ফাইল ছবি
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় খুব পছন্দের ছিলো ফাগুনের। প্রায়ই ছুটে যেতো জাহাঙ্গীরনগরে। একবার সারারাত কনসার্ট দেখেছিলো। কনসার্ট থাকলেই যেতো। আমি এখন ইউটিউব খুঁজে ফিরি। জাহাঙ্গীরনগরের যতগুলো কনসার্ট পাওয়া যায় সবগুলো মন দিয়ে দেখি। মূলত দেখি দর্শকদের মুখ, কোথাও যদি ফাগুনকে দেখা যায়। ও একটা গিটার কিনেছিলো। এখনো গিটারটি ঝুলে আছে ওর রুমে। একটা ভাঙা, ছিড়া তারের গিটার, ওটাই এখন আমার কাছে এ যাবতকালের সেরা বাদ্যযন্ত্র। এক সময় আমি নিজেও ব্যান্ডে বাজাতাম। রক্তের সে ধারাতেই হয়তো ফাগুন গিটার বাজাতে চেয়েছিলো, কিনেছিলোও। ওর আর বাজানো হয়নি। থেমে গেছে রক্তের ধারা।
হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন, তার বড় ছেলের মৃত্যুর আগে তিনি জায়নামাজে দাঁড়িয়েছিলেন। ইচ্ছে ছিলো নিজের জীবনের বিনিময়ে ছেলেটার জীবন চেয়ে নেয়া সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে। তিনি চাইতে পারেননি। এ দুঃখ তাকে আজীবন তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। মাত্র তিন দিন যে সন্তান বেঁচে ছিলো তার জন্য এতটা দুঃখ বয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ। আক্ষেপ করেছেন, নিজের বেঁচে থাকার পর বিতৃষ্ণা জন্মেছে। আর আমার একুশ বছর। একুশ বছর আমার ছেলেটা চোখের সমুখে ছিলো, বুকে ছিলো। আমার কী মনে হয়। নিখোঁজ হবার কিছুক্ষণ আগেও ছেলেটা আমার সাথে ফোনে কথা বললো, কিছু অর্থহীন কথাও। সাধারণত ও যা বলে না। হয়তো বোঝাতে চেয়েছিলো তার কোনো বিপদ। আমিই সে ইঙ্গিত বুঝতে পারিনি, ব্যর্থ হয়েছি। এই ব্যর্থতার ভার আমাকে বাকি যে কয়টা দিন রয়েছি বয়ে বেড়াতে হবে। আর প্রতিদিন বিতৃষ্ণা জন্মাবে নিজের ওপর।
হ্যাঁ, ও যখন ট্রেনে বিপদের সম্মুখীন সে মূহূর্তে ফোনে কথা বলছিলো আমার সাথে। কেনো যেনো অযথা কথা লম্বা করতে চাচ্ছিলো। আমি শুনতে পাচ্ছিলাম আশেপাশের দু’একটা কণ্ঠস্বর। অসহিষ্ণু সেসব কণ্ঠস্বর এখনো আমার কানে বাজে। এখনো নিশ্চিত চিনতে পারি, পারবো সে কণ্ঠস্বর। সম্প্রতি পুলিশ ফাগুনের এক খুনিকে গ্রেপ্তার করেছে। জামালপুর রেলওয়ে থানায় আমি সেই ব্যক্তির কণ্ঠস্বর শুনেছি, আমি নিশ্চিত এ সেই ব্যক্তি যার কথা আমি ফাগুনের সাথে কথা বলার সময় শুনেছি। সে সময় ফাগুনের মা’ও ফোন করেছিলো ফাগুনকে। ফোন ধরেছিলো কিন্তু কথা বলেনি ফাগুন। তার মা’ও উত্তেজিত ব্যক্তিদের কণ্ঠস্বর শুনেছে। সে’ও নিশ্চিত করেছে গ্রেপ্তার হওয়া সে ব্যক্তির কণ্ঠস্বর সে শুনেছে। ঘটনাক্রম, ফাগুনের ফোন উদ্ধারসহ বিভিন্ন ঘটনায় ওই ব্যক্তির সাথে ফাগুন হত্যাকাণ্ডের সংশ্লিষ্টতা নিশ্চিত হবার পরও রেলওয়ে পুলিশ তার কাছ থেকে তেমন কিছু বের করতে পারেনি। ফাগুনের ল্যাপটপটিও উদ্ধারের প্রচেষ্টা চালায়নি পুলিশ। যেটা ছিলো হত্যাকাণ্ডের আরেকটি প্রমাণ। এমনকি কোনো ঘটনা প্রমাণ করার প্রাণান্তকর কোনো চেষ্টাও দৃশ্যমান হয়নি।
বাদি হিসেবে আমাকেও সম্পূর্ণভাবে জানানো হয়নি, কী ঘটছে সে সম্পর্কে। আমি জানি না, কতবার রিমান্ডে গেলো সেই অভিযুক্ত। তার সাথে গ্রেপ্তারকৃত আরো দুজনকে মুখোমুখি করানো হয়েছে কিনা, যারা এই হত্যাকাণ্ডে সন্দেহভাজন। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি ফাগুনকে হত্যার পর তার স্ত্রীর কাছে ফাগুনের ফোন রেখেছিলো, সম্ভবত ল্যাপটপটাও তার স্ত্রীর কাছে ছিলো। ভারতের সীমান্তবর্তী ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলায় তার স্ত্রীর বাড়ি। যে কোনো সময় ভারতেও পালাতে পারে তার স্ত্রী। সেই স্ত্রীকে গ্রেপ্তারের কোনো উদ্যোগই ছিলো না পুলিশের। অথচ কললিস্টের প্রেক্ষিতে ফাগুনের ফোন তার স্ত্রীও ব্যবহার করেছে খানিকসময়ের জন্য, তাকে গ্রেপ্তারও জরুরি। সাংবাদিকতার দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতায় এ বিষয়গুলো আমার এবং আমার মত যারা আছেন সবারই জানা। অথচ পুলিশের কার্যক্রম বিষয়ে বাদি হিসেবে আমি এবং একজন কর্মরত সাংবাদিক হিসেবেও আমি ধোঁয়াশায়!
কী অদ্ভুত কালেই না আমাদের বসবাস। একজন সাংবাদিক। একটি জনপ্রিয় গণমাধ্যমের ইংরেজি বিভাগের সাব-এডিটর ঈদের ছুটিতে বাড়ি ফিরছেন। ফেরার পথে নিখোঁজ হলেন। তারপর তার লাশ পাওয়া গেলো রেললাইনের ধারে। ট্রেন দুর্ঘটনার কোনো রকম চিহ্ন শরীরে নেই। রেললাইনের পার্শ্বে তাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। যার শরীরের কাপড়ও এদিক সেদিক হয়নি। শুধু মাথার পেছনে ভারী বস্তু দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। একেবারে পরিষ্কার পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। হ্যাঁ, ইহসান ইবনে রেজা ফাগুন, সাংবাদিক ফাগুন রেজা’র কথা বলছি। ২০১৯-এর ২১ মে রাতে তার লাশ উদ্ধার হয়। সেই উদ্ধার নিয়েও অনেক কথা রয়েছে। সে কথা আপাতত থাক। এখন প্রয়োজন এমন হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার। কিন্তু উনিশ মাস যাচ্ছে সেই প্রক্রিয়ার বিলম্বিত কার্যক্রম ক্রমেই আমাদের হতাশ করছে। একজন পিতা হিসেবে, একজন নাগরিক হিসেবে হতাশার সাথে ক্ষোভ ভর করছে মস্তিষ্কের কোষে কোষে। বিজয়ের মাসে দাঁড়িয়ে এই বিজয়কেই অর্থহীন মনে হচ্ছে। একজন প্রতিভাবান প্রতিশ্রুতিশীল গণমাধ্যমকর্মী নিখোঁজ হবে, তারপর তার লাশ পাওয়া যাবে রেললাইনের ধারে এমন দৃশ্য দেখার জন্য তো দেশটা স্বাধীন হয়নি। একজন পিতা তার সন্তান হত্যার বিচার চেয়ে এখানে-ওখানে ছোটাছুটি করবে, মাথা ঠুকবে তারপরও বিচার-তদন্ত রয়ে যাবে অধরা এমন পরিস্থিতি অবলোকনের জন্য তো দেশ স্বাধীন করা হয়নি। আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র অর্জন করেছি, মানুষের নিরাপদ জীবনের জন্য, অন্যায়ের প্রতিকার, হত্যার বিচার নিশ্চিত করার জন্য। এতদিন পরে, একজন সন্তানহারা পিতা হিসেবে আজ সংশয়ের এমন প্রশ্ন জাগলে কি কেউ দোষ দেবেন? বলবেন, কেনো আপনি সন্তান হত্যার বিচার চান, এমন কথা? নাকি সৃষ্টিকর্তার দোষ দিয়ে বলবেন, তার আমানত সে নিয়ে গেছে এখানে আবার বিচারের কী—এমন কথা! সব সম্ভবের দেশে এটাও হয়তো অসম্ভব কিছু নয়।
পুনশ্চ: উনিশ মাস, অনেকে বলেন, ভুলতে চেষ্টা করুন। কী করে ভুলি বলুন তো। ফাগুন শুধু আমার ছেলে ছিলো না, বন্ধু ছিলো, সহকর্মী ছিলো। ঘরে ফিরলে সন্তানশোক বাড়ে। তাই সন্তানহারা পিতারা যতটা পারেন বাইরে সময় কাটান। আমি কই যাই। বাইরের সঙ্গী হলেন বন্ধুরা, ফাগুন তো আমার বন্ধুও। বাইরে গেলেও বন্ধুর অভাব প্রকট হয়ে ওঠে। কাজে ডুবে থাকলে শোক ভোলা যায়। কোন কাজে ডুবে থাকি বলুন তো, ফাগুন যে আমার সহকর্মীও। কাজের ক্ষেত্রেও ওকে প্রয়োজন পড়ে। একটা রেফারেন্স দরকার ফাগুনের খোঁজ করো। এখনো হঠাৎ করে ওর নম্বরটা ডায়াল করে ফেলি। আমি তো সন্তান, বন্ধু, সহকর্মী সব হারিয়েছি। আমি কোথায় সান্ত্বনা খুঁজি, কোনখানে। কে আমাকে সান্ত্বনা দেবে, এমন সাধ্যি কার আছে।
ফুটনোট : প্রতিটা মাসের একুশ তারিখ আসে। আমি ক্ষণ গুনি, দিন গুনি, মাস গুনি, বছর গুনি। অসম্ভব ক্ষোভ মাথার ভেতর পাকিয়ে ওঠে। অসম্ভব যাতনা বুকের ভেতর। তাই লিখে কিছুটা ক্ষোভ, যাতনা কমানোর চেষ্টা করি। কমে কি?