ফাইল ছবি
সাঈদ স্যাম
১.
বিশেষজ্ঞদের ভাষায় চরের জমিকে বলা হয়—“হিডেন ডায়মন্ড”। কুড়িগ্রাম হিডেন ডায়মন্ডের জেলা। কুড়িগ্রামের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ লোক চরে বসবাস করে। নদ-নদীর জেলা কুড়িগ্রাম। পরিচিত মোট ২০টি নদ-নদী।
নদী গবেষকদের মতে, ৫০ টির বেশি নদ-নদী আছে কুড়িগ্রাম জেলায়। সবকটি উপজেলাকে নদী তার মাতৃআঁচল দিয়ে আগলে রেখেছে। কুড়িগ্রাম জেলায় ৫০০টির অধিক চর। বসতির সঙ্গে চোখের সীমানাজুড়ে ধূ-ধূ ভূমি। মূল ভূমি থেকে যোগাযোগ বিছিন্ন জনপদে দুর্গম যোগাযোগ, মারাত্মক ভাঙ্গনপ্রবণ, বন্যা, খরা, বাল্যবিবাহ, বেকারত্ব, খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা প্রভৃতি থেকে বঞ্চিত। তবুও, অশেষ বঞ্চনাময় জীবন নিয়ে টিকে আছে।
“বাংলার প্রতি ঘর, ভরে দিতে চাই মোরা অন্নে”
স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেক স্লোগানের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি স্লোগান ছিল এটি। অথচ দেশ স্বাধীন হবার আজ অর্ধশত বছর হলেও সরকারি পরিসংখ্যান মতে, কুড়িগ্রাম জেলায় দারিদ্রের হার ৭০ শতাংশের উপরে। সরকার যায়, সরকার আসে কিন্তু কুড়িগ্রাম জেলার কপালের দারিদ্রের তিলকফোঁটা যায় না। কেউ ঘুচায়নি এই তিলকফোঁটা। তবে কি দারিদ্রের তিলকফোঁটা ঘুচাবার উপায় নেই?—আছে। হিডেন ডায়মন্ডও পারে কুড়িগ্রাম জেলার ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে।
২.
৫০০টির অধিক চর ও ৫০টির অধিক নদ-নদী বিপুল সম্ভবনা নিয়ে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ভরা যৌবনে নদীগুলো কুড়িগ্রাম জেলায় অকৃপায় সৌন্দর্য বিলিয়ে দিয়ে যায়। এই অপার সৌন্দর্য শুধু কুড়িগ্রাম জেলার মানুষের মাঝে থাকতে চায় না। কুড়িগ্রামের সৌন্দর্য গোটা বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের মানুষের দু’নয়নে ধরা দিতে চায়। কুড়িগ্রামের সাথে ভারতের নৌ-পথের যোগাযোগের সম্পর্ক আজো দৃশ্যমান। দেশের সবচেয়ে গরিব জেলাটিতে চর ও নদ-নদীকেন্দ্রিক পর্যটন শিল্প গড়ে তুললে কর্মক্ষেত্রে এক নতুন আলোর দ্বার উন্মোচিত হবে। ঢাকা থেকে কুড়িগ্রামে অবলীলায় নৌপথে আসা যায়।
ইউএনডিপি ও এসকাপের তথ্য মতে, সড়ক পথে যাতায়ত খরচ ২১৭ টাকা, রেলপথে খরচ ৮৫ টাকা সেখানে নৌপথে খরচ মাত্র ২৫ টাকা। এতে করে নৌ-পথের যোগাযোগ বেড়ে যাবে। মানুষ আবার নদ-নদীকে নতুন ভাবে জানবে। কি অসীম কৃপা নদ-নদীর! ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমারের সৌন্দর্য যে একবার দু’নয়নে দেখবে, সে কখনোই ভুলতে পারবে না। এই বিপুল সৌন্দর্যকে পর্যটকদের কাছে ভাগাভাগি করে দিতে চাইলে চরগুলোতে রাত্রিযাপনের জন্য ব্যবস্থা দরকার। এই ব্যবস্থার জন্য ইট-পাথরের বড় বড় দালান কোটা লাগবে না। চরের জমির বুকে যে কাশ জন্মায়—সেই কাশ দিয়ে নান্দনিক করে ঘর করলেই চলবে। এই ঘরগুলোতে শীতকালে শীত কম লাগে, গরমকালে গরমও কম লাগে। কি দারুণ না! আসলেই এই চর ও নদ-নদীগুলো কুড়িগ্রাম জেলার চেহারা পাল্টে দিয়ে খুব দ্রুত পোক্ত বেদিতে বসাতে পারে। সারাদিন ও সারারাত উপভোগ করবার মতো কুড়িগ্রামের চর ও নদ- নদীগুলো। ক্ষণে ক্ষণে রূপের সম্ভার মেলে। ষড়ঋতুর দেখা মেলে কুড়িগ্রামে। ব্রহ্মপুত্রের পুবে আসাম। পাহাড়। বধুর ঢেঁকির আওয়াজে পৃথিবীর ঘুম ভাঙিয়ে নবীন সূর্য মাথা তুলে দাঁড়ায়। আস্তে আস্তে মাথার উপরে সূর্য হাজির। উপরে তাকানো দায়। নিচে তাকাতে হয়। চিকচিক করে বালু। এ শুধু বালু না, কালো সোনা। ভূতত্ত্ব অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, যে পরিমাণ খনিজ সম্পদ পাওয়া যায় তার চলতি বাজার মূল্য ৩ লাখ, ২০ হাজার ৮৯২ টাকা। বালুকারাশির বুকে সারি সারি করে কয়েকটি কাঠের কপাটে হ্যারিকেন ঝুলানো থাকলে অমাবস্যার রাতে পর্যটকরা সেই আলোর নিচে দাঁড়িয়ে ফটো তুলতে পাবেন। যা সারা দুনিয়ায় চোখের পলকে ছড়িয়ে যাবে। পর্যটকরা টঙ ঘরে প্রিয়জনের পাশে বসে পড়ন্ত বিকেলবেলায় চরের আবাদি মাষকলাই, সরিষা, ছোলা, বাদাম, ভুট্টা, চাল ভাজা বা মুড়ি চিবুতে চিবুতে রক্তিম সূর্যটি পশ্চিমের গ্রামে আশ্রয় নিতে যাবার এক বেদনাতুর আখ্যান দেখবেন। মুক্ত আকাশে পুব থেকে পশ্চিমে পাখিরা যাচ্ছে। জলে তার প্রতিচ্ছবি। গোধূলির ক্ষণ বেলা কার না ভালো লাগে? একটু বিছানায় গা দিতে না দিতে রাতের আহার। প্লেটে সবজি, সিঁদল ভর্তা, কচু পাতা ভর্তা, আলু ভর্তা, বাদাম ভর্তা, শুঁটকি ভর্তা, ডাল, নদীর মাছ দেখে জিভে জল এসে যায়। এক প্লেট ভাত বেশি করে খেতে হবেই পর্যটকদের। আহার সারতে না সারতেই বাঁধভাঙা জ্যোৎস্না তার সৌন্দর্য নিয়ে হাজির। কে থাকে আর ঘরে? জ্যোৎস্নার আলোয় প্রিয়জনের আলতো হাতটি ধরতে সাধ সবারই জাগে। আনমনে হাঁটতে থাকবেন পর্যটকরা। খোলা আকাশের নিচে খেলতে পারেন গোল্লাছুট, কানামাছি, হাড়িভাঙ্গা, বুড়িছ্ছিসহ নানা ধরনের খেলা। ফিরে যাবেন দুরন্ত শৈশবে। উপরে জ্যোৎস্না তার ঢালিতেছে আলো নিচে ভাওয়াইয়ার আসর। সকালে ঘুম থেকে উঠে চা-পরটার বদলে যদি চরের সাবেন্তু আলু (মিষ্টি আলু) খাওয়া যায় তাহলে পর্যটকরা এই আলু খাবার লোভে ছুটে আসবেন। কাউনের চালের ফিরনির স্বাদ ভুলবার তাগদ আছে কার? তীরে বাঁশের মাচা করে নদীর তীরে ছোট্ট ছোট্ট নৌকা সারি সারি করে বাঁধা থাকলে পর্যটকরা নদীর বুকে ভাসবেন। নদ-নদীর অববাহিকায় পলল মাটির ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে বেড়ে উঠা মানুষের জলজ স্বরের কথায় পর্যটকের মন ভরে যাবে। ভাববেন এ’তো মানুষের জেলায় আছি। বিদায়বেলা হরেক রকমের মসলায় পান-সুপারি না খেলে কি চলে? অতৃপ্তি থেকে যায় স্বজনের জন্য দু-চারটি পান বেঁধে না নিলে।
“ও বৈদেশা বন্ধু রে
ও মোর সোনা বন্ধু রে
ও মোর প্রাণের বন্ধু রে
একবার উত্তর বাংলা আসিয়া যান
হামার জায়গাটা দেখিয়া যান
মনের কথা শুনিয়া যান রে
তোমার কথা কয়া যান রে”
৩.
চরে শত সমস্যার মাঝে রয়েছে হাজারো সম্ভবনার দুয়ার। বিস্তীর্ণ জমিতে বিপুল জনগোষ্ঠি ফসল ফলাতে পারেন। প্রচুর পরিমাণে পতিত জমি থাকা ও মূল ভূখণ্ডের তুলনায় মাটির উর্বরতা বেশি হওয়ার কারণে চর এলাকাগুলোতে কৃষি উৎপাদন এলাকা হিসেবে বেশ সম্ভাবনাময়। চর এলাকার এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো সম্ভব হলে, চর এলাকায় দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাসকারী জনসংখ্যার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নও সম্ভব হবে। এই চিত্রটি গোটা কুড়িগ্রাম জেলার। চর এলাকাগুলোতে ধান, ভুট্টা, বাদাম, পেঁয়াজ, সরিষা, পাট, ডাল, গম, তিল, মরিচ, সবজি, কলা, আলু, থেকে শুরু করে মিষ্টি কুমড়া, লাউসহ বিভিন্ন ধরনের বৈচিত্র্যপূর্ণ ফসল চাষ হয়ে থাকে এবং গবাদি পশুও লালন-পালন করা হয়।
চর জীবিকায়ন প্রোগ্রামের (সিএলপি) সূত্র থেকে জানা যায়, ‘চর এলাকার মানুষ সচরাচর কৃষি কাজের নতুন এবং বিকল্প পন্থা খুঁজে বের করা নিয়ে বেশ আগ্রহী থাকে।’ এই কৃষি কাজ একই সাথে যেমন জমির ইজারা নেয়া মানুষগুলোর জন্য আয়ের উৎস হিসেবে কাজ করবে, তেমনি কৃষি চাহিদা তৈরিতেও ভূমিকা পালন করবে। শুধু তাই নয়, এই বৈচিত্র্যপূর্ণ ফসলের চাষ বাজারের জন্য সম্ভাবনার নতুন এক দুয়ার খুলে দিবে।
২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে কুড়িগ্রাম জেলার চর এলাকায় এগ্রো ইনপুট সামগ্রী বিক্রয়ের পরিমাণ ছিল ৮৩,৭০৪,৫০০ টাকা (৮.৩ কোটি টাকা) এবং মোট ভূমির আয়তন ছিল ৫৬,৫১৮ একর। নাগেশ্বরী উপজেলায় বিক্রয়ের পরিমাণ ছিল সবচেয়ে বেশি ২৪,৩৫৩,০০০ টাকা (২.৪ কোটি টাকা), এখানে কৃষি ভূমির পরিমাণ ছিল ১২,০৮৫ একর। নাগেশ্বরীর চর এলাকায় ফসল চাষের ভিত্তিতে জমির একরের পরিমাণ ছিল—বোরো ধান-৮৫৪১ একর, পাট-৭৫৫৫ একর, ডাল-৬৫৭১ একর, আমন ধান-৪১২২ একর, সরিষা-২১৭৫ একর, সবজি-৫৩৪ একর, ভুট্টা-৫১৬ একর, কলা-২৬৫ একর, বাদাম-১৮৯ একর, পেঁয়াজ-১৭০ একর, গম-৪৭ একর, মরিচ-১৭ একর। এখানকার গুরুত্বপূর্ণ হাট-বাজার নারায়ণপুর, কঁচাকাটা, গাবতলা, মাদারগঞ্জ।
ভুরুঙ্গামারীতে বিক্রয়ের পরিমাণ ছিল ১৭,১৩২,০০০ টাকা (১.৭ কোটি)। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হাট হলো—ভুরুঙ্গামারী, সোনাহাট, একতা বাজার, পাগলার হাট এবং ব্রিজপাড় হাট।
কুড়িগ্রাম সদরে ১৫,৪৭৩,৫০০ টাকা, (১.৫ কোটি)। এর মধ্যে তিনটি হাট-বাজারে বিক্রয়ের পরিমাণ ছিলো উল্লেখযোগ্য—যাত্রাপুরে (৫৬ লাখ) টাকা; ঘোগাদহে (৩১ লাখ) টাকা; এবং কুড়িগ্রামে (২৬ লাখ) টাকা।
উলিপুরে ১৫,৭৭৯,০০০ টাকা (১.৫ কোটি)। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য চারটি হাট-বাজারে বিক্রয়ের পরিমাণ ছিলো—উলিপুর হাট (৪২ লাখ টাকা); থানা হাট, বজরা বাজার, থেত্রাই বাজারে বিক্রয়ের পরিমাণ ছিলো প্রায় (১৭ লাখ টাকা)। এবং চিলমারীতে ১০,৯৬৭,০০০ টাকা (১.৯ কোটি)। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হাট-বাজারে বিক্রয়ের পরিমাণ ছিলো—ডাটিয়ারচর (৪৬ লাখ) টাকা; জোড়গাছ বাজার (৪০ লাখ) টাকা; নটরকান্দিতে (১২ লাখ) টাকা।
বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করে চরের উৎপাদিত শস্য-পণ্যের উপর ব্র্যান্ডিংয়ের সাথে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের চরে বিনিয়োগে আগ্রহী করে তুলতে হবে। কৃষকদের জন্য সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা যাতে করে মহাজনের কাছ থেকে সুদের উপর টাকা নিতে না হয়। যে কৃষক মহাজনের সুদের টাকার চক্রে পড়েছে সে আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি। ফলে এই ঋণের বোঝা কমাতে পাড়ি জমান দূর-দূরান্তে। প্রাণের পতির দূরদেশে থাকার ব্যথা শুধু নয়া বধূর হিয়াই জানে। তারা চাষাবাদে অনাগ্রহী হয়ে যায়, কৃষিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। মধ্যস্বত্ত্বভোগি যেন কৃষকদের কাছ থেকে পণ্য ক্রয় করতে না পারে সেজন্য সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ক্রয় করতে হবে। চর এলাকায় মার্কেট প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাহলে কৃষকরা পুরোদমে আবার পলির মতো বুক ফুলে দাঁড়াবেন। কৃষকরা এতে মর্যাদা নিয়ে বাঁচবেন। চাঁদ ও রমণীরা আবার শস্যের উন্নত শীষে আলতো করে স্পর্শ করবেন। চর ও হাওরাঞ্চলের উন্নয়ন সহযোগিতার জন্য আলাদাভাবে বাজেট প্রণয়ন ও বাজেটের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করতে হবে।
বাংলাদেশ উর্বর ভূমির দেশ, কৃষি ভূমির দেশ, নদ-নদীর দেশ। বাংলাদেশের গর্ভে আরেক বাংলাদেশ কুড়িগ্রাম। উর্বর ভূমি, কৃষি ভূমি, নদ-নদী ও মানুষের জেলা কুড়িগ্রাম। বুকে বল্লমের ছেদ নিয়ে আর কতকাল হিডেন থাকবে হিডেন ডায়মন্ড?
লেখক: সাঈদ স্যাম, শিক্ষার্থী, অনার্স (চতুর্থ বর্ষ), রাষ্ট্রবিজ্ঞান, কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ।
ই-মেইল: [email protected]
বাংলা/এসএ/