• ১৮ জানুয়ারি ২০২১ ১৯:৪৩:১৯
  • ১৮ জানুয়ারি ২০২১ ১৯:৪৩:১৯
অন্যকে জানাতে পারেন: Facebook Twitter Google+ LinkedIn Save to Facebook প্রিন্ট করুন
বিজ্ঞাপন

ডাচ সরকারের পদত্যাগ এবং আকড়ে থাকার রাজনীতি

ছবি : সংগৃহীত


কাকন রেজা :


বিশ্বাস করতে পারেন, শুধুমাত্র একটি অভিযোগের কারণে ডাচ সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ পুরো সরকার পদত্যাগ করেছে। বিবিসি’র খবর অনুযায়ী ২৬ হাজার পরিবারের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ আনে নেদারল্যান্ডের কর বিভাগ। যদিও পরে এই অভিযোগটি ভুল প্রমানিত হয়।

বেশ কিছু পরিবার এ কারণে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে। কর বিভাগের এই ভুলের বিষয়ে নেদারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুট বলেন, ‘কিছু মানুষকে অপরাধী বানানো হয়েছে, কিছু মানুষের জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে। এর দায় সরকারে থাকার কারণে আমরাও এড়াতে পারি না।’ এ কারণেই গত ১৬ জানুয়ারি পদত্যাগ করে রুটের নেতৃত্বাধীন পুরো মন্ত্রিসভা। অথচ পদত্যাগের দুই মাস পরেই নির্বাচন। চিন্তা করুন তো, দুই মাস পর নির্বাচন জেনেও পদত্যাগ করেছে একটা সরকার! ক্ষমতা আকড়ে থাকার কোনো চেষ্টাই তাদের মধ্যে নেই!

দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে এমনটা চিন্তা ও বিশ্বাস করা কঠিন। কর বিভাগের ভুলের জন্য প্রধানমন্ত্রীসহ পুরো সরকারের পদত্যাগ, এমনটা এ ভূখন্ডে চিন্তারও বাইরে। নচিকেতার একটা গান আছে ‘হাল্লাবোল’ শিরোনামে। সে গানে নচিকেতা বর্ণনা করেছেন ভারত থেকে কত টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। মন্ত্রীদের যাচ্ছে তাই গালি দেয়া হয়েছে সেই গানে। নচিকেতার গানে ভারতের রাজনৈতিক আবহাওয়া পরিবর্তন হয়নি ঠিকই তবে সেজন্যে তাকে জেলেও যেতে হয়নি। সান্ত্বনাটা এখানেই। কিছু না হলেও অন্তত গলা ছেড়ে গান গাইতে পেরেছেন নচিকেতা। ভারতে জীবনমুখী গানের একটা চল রয়েছে। মানুষ নিজের ক্ষোভ মেটায় গান গেয়ে ও শুনে। কবিতার ক্ষেত্রেও এমন ধারা চলমান। অর্থাৎ সেখানে শোনার বিষয়ে নিশ্চয়তা না থাকলেও বলার বিষয়টি এখনো চালু।

বলতে পারেন, ভারতের মন্ত্রীদের অনুভূতি খানিকটা কম। গালিতে তাদের তেমন প্রতিক্রিয়া হয় না। অনেকটা ‘পেটে খেলে পিঠে সয়’ অবস্থা। উগান্ডার মতন অবস্থা সেখানে নেই। উগান্ডায় ভোট হলো। পরপর ছয় বারের মতন জিতলেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইয়োওয়ারি মুসেভিনি। নির্বাচন চলাকালে সেখানে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় সরকার। বিরোধীদলীয় নেতা ববি ওয়াইন বিবিসি’র কাছে জানিয়েছেন, তাকে স্ত্রীসহ বাড়িতে অন্তরীণ রাখা হয়েছে।

তিনি বলেছেন, ভোট কারচুপির অনেক ভিডিও ক্লিপ রয়েছে। যা ইন্টারনেট চালু হলেই তিনি ছেড়ে দিবেন। কিন্তু দিলেই কী লাভ। মুসেভিনি’র কানে তো তুলো, চোখে ঠুলি। তারোপর তার পক্ষে রয়েছে শৃঙ্খলা বাহিনী। শৃঙ্খল পরাতে যারা করিৎকর্মা। উগান্ডার নির্বাচন কমিশন বলেছে, শতভাগ সুষ্ঠু ভোট হয়েছে এবং তা শান্তিপূর্ণ। এমন নির্বাচন কমিশন যা বলে সাধারণত। নির্বাচনী প্রচার থেকে নির্বাচন চলা পর্যন্ত মৃত্যু ঘটেছে কয়েক ডজন মানুষের। বুঝুন কমিশনের সেই শান্তির অবস্থা। অবশ্য আমাদের না বোঝার কিছু নেই। আমরা সবই বুঝি, কিন্তু বলি না। ওই যে, সাতে-পাঁচে না থাকা দাদাদের সুরে সুর মিলাই। ‘দাদা আমি সাতে-পাঁচে থাকি না’ আর কী। রুদ্রনীল ঘোষের কবিতার মতন, ভোট দেয়া ডিউটি আমি সেটা করে দিই...

যাকগে, উগান্ডার কথা বলতে গিয়ে মনে হলো আমাদের দেশে পৌর নির্বাচন চলছে। দেখলাম এবং শুনলাম সরকার দলীয় এক হেভিওয়েট প্রার্থীকে হেভিওয়েট সব বিদ্রোহী কথাবার্তা বলতে। যদিও তিনিই বিজয়ী হয়েছেন এবং বিপুল ভোটে। তার অনেক পেছনে রয়েছেন বিএনপি ও জামায়াতের প্রার্থী। তাহলে তার হেভিওয়েট সে কথাবার্তা কার বিরুদ্ধে ছিলো? বিষয়টি ঠাহর করে উঠতে পারিনি। নিজ দল ও প্রশাসনের বিরুদ্ধেও বলেছেন তিনি। তার প্রতিদ্বন্দ্বী তো বিএনপি ও জামায়াতের প্রার্থী। তবে কি সেখানের সবাই উল্টো রথে চড়েছিলেন? বিষয়টি মূলত মাথার ওপর দিয়ে গেছে। নাকি দুষ্টু লোকের কথাই সত্যি, দেশে যে ইলেকশন হচ্ছে এবং তা সুষ্ঠু হচ্ছে এমনটা জানান দেয়ার জন্যই তিনি এসব কথা বলেছেন। কে জানে।

আবার ধান ভানতে শিবের গীত শুরু করেছি। বলছিলাম ডাচ সরকারের পদত্যাগের কথা। বিশ্বের সুখী দেশের তালিকার শীর্ষে থাকা ৭টি দেশের মধ্যে রয়েছে নেদারল্যান্ড। কেনো রয়েছে, এমন প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, তারা মানুষের মৌলিক চাহিদার সবকটিই নিশ্চিত করেছে। সেখানে একটি সন্তান জন্ম নেবার পরই তার মাথায় করের বোঝা চাপে না। সন্তানের বাবা-মায়ের ভাবতে হয় না সন্তানের শিক্ষা-চিকিৎসার কথা। ভাবতে হয় না কাজের কথা। সব নিশ্চিত করেছে সরকার। মূলত এটাই উন্নতি, উন্নয়ন। কংক্রিটের জঞ্জাল কোনো জ্ঞানেই উন্নয়নের মাপকাঠি হতে পারে না। উন্নয়ন হলো, মানুষের জীবনযাত্রা সরকার কতটা নিরাপদ করতে পেরেছে। মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক নিরাপত্তা কতটুকু। আপনার বিশাল হাসপাতাল রয়েছে, কিন্তু সেখানে চিকিৎসা দেয়ার মানুষ ও সরঞ্জাম রয়েছে কিনা। পুলিশ রয়েছে, পুলিশিং রয়েছি কিনা। আপনি মন খুলে আপনার না পাওয়ার কথা বলতে পারছেন কিনা। আর সেসব গ্রাহ্য হচ্ছে কিনা। এসব মিলে হলো উন্নতি। এসব নিশ্চিত করাই হলো উন্নয়ন।

এমন দেশের সরকার কাজ করে মানুষের জন্য। মানুষের উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য। সে উন্নয়নের বিঘ্ন ঘটলে তো পদত্যাগ স্বাভাবিক। সেবার মানসিকতা এখানেই। সরকার প্রধান কোনো চাকরি নয়। সুখী দেশগুলোতে যারা সেবা করতে চান তারাই সরকারে যান। তারা যান ত্যাগ করতে। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন আগে যে বেতন পেতেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেব তার চেয়ে কম সম্মানী পান। অর্থাৎ তিনি বেতনের জীবন ত্যাগ করে সম্মানী’র জীবন বেছে নিয়েছেন। এমন ত্যাগীদের জন্যই পদত্যাগ সহজ বিষয়। ভোগীদের ক্ষেত্রে উল্টো।

ডাচ সরকারের পদত্যাগ সেই সেবা ও ত্যাগের উজ্জ্বল উদাহরণ। গেলো বছর জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে নিজের স্বাস্থ্যগত কারণে পদত্যাগ করেছেন। কারণ তিনি মনে করেছেন, অসুস্থ অবস্থায় দেশ ও জনগণের জন্য সময় দেয়া এবং তাদের সেবা করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি জনগণের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন তার মেয়াদকাল পূরণের অপারগতায়। চিন্তা করা যায়! আমাদের চিন্তায় না ধরলেও এমন উদাহরণ অনেক রয়েছে। ক্ষমতা কামড়ে থাকার বিপরীতে ত্যাগের উদাহরণ একেবারেই কম নয়। আর সে কারণেই ট্রাম্প ও তার প্রোটো-টাইপ নেতারা থাকার পরও পৃথিবীটা টিকে আছে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

সংশ্লিষ্ট বিষয়

নেদারল্যান্ড কাকন রেজা

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
Page rendered in: 0.1374 seconds.