• ১৪ জানুয়ারি ২০২১ ১৯:৫৬:২৯
  • ১৪ জানুয়ারি ২০২১ ১৯:৫৬:২৯
অন্যকে জানাতে পারেন: Facebook Twitter Google+ LinkedIn Save to Facebook প্রিন্ট করুন
বিজ্ঞাপন

রক্তনালী শুকিয়ে গেছে, রক্তশুন্য দেশ


মামুনুর রশীদ মামুন :


১. বাংলাদেশকে বলা হয় নদীমাতৃক দেশ। মাতৃক শব্দটি এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অর্থ-প্রকাশ করে। মায়া মমতা দিয়ে লালন করে মায়ের ভূমিকায় থাকার বিষয়টি  এক শব্দেই ফুটে ওঠে। নদীই মা এই কথাটি চিরন্তন সত্য। এই দেশের কৃষি, কৃষি শিল্প, মৎস্য, পরিবেশ ও যোগাযোগ কত কিছু নির্ভর করে নদীর উপর। খেয়াল করুন, কৃষি ভিক্তিক অর্থনীতির আধার আমাদের নদীগুলো নয় কি?

হ্যাঁ অবশ্যই তাই। বাংলাদেশে ছোটবড় ৭১০ টি নদীর অবস্থান সরকারিভাবেই স্বীকৃত। যার মধ্যে আন্তর্জাতিক নদী ৫৭ টি। ভারত বাংলাদেশ অভিন্ন নদীর সংখ্যা ৫৪ টি। তবে একটি নির্ভরযোগ্য গবেষণায় উঠে এসেছে এই সংখ্যা  ৫৪ টির স্থলে হবে ৯৬ টি। অর্থাৎ বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ নদী কমিশনের তালিকা বহির্ভূত নদীর সংখ্যা ৪২ টি। যার মধ্যে ৩৭ টি নদী ভারতের সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এর মধ্যে কয়েকটির নাম বলতে গেলে কর্ণফুলী, শিয়ালদহ, গঙ্গাধর, ফুলকুমর, রেংখিয়াং, ঘাগটিয়া, নয়াগাংজৈন্তাপুর, ডাকাতিয়া, ঘুকসী, চিংগ্রী ও সিংগিমারী উল্লেখযোগ্য।  

বাংলাদেশের সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রবেশ করেছে ৬ টি নদী। যার মধ্যে শুধুমাত্র কুলিক নদীটি যৌথ নদী কমিশনের তালিকাভুক্ত ৫৪ টি নদীর একটি। বাকি ৫ টি নদী হলো বেরং, ভেরসা, রাক্ষুসীনি তেতুলিয়া, লোনা ও চিরি।

তথ্যগুলো মাহবুব সিদ্দিকী ও সরদার আব্দুর রহমানের গ্রন্থনায় প্রকাশিত নদী ও পরিবেশ বাচাও আন্দোলন, বাংলাদেশের ঘোষণাপত্র থেকে পাওয়া। 

মোদ্দা কথা নদীমাতৃক বাংলাদেশের এতগুলো আন্তর্জাতিক নদী  স্বীকৃতিই পায়নি। এমনকি এসব নদীর স্বীকৃতি নেই ভারতেও। এই নদীগুলো শাসন ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে কতটা আশা করতে পারি আমরা সেটা বলাই বাহুল্য।

২. কতভাবে কত কিছু নজরে আসে আমাদের। এই ধরুণ তালিকার বাইরের ৪২ টি আন্তঃনদীর একটির নাম ফুলকুমর। ফুলকুমর নদীটি কুড়িগ্রাম জেলার ভুরুঙ্গামারী উপজেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এবং এর গতিপথ নাগেশ্বরী উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত। ঘটনা সেটা নয়, ঘটনা হলো ষড়যন্ত্র হচ্ছে ফুলকুমর নদীটিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড় করিয়েছে প্রভাবশালী দখলবাজের দল। সম্প্রতি ফুলকুমরের বিরুদ্ধে একটি বড় শক্তি সংগঠিত হচ্ছে। এদের কার্যকলাপের বর্ণনা পেলে আঁতকে উঠবেন। এরা ষড়যন্ত্র করেছিল ফুলকুমর প্রবাহের শেষ দুই কিলোমিটার বালু ভরাট করে তা দখল করে ফেলার। চিন্তা করুন, ফুলকুমরের মতো একটি আন্তর্জাতিক নদীর প্রবাহের শেষ দুই কিলোমিটার বালু ভরে বন্ধ করে ফেলা হবে সেটা কি সহজে চিন্তা করছে নদী-খেকোরা। অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছেন নদীর পানি হবে বাধাহীন। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন বলছে, নদী অবৈধভাবে খনন, ভরাট কিংবা নদীর গতিপথ কৃত্রিমভাবে পরিবর্তনের চেষ্টা করা হলে সেটা অপরাধ। সংবিধান এই অধিকার কোনো প্রভাবশালীদের দেয়না। বলে রাখা ভালো যে, গত ১২ই ডিসেম্বর ফুলকুমর এবং দুধকুমরকে জোরপূর্বক একত্রিত করে ফুলকুমর বালু দিয়ে ভরাট করার পক্ষে জনমত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে নদীর পাড়ের এলাকাগুলোতে প্রকাশ্যে মাইকিং করা হয়। এই ভরাট হলে অবৈধভাবে দখল করা সম্ভব হবে হাজার হাজার বিঘা জমি। আর আসল খেলাটা এখানেই। রাজনৈতিক নেতাদের আনাগোনা অত্যধিক হারে বেড়ে যায় নদীর পাড়ে। এই সিন্ডিকেটের পক্ষ নিয়ে সেদিন  নদীর পাড়ে আসেন রংপুর বিভাগের শ্রেষ্ঠ  উপজেলা চেয়ারম্যান খেতাবপ্রাপ্ত কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী উপজেলা চেয়ারম্যান  নুরন্নবী চৌধুরী খোকন। সেখানে তার হুকুম তামিল করতে স্পটে আসে দুধকুমর খননের কাজে দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বিআউডব্লিউটিএ'র ভাড়া করা এসকাবেটর (ভেকু) মেশিন। ততক্ষণে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যানকে বিষয়টি জানানোয় সরাসরি তার হস্তক্ষেপে এ যাত্রায় নদীর পাড় কাটা বন্ধ করা হয়। তবে নুরুন্নবী চৌধুরী খোকন বলেন, দরকার পড়লে আমরা মন্ত্রীর কাছে যাবো। তবু এই ভরাটের কাজটা পাশ করায়ে আনতে হবে। এইটুকু ভরাট হলে এলাকাটা অনেক ডেভলপ হবে। 

তার সাথে ছিলেন ভুরুঙ্গামারী উপজেলার আন্ধারীঝাড় ইউপি চেয়ারম্যান রাজু আহমেদ খোকন। 
কিছুক্ষণ পরেই ফুলকুমর পাড়ে আরও একটি মজলিস হয়। যেখানে অংশগ্রহণ করেন ভুরুঙ্গামারী উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুন্নবী চৌধুরী খোকন, নাগেশ্বরী উপজেলা চেয়ারম্যান মোস্তফা জামান, নাগেশ্বরী উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও রায়গঞ্জ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি  রুকনুজ্জামান শিমু, রায়গঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আ স ম আব্দুল্লাহ আল ওয়ালিদ মাসুম, আন্ধারীঝাড় ইউপি চেয়ারম্যান রাজু আহমেদ খোকন।

সেই সভায় সিদ্ধান্ত হয় ডিসির কাছে নদীর পাড় কেটে ফুলকুমরের বাকি অংশ ভরাট করার অনুমতি চাওয়া হবে। তারা চেষ্টাও করেছিলেন। 
কিন্তু সেই অনুমতি আর পাওয়া হয়নি।

ঘটনা এখানে থেমে গেলে ভালো হত। কিন্তু তা আর হয়নি। গত ৩০শে ডিসেম্বর রাতের অন্ধকারে ফুলকুমর ও দুধকুমরের পাড় কোঁদাল দিয়ে কেটে ফেলে শতশত শ্রমিক। অজ্ঞাত ব্যক্তিবর্গের নির্দেশে এই কাজটি করে তারা। 

সরকারি দ্বায়িত্ব পালন করে এমন সকল দফতরে অবগত করেও আমরা এর প্রতিকার পাই নি। এখন যদি তারা নদীটি ভরাট করে ফেলতে সফল হয় তাহলে আমাদের আর কিছু করার থাকে না। সম্ভবত এটাই এই নদীর নিয়তি।

৩. গত ৬ই সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে দুধকুমর পাড়ে মানববন্ধন করে রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি, বাংলাদেশ স্বেচ্ছাসেবক ফাউন্ডেশন সহ আরও কিছু স্থানীয় সামাজিক সংগঠন। তাদের দাবি ছিল দুধকুমর নদের সঠিক খনন, বাধগুলো সংরক্ষণ এবং বন্যা ও নদীভাংগনে আক্রান্তদের জন্য সরকার কর্তৃক সহায়তা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা। হাজার হাজার সাধারণ মানুষ সেদিন মানববন্ধনে উপস্থিত হয়ে দাবিগুলোর সাথে সংহতি প্রকাশ করে। তারপর আয়োজন করে দুধকুমরে ড্রেজার আসে। খননও হচ্ছে। কিন্তু খননের পর বালু রাখছে কোথায়? অবাক হবেন কিন্তু সত্য খবর বালু নদীতেই ফেলা হচ্ছে। এই বালু আবার নদীতে নামতে শুধু বর্ষা আসার অপেক্ষা। তারপরে বালু আবার সাবেক জায়গায়, পরের বছর আবারও কয়েকশত কোটি টাকা বাজেট। ব্যাস, সবাই মিলে বিস্তর খাই দাই। এ ব্যাপারে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, নদীর যত্নের নামে এই খনন আসলে প্রহসনে পরিনত হয়েছে।
প্রশ্ন আসতে পারে তাহলে বালু রাখা হবে কোথায়? 

কুড়িগ্রামের ডিসি জানিয়েছেন, এটি অবশ্যই নদী থেকে এক কিলোমিটার দুরে হতে হবে।
কিন্তু সে কথা মানতে তো হবে। না মানলেই কেল্লাফতে। নদীর ভেতরে বালু ফেলার পরও নদীর উপর পাড় বেধে বালু ফেলা হয়েছে। আরও বড় বিষয় একটি সিন্ডিকেট তৈরী হয়েছে যারা এই বালু বিক্রি করে খাওয়ার ধান্দায় বিভোর। বিআইডব্লিউটিএ'র উপ-সহকারী প্রকৌশলী আসাদ নামের এক ভদ্রলোক। এক্ষেত্রে তিনি আরেক কাঠি সরেস। কথা বলতে চাইলে বললেন তার হাতে সময় নেই। বালু নদীর মাঝখানে কেন তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই বালু ইউএনও মহোদয় নিয়ে যাবেন। 

কিন্তু ইউএনও কেন নিয়ে যাবেন আমরা ভেবে পাই না। তাতে কি এই বালুর বিনিময়ে রাষ্ট্রের আয়ের কোনো সম্ভাবনা আছে?

যদি না থাকে তো এসব প্রকাশ্য দুর্নীতি। এই দুর্নীতি বিভিন্ন সেক্টরের কর্মকর্তারা জায়েজ ভেবেই কি করছেন এক্ষেত্রে?
প্রশ্নগুলো থাকেই।

আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট জোর দাবি জানাই, জনকল্যাণমুখী এই প্রজেক্ট গুলোতে নজরদারি রাখুন। নয়তো এগুলোর জন্য জনগণের অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি হয়। এদের গতবছরের দুর্নীতির বলি হয়ে আমরা ধাউরারকুটি হারিয়েছি, উত্তর বড়বাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়েছে। কারণ তারা নদীর পাড়ে বালি রেখে ভেগেছিল। সেই বালি বৃষ্টি ও বন্যার পানিতে ভেসে ফের নদীতে। তাতে একপ্রান্তে নদীর গভীরতা নাই বললেই চলে। স্রোত ছুটলো অন্য প্রান্ত দিয়ে। ব্যাস সব খতম। আমার ট্যাক্সের শত শত কোটি টাকা যদি অপরিকল্পিত ভাবে অপচয় হয় তো সে দায় প্রধানমন্ত্রী এড়াতে পারেন না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমরা জানিয়ে রাখি এবারও যদি কারো পকেট ভারী করার কারণে নদীর পাড়ের মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হই তো এবার জলোচ্ছ্বাস দুধকুমর পাড়েই হবে।
সাইক্লোনের উৎপত্তিস্থল হবে দুধকুমর। আমাদের অনুরোধ, সঠিক নজরদারি রাখুন। 

৪. এখানে ফুলকুমর নদ নিয়ে আরও কিছু না বললে অন্যায় হবে। এর বিভিন্ন বাঁকে বাঁকে বালু দস্যুরা আস্তানা গেড়েছে। অবৈধ বালু উত্তোলনের কারণে অনবরত পাড় ভাংছে শান্ত সুন্দর এবং সুশৃঙ্খল এই নদীটির। শুধুমাত্র একদিন একটি ইউনিয়নে ফুলকুমরের পাড় ঘুরে আমি অন্তত তিনটি অবৈধ লোকাল ড্রেজারের সন্ধান পেয়েছি।  নদীর পাড় এমনকি নদীর পানি কমে যাওয়ায় নদীর ভেতরের জমি যে যেভাবে পারছে দখল করে নিচ্ছে। এগুলো বন্ধ করতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া কোনো উপায় নাই। কারণ এই নদীর খোঁজ তো প্রশাসন নেবে না। যৌথ নদী কমিশনের তালিকাতেই তো নেই এই নদীর নাম। ফুলকুমরের মতো একটি আন্তর্জাতিক নদীকে দখলমুক্ত করতে সাধারণ মানুষের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিকল্প আর কিছু নেই। সবাই মিলে প্রতিহত করতে হবে নদী খেকো আর বালুদস্যুদের।

৫. প্রত্যেকটি নদীই প্রাকৃতিক প্রবাহ। এগুলো  মানুষের দ্বারা সৃষ্টি হয় নি। কাজেই এটা ভাবা বোকামি যে নদীর দ্বারা আমার ক্ষতি হচ্ছে তাই কোথাও খুড়ে দেবো, কোথাও ভরাট করবো বা নদীর গতিপথ বদলে দেয়ার চেষ্টা করবো। নদী গুলো আমাদের অহংকার হওয়া উচিৎ ছিল। একাত্তরে আমাদের শ্লোগান ছিলো, 
"তোমার আমার ঠিকানা / পদ্মা মেঘনা যমুনা।"
নদী গুলো আমাদের পরিচয় বহন করেছিল।  

এরপরেও সৈয়দ শামসুল হক তার কবিতায় প্রশ্ন ছুড়েছেন সকলের প্রতি, কি আছে তোমার দ্যাশে? / নদী আছে?

নদীকে আমরা মা বলি। কিন্তু যে জন্ম পরিচয়হীন সন্তানেরা মায়ের বুকে ছুড়ি বসায় তাদের দু একজনের ভয়ে আমাদের লুকিয়ে থাকার সুযোগ নেই। নদী বাঁচাতে জেগে উঠতে হবে। আমরা জেগেছি, জাগুন আপনিও। 
আসুন রুখে দাঁড়াই। আপনার বাড়ির পাশের নদীটি রক্ষা করার দ্বায়িত্ব আপনার।

লেখক : সংগঠক

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
Page rendered in: 0.1539 seconds.