কাকন রেজা। ফাইল ছবি
‘বিশ’ এর বিষ একুশেও উগরে দেবে কিনা জানি না। প্রতি নতুন বছরেরই মানুষ মানুষকে শুভকামনার প্রত্যাশা জানায়। আর সেই প্রত্যাশা হয় অনেকটাই প্রদর্শনজনিত। জানাতে হয় বলে জানানো। যাকে বলা হয় ভদ্রতার খাতিরে। ভদ্রতার খাতিরে আমরা অনেক কিছুই করি। মুখে সালাম দিয়ে মনে বলি শালা। কিন্তু এবারের প্রত্যাশায় সত্যিকার অর্থেই শুভকামনার আকুলতা রয়েছে। সবাই মন থেকে চায়, প্রত্যাশা করে একুশটা যেন ভালো হয়।
করোনা আমাদের অনেক কিছু নিয়েছে, দিয়েছেও। এই যে একুশের মন থেকে শুভকামনা তাও করোনার কল্যাণেই। একুশের যত শুভেচ্ছা পাবেন, শুভকামনা জানবেন, যারা জানাবেন তারা নিজে যাতে একুশে বেঁচে থাকেন, ভালো থাকেন এ চিন্তাটাকেই মিশিয়ে জানাবেন। এ চিন্তায়-কামনায় গলদ থাকার জো নেই। মূলত স্প্যানিশ ফ্লু’র পর এমন গণহারে ভালো থাকার আকুলতাপূর্ণ শুভকামনা সম্ভবত আর কখনোই জানানো হয়নি।
তবু এত শুভকামনার পরও কি আমরা ভালো থাকি, থাকি না। আমাদের ভেতর নানা সংশয়-ভয় কাজ করে। এখন আমাদের করোনায় মৃত্যুভয়ের পাশাপাশি কাজ করছে টিকা নিয়ে সংশয়। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই ভারতে টিকা কার্যক্রম শুরু হবে। পুরো ভারত প্রস্তুত টিকা প্রদানের ব্যবস্থাপনায়। বিপরীতে আমাদের ব্যবস্থাপনা বা প্রস্তুতি কী আমরা জানি না। সুতরাং সংশয়। বিশ্বের অনেক দেশেই টিকা কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। চীন তার টিকা সিনোভ্যাক গণহারে প্রদানের ছাড়পত্র দিয়ে দিয়েছে। যদিও চীনের টিকা কার্যক্রম অনেক আগেই শুরু হয়েছে বলে বিভিন্ন মাধ্যমে জানা গেছে। কিন্তু আনুষ্ঠানিক গণহারের কথা ঘোষণা দিলো এ সপ্তাহে। ইউরোপীয় দেশগুলোতে ডিসেম্বর থেকেই শুরু হয়েছে টিকা কার্যক্রম। যুক্তরাষ্ট্রেও তাই। ল্যাটিন অ্যামেরিকার কোনো কোনো দেশও টিকা কার্যক্রম শুরু করেছে। আমাদের সমতূল্য দেশও টিকা পেয়েছে বা পাইপলাইনে রয়েছে। কিন্তু আমরা সংশয়ে।
অ্যাস্ট্রা-জেনেকা’র টিকা নিয়ে যে সংশয় ছিলো, বৃটেন অনুমোদন দেয়ায় তা কেটে গেছে। সেই টিকাই তৈরি করছে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট। যার কাছ থেকে টিকা কেনার চুক্তি হয়েছে আমাদের। কিন্তু সেই সিরাম ইনস্টিটিউট বলেছে তারা টিকা বানিয়েছে ৫ কোটি ডোজ, যা তাদের দেশেই লাগবে। সোয়া’শ কোটির দেশ ভারত, সেখানে ৫ কোটি সংখ্যাটি অসম্ভব রকম অপ্রতুল। নিজের দেশের প্রাথমিক চাহিদা না মিটিয়ে রপ্তানি করা কতটা সম্ভব বা যুক্তিসঙ্গত তা নিয়েও ভাবার অবকাশ রয়েছে। আর সেজন্যেই ভারত সরকার সিরাম ইনস্টিটিউটকে টিকা রপ্তানির অনুমতি দেয়নি। আমাদের জানুয়ারির শেষে টিকা প্রাপ্তির যে কথা বলা হয় সেটা নিয়ে এই সমীকরণেই দেখা দিয়েছে সংশয়।
চীনের সাথে সিনোভ্যাকের ট্রায়াল নিয়ে আমাদের একটা জটিলতা ছিলো। সিনোভ্যাকের উৎপাদন ক্ষমতা ভারতের সিরাম ইনিস্টিটিউটের চেয়ে বেশি। তারপরেও সেই জটিলতার জন্য সেখান থেকে টিকা প্রাপ্তি আমাদের আপাতত সম্ভব নয়। অথচ ট্রায়ালটা চলতে দিলে অন্তত জানুয়ারির প্রথম থেকেই আমাদের ভ্যাকিসিনেশন অসম্ভব ছিলো না। যাকগে, যা গেছে তাতো গেছেই, যাক। তবে আমাদের টিকা প্রাপ্তির ভারত বাদে অন্য বিকল্প জায়গার বিষয়ে কী জানা আছে কারো। আমাদের কথিত উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বায়োএনটেক বা মডার্না’র টিকা সংরক্ষণ সম্ভব নয়। আমাদের সেই তাপমাত্রার ফ্রিজার নেই। সুতরাং প্রথম অনুমোদিত টিকাদ্বয় যা ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশের লাখো মানুষ পেয়ে গেছে, তা পাবার সম্ভাবনা আমাদের নেই। রাশিয়ার টিকার বিষয়ে কোনো চুক্তি বা আলাপ-আলোচনার কথাও চাউর হয়নি। অতএব সিরাম ইনস্টিটিউটের টিকার উপরই আমাদের নির্ভর করতে হবে আপাতত। যার প্রাপ্তি নিয়ে রয়েছে বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন, সংশয়।
আচ্ছা টিকা ব্যবস্থাপনা কী অবস্থা আমাদের? মাঝখানে শুনলাম অনলাইন রেজিস্ট্রেশন করতে হবে, জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে। তারপর তাও টেঁসে গেলো। আমাদের দেশে অন্য টিকা প্রদানের নানা ক্যাম্পেইন চালু আছে। কদিন আগেই হাম-রুবেলা’র টিকা বিষয়ে ক্যাম্পেইন হলো। কিন্তু কোভিডের টিকার সে ধরণের ক্যাম্পেইন বা কোন প্রকার প্রস্তুতি কি দৃশ্যমান হয়েছে? ভারতে বেশ আগেই স্বাস্থ্যকর্মীদের সাথে স্বেচ্ছাসেবকও বাছাই করা হয়েছে। তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। নির্ধারিত করা হয়েছে টিকা প্রদানের কেন্দ্র, বুথ। আমাদেরও বলা হচ্ছিলো, ভারতের সাথেই আমরা টিকা পাবো। ভালো কথা। তবে প্রস্তুতি কই? স্বেচ্ছাসেবক কই, প্রশিক্ষণ কই? নিদেনপক্ষে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা কই? ওই যে বললাম ভয় আর সংশয়ের কথা, তা এমনি এমনি সৃষ্টি হয় না।
গণমাধ্যমে দেখলাম, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছে করোনায় মৃতের চেয়ে তিনগুন বেশি রোগী। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকেও এমন খবর পাওয়া গেছে। আক্রান্তের সংখ্যা নিয়েও রয়েছে সংশয়। বলা হচ্ছে, সরকারি হিসেবের চেয়ে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেশি। ঢাকার আক্রান্ত বিষয়ে আইসিডিডিআরবি’র গবেষণাও তাই বলেছে। যদিও পরে তারা ‘পল্টি’ দিয়েছে। এই যে ‘পল্টিবাজী’ তা সংশয়কে করেছে আরো সংশয়িত। ট্রাম্পের সমমানের চিকিৎসার কথা বলা হলেও, প্রাথমিক যে করোনা পরীক্ষা তা নিয়ে ভোগান্তির অসংখ্য কাহিনি ছড়িয়ে রয়েছে গণ ও সামাজিকমাধ্যমে। যে কাহিনি দিয়ে একটি মহাকাব্য রচিত হতে পারে। হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে মৃত্যুকথাও রয়েছে। রয়েছে খোদ চিকিৎসকেরও চিকিৎসা না পাবার সত্যগাথা। এসবের পরেও আমাদের সংশয়মুক্ত হবার কথা বলা অনেকটা উপহাসেরই সামিল।
অবশ্য উপহাসকে আমরা প্রশংসায় রূপান্তর করেছি। আমরা জানি, ট্রল হচ্ছে, স্যাটায়ার হচ্ছে, তারপরেও আমাদের কথামালা কিন্তু থেমে থাকছে না। উপহাস যদি প্রশংসায় রূপ না নিতো তাহলে কি এমনটা সম্ভব হতো? হতো না। আমাদের অবস্থা দাঁড়িয়েছে অনেকটা সে রকম, ‘মরলেও চোখটা বেঁচেছে আর কী’! আপাতত ওই ‘চোখ’ই আমাদের সান্ত্বনা।
পুনশ্চ : এই যে লিখলাম তাও ভয় আর সংশয় থেকে। ভয় আর সংশয় থাকলে মানুষের কুচিন্তা আসে না। অতএব সুচিন্তা থেকেই নতুন বছরে আশা করবো ‘বিশ’ এর বিষ যেনো একুশে আমরা ঝেড়ে ফেলতে পারি। শুভ ইংরেজি নববর্ষ।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।