকে হত্যা করা এবং সেই হত্যার কারণ উদঘাটন না হওয়া; সাথে হত্যাকারীকে শাস্তির সম্মুখিন না করা মানে পুরো আইনের শাসনটাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা। অথচ দেড় বছর তথা আঠারো মাস পরেও সে হত্যাকাণ্ডের কারণ উদঘাটন এবং হত্যাকারীদের শাস্তি দেয়ার ব্যাপারে কোথায় যেনো একটি স্থবিরতা কাজ করছে।
একজন পিতা হিসেবে নয়, নাগরিক হিসেবেও চিরদিন ন্যায়বিচারের পক্ষে ছিলাম এবং আছি। না, আমি আমার সন্তানের হত্যাকারীদের ‘ক্রসফায়ার’ চাইনি। বিচার চেয়েছি। চেয়েছি বিচারটা প্রতিষ্ঠিত হোক। মানুষ জানুক, দেখুক হত্যাকারীদের বিচার হয় এবং তারা শাস্তি পায়। কিন্তু আমার চাওয়া পূরণ হয়েছে কি? হয়নি। ফাগুনের মোবাইল উদ্ধার হয়েছে। মোবাইলের সূত্র ধরে দুজন গ্রেপ্তার হয়েছে। যার মধ্যে একজন হত্যাকাণ্ডের সাথে সুনির্দিষ্ট ভাবে যুক্ত বলে প্রথম যিনি তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন তিনি তার তদন্ত বিবরণীতে পরিষ্কার জানিয়ে গেছেন। সেই গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি এমন আরো তিনটি হত্যা বা হত্যা প্রচেষ্টার সাথে জড়িত। সুনির্দিষ্ট মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অর্থাৎ অপরাধী হিসেবে সে প্রফেশনাল।
রেলওয়ে পুলিশ তাকে রিমান্ডেও এনেছে। সেই রিমান্ডের চিত্রটা বলি। আমি গেছি রিমান্ডের দ্বিতীয় দিন সাথে ফাগুনের মা। থানায় গিয়ে মুখোমুখি হয়েছিলাম সেই গ্রেপ্তারকৃতের। হত্যার আগে ফাগুন আমাকে ফোন করেছিলে প্রথম কিন্তু কথা বলেনি। তারপর তার মা ফোন করেছিলো তখনও ফাগুন ধরেছিলো কথা বলেনি। তবে কথা না বললেও ফাগুনের সাথে যে তর্ক হচ্ছিলো অন্তত তিনজনের তা পরিষ্কার শোনা যাচ্ছিলো ফোনে। গ্রেপ্তারকৃত সেই ব্যক্তির কন্ঠও ফোনে শোনা কন্ঠের সাথে মিলে গেছে এমনটাই জানিয়েছেন ফাগুনের মা। পুলিশ কর্মকর্তাদের সে কথা বলেছেন তিনি। অথচ কাজের কাজ কিছু হয়নি। থানায় যাওয়ার আগে আমাদের আশা ছিলো এবার হয়তো জানা যাবে কেন ফাগুনকে হত্যা করা হয়েছিলো। না, আমাদের আশায় গুড়েবালি। কারণ পুলিশ জানিয়েছে আসামি অসুস্থ তাই তাকে ‘মারধর’ করা যায়নি। যতদূর জেনেছি নানা সূত্র থেকে তাতে তাকে তেমন জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়নি। ফাগুনের সাথে থাকা ল্যাপটপটি উদ্ধারেও কোনো অভিযান হয়নি। উল্টো আমরা দেখেছি, সেই সম্ভাব্য খুনিকে দুপুরের খাওয়া খাওয়ানোর জন্য অস্থির প্রয়াস। অথচ আমরা না খেয়ে গিয়েছি। ফাগুনের মা কাঁদছেন এমন অবস্থার মধ্যেও অপরাধীদের খাওয়া চলে এসেছে। গণমাধ্যমের কর্মীরাও ছিলেন, কথা বলতে চাচ্ছেন। তারমধ্যেই চলছিলো খাওয়ানোর তোড়জোড়। বড়ই আশ্চর্য রিমান্ড! অথচ আমরা রিমান্ডের নামে কত কী শুনি।
জানি না, এ লেখা পুলিশের বড় কর্তারা পড়বেন কিনা। একজন পিতার আর্তি তাদের কতটা জাগাবে তাও ভাবনার বিষয়। একজন পিতার শোক আরেকজন শোকার্ত পিতাই হয় তো বুঝতে পারেন। এর বাইরে আর কারো সেই শোক, সেই যাতনার পরিমাণ অনুধাবন করাও সম্ভব হয় না, হবে না। আমি একজন পিতা হিসেবে আমার সন্তান হত্যার বিচার অবশ্যই চাইবো। একজন নাগরিক হিসেবও চাইবো। চাইবো এ কারণে যে, আর কোনো তরুণ যেনো এভাবে আততায়ীর হাতে নিহত না হন। আর তা চাইতে গেলে অবশ্যই ইহসান ইবনে রেজা তথা ফাগুন রেজা হত্যার বিচার চাইতে হবে। এই সমাজকে টিকে থাকতে হলে এমন হত্যার বিচারের বিকল্প কিছু নেই। রাষ্ট্রকে রাষ্ট্র হয়ে উঠতে গেলেও খুনিদের শাস্তি নিশ্চিত করার বিকল্প নেই।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও নিহত সাংবাদিক ফাগুন রেজা’র বাবা।