ফাইল ছবি
‘কাঁটাতারে ফেলানি নয় ঝুলেছে আমার দেশ।’ আজ যখন লিখছি তখন ফেলানি হত্যার দশ বছর পুরো হলো। ফেলানি হত্যার বিচার হয়নি আজো। ফেলানির বাবার কণ্ঠে তাই অসহায় প্রতিধ্বনি, ‘দশ বছরেও বিচার পেলাম না’। না, শুধু এক ফেলানিই বিষয় নয়। ফেলানির পর অসংখ্য ফেলানি মারা গেছে সীমান্তে। কদিন আগেও আমার বিভাগ ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটেও নিহত হয়েছেন একজন। আর সব নিহতের ‘নোট’ একই হয় চোরাই গরুর কারবারি, না হয় সোজাসাপ্টা চোরাকারবারি। এমনটাই জেনেছি আমরা।
শুধু কদিন আগে ব্যতিক্রম ঘটেছে। একজন ভারতীয় মারা গেছেন গুলিবিদ্ধ হয়ে। তবে নোটের কোনো পরিবর্তন হয়নি। মৃত্যু কারো কাম্য নয়। কে বাংলাদেশি কে ইন্ডিয়ান তারচেয়ে বড় পরিচয় মানুষ। অপরাধের শাস্তি রয়েছে। যা বিচার পরবর্তী। বিচার পূর্ববর্তী শাস্তি আরেক অন্যায়। এমন শাস্তি ‘ক্যানিবাল’ চিন্তা প্রসূত। একে যারা সমর্থন করেন, তারাও তেমন চিন্তা থেকেই করেন।
কুড়িগ্রাম। এমনিতেই জেলা হিসেবে অনেকটাই অবহেলিত। আমার জেলাও তাই। মাঝখানে নদী, সে নদী পেরুলেই আমার জেলা শেরপুর। অবহেলার সারিতে শেরপুরও রয়েছে। পার্শ্ববর্তী জেলা জামালপুরে মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেক কিছুই হয়েছে। শেরপুরের ভাগ্যে জোটেনি তেমন কিছুই। এমন আরেক অবহেলিত জনপদের মেয়ে ফেলানি। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে মৃত্যু হয়েছে তার। কিন্তু এই মৃত্যুর পূর্ববর্তী ঘটনাগুলো কি অবহেলার নয়? যে হেলা সহ্য না করতে পারার পরিণতি হলে কাঁটাতারে দেয়া জীবন। এ বিষয়ে কথা বলতে গেলে অনেক কিছু বলতে হবে। কান টানলে নির্ঘাত মাথা এসে যাবে। আর সেই মাথার মুখোমুখি হওয়া বিপদের।
একদিক দিয়ে ফেলানিকে সৌভাগ্যবতী বলা যায়। তার ছবিটা বিশ্ব বিবেককে নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। সারাবিশ্বের মানবাধিকার সংগঠনগুলো তার হত্যার বিচার চেয়েছে, নিন্দা জানিয়েছে। নিন্দার মুখেই বিচারে গেছে ভারত। কিন্তু শেষমেশ অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্য অমিয় খালাস পেয়েছেন। আবার রিট হয়েছে। ভারতের মানবাধিকার সংগঠনগুলো রিট করেছে সুপ্রিমকোর্টে। সে বিচারও ঝুলে আছে। দশ বছর পর তাই আমাদেরও লিখতে হচ্ছে ফেলানির কথা। মনে করতে হচ্ছে আইনেরই পরিভাষা ‘জাস্টিড ডিলেইড, জাস্টিস ডিনাইড’।
‘ডিলেইড’ শব্দটি অবশ্য এখন আমাদের জন্য পান্তাভাত হয়ে গেছে। আদালতে হাজার হাজার মামলা পেন্ডিং। মূল মামলাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে রাজনৈতিক মামলার জটে। অগনিত মামলা রয়েছে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। একটা রাজনৈতিক কর্মসূচির পরপরই দাখিল হচ্ছে অসংখ্য মামলা। কোনো মামলায় আসামি হচ্ছেন পঙ্গু ব্যক্তিও। মৃতেরাও বাদ যাচ্ছেন না। গণমাধ্যম তাই জানাচ্ছে। যার ফলে মামলার জট বাড়ছে। আদালতের বারান্দায় অপেক্ষায় মানুষের চোখের অশ্রুর সাথে ছানিও দীর্ঘতর হচ্ছে।
তবে অনেকের জন্য আশার কথা, এগুলো আমাদের সয়ে গেছে। আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। শামসুর রাহমানের ঝাঁকের কইয়ের মতন ঝাঁকে মিশে যাচ্ছি। আমাদের উপায় কী অভ্যস্ত না হয়ে, মিশে না গিয়ে! ক্রমেই জীবন কঠিনতর হয়ে উঠছে। অল্প কিছু মানুষ হঠাৎ করেই ধনী হয়ে উঠছেন। এমন ধনী যে, বিশ্বের দ্রুততম ধনীদের রেসে প্রথম ঘোড়া হয়ে উঠেছেন তারা। অন্যদিকে তাদের সাথে দৌড়াতে গিয়ে বেতো ঘোড়া মধ্য ও নিম্নবিত্তদের জান যাবার দশা। তাদের অন্য দিকে তাকাবার সময় কই? নাই, তারা আছেন সর্বক্ষণ দৌড়ের উপর। এক সন্তান নিহত হয়েছে, অন্যগুলো বেঁচে আছে তো। তাদের বাঁচাতেই নিহত সন্তানের বিচারের দিকে তাকানোর ফুসরত হয়ে ওঠে না কোনো রকমে টিকে থাকা মানুষগুলোর। মৃতদের চেয়ে জীবিতদের প্রায়োরিটি তাদের কাছে বেশি। এসব মানুষ আছে রেসের মাঠে। টিকতে হলে দৌড়াতে হবে। এখানে ‘ডেড হর্সে’র কোনো মূল্য নেই। ‘ডেড’ মানে সর্বতভাবেই ‘ডেড’।
যাকগে ফিরি ফেলানি প্রসঙ্গে। অবশ্য ফেরার কী আছে। এই মৃত্যু আর দশটা মৃত্যুর মত নয়। এরসাথে জড়িয়ে গেছে অনেক কিছু। রাজনীতি, কূটনীতি- সব। সাধারণ মৃত্যুর বিচার পেতেই আমাদের এক দশক যায়। আজকে যখন লিখছি তখনই গণমাধ্যমে দেখলাম, এক ব্যক্তি তার স্ত্রীর হত্যার দায় থেকে নয় বছর পর খালাস পেয়েছেন। অর্থাৎ নয় বছর বিচার প্রক্রিয়া চলেছে। সাথে ওই ব্যক্তির জীবন থেকে চলে গেছে নয়টি বছর। ফেলানির পরিবারের দশ বছর। আমাদের এই বছর গোনা ছাড়া আর কী করার আছে!
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।