ছবি : বাংলা গ্রাফিক্স
অনেক আগেই বলেছিলাম, লিখেছিলাম, সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। কেউ কেউ বিষয়টি স্বীকার করলেও অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। দু’দিনের খবরের কাগজ দেখুন। শহীদ মিনারের মতন জায়গায় ধর্ষিতার বিবস্ত্র লাশ পওয়া যায়। অন্য ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মদপান করে নিজেদের বান্ধবীকে ধর্ষণ করেন। ধর্ষণ ও মদের ক্রিয়ায় মারা যায় তরুণী। মদের কারণে মৃত্যু হয় সাথের আরেক তরুণের।
আরেক ঘটনায় কক্সবাজারে জন্মদিন অনুষ্ঠানে যাবার সময় এক কিশোরীকে মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নিয়ে কয়েক দফায় ধর্ষণ করা হয়। না, এতেই শেষ নয়। আরো আছে। পরিসর বৃদ্ধি পাবে তাই উল্লেখ করলাম না। আর উল্লেখ করেই বা কী লাভ। যা হয় না নয়-এ, তা হয় না নব্বইয়ে।
ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে। সরকার ভালো বুঝেছে করেছে, ঠিক আছে। মুশকিল হলো মৃত্যুদণ্ডের শাস্তির পর ধর্ষণ কমেছে কি? না উল্টো ধর্ষণের ধরণ পাল্টে আরো বীভৎস হয়েছে? সাথে ধর্ষিতার মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে।
বলেছিলাম, ধর্ষণের শাস্তিও মৃত্যু, খুনেরও তাই। সুতরাং বিজ্ঞাপনের ভাষায় বলতে হয়, ‘একটা নিলে আরেকটা ফ্রি’। সুতরাং ধর্ষকদের মূল আর ফ্রি’র কথা মাথায় রেখেই কুকর্ম করার কথা। ফলে ধর্ষণের সাথে খুনের আশঙ্কাটাও ফ্রি হিসেবে যুক্ত হয়। ‘জীবিত থাকলে যদি বলে দেয়’ —এমন আশঙ্কায় খুন করার বিষয়টি অপরাধ বিজ্ঞান আমাদের জানিয়েছে। যারা শৃঙ্খলা বাহিনীতে আছেন, আমরা যারা ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নিয়ে টুকটাক পড়াশোনা করেছি, তারা বিষয়টি জানি। অপরাধের পর অপরাধীরা অপরাধ লুকানো এবং বাঁচার প্রয়াসে সর্বোচ্চ ধ্বংসাত্মক হতে পারে।
তাই বলে আসছিলাম সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। এই যে স্খলন, অবক্ষয় ও ধ্বংস সব তারই প্রতিক্রিয়া। সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে কেন, এই প্রশ্নের উত্তরটা জানা জরুরি। যদিও জানেন অনেকেই কিন্তু বলেন না বা সাহস করে উঠতে পারেন না। এই যে সাহস করে না উঠার কারণ, তা বিশ্লেষণ করতে গেলে সমাজের গোড়া থেকে করতে হবে। শহীদ মিনারে যে কিশোরীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে, তার সামাজিক অবস্থান অনেক নিচে। দরিদ্র, শ্রমজীবী মায়ের সন্তান। নিজেও ফুল বিক্রি করতো। সমাজের এই নিম্নআয়ের মানুষগুলো কাদের দ্বারা অত্যাচারিত হয়, যারা সমাজে কিছুটা প্রভাব ও বিত্তের অধিকারী। তাদের এই প্রভাব ও বিত্তের উৎসটা হলো স্থানীয় মোটামুটি বিত্ত ও প্রভাবশালী। সেই স্থানীয় প্রভাব ও বিত্তবানের শক্তির উৎসটা হলো আঞ্চলিকভাবে বিত্ত ও প্রভাবে অধিকারী। তার বিত্ত ও প্রভাবের খুঁটিটা কোথায়? খুঁজতে থাকুন পেয়ে যাবেন। এই খুঁটিগুলিই সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে দেবার কারণ। আর এসব খুঁটির জোরের পেছনে রয়েছে ভ্রষ্ট রাজনীতি। সুতরাং সামাজিক শৃঙ্খলার সাথে রাজনৈতিক শৃঙ্খলার একটি অভিন্ন সংযোগ রয়েছে। এই সংযোগেই রাজনীতি সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে। রাজনীতির শুদ্ধতা এ কারণেই প্রয়োজন।
শুদ্ধ রাজনীতির কথা বুঝতে গেলে রাষ্ট্র নিয়ে কথা বলতে হয়। রাষ্ট্র সমাজ পরিচালনা করে। রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকে রাজনীতি। কিন্তু রাজনীতি যখন রাষ্ট্রকে ডিঙিয়ে সরাসরি সমাজ নিয়ন্ত্রণের ভার নিয়ে নেয় তখনই সৃষ্টি হয় দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতির। এই পরিস্থিতিতে যে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয় সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার সেটাই মূল কারণ। মোটাদাগে একটি উদাহরণ দিই। থানা-পুলিশের কাজ যদি কোনো ক্ষমতাবলয় থেকে নিয়ন্ত্রিত হয় তখন দুটো বলয়ের মধ্যে অদৃশ্য এক দ্বান্দ্বিকতার সৃষ্টি হয়। মানুষ বিভ্রান্ত হয় কেন্দ্র কোনটি তা নিয়ে। থানা, না সেই ক্ষমতাবলয়। এই দ্বন্দ্বে বিভ্রান্ত হয় মানুষ, ন্যায়-বিচারে আস্থা হারায়। তখন থানা বাদ দিয়ে তারা ক্ষমতাবলয়ের দিকে ঝুঁকে যায়। তারাও ক্ষমতাবান হবার চেষ্টা করে। সেই চেষ্টার ফলে সমাজের মূল কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হলে সঙ্গত শৃঙ্খলা ভাঙবেই।
এই যে, শৃঙ্খলা ভাঙার প্রক্রিয়াটি তা বোঝার জন্য খুব বড় তাত্ত্বিক হতে হয় না। কমনসেন্সটা একটু ধারালো হলেই হয়। এরজন্য মার্ক্স, ফ্রয়েড কিংবা ফুকো লাগে না, নিজের ঘটে গ্রে মেটার থাকলেই চলে। জানি, কেউ এসব কপচান। সেজন্যে আগেই বলে নিলাম। যারা সব বিষয়েই ওনাদের টেনে আনবেন, তাদের স্রেফ ঝেড়ে ফেলেন। ভেবে নিন শর্ট-সার্কিট, ইগনোর করুন। ব্যাস, তাহলেই দেখবেন তাদের ফুকো ফোঁকা শেষ। মার্ক্স-এর মার্কস কম পড়ে যাবে এবং ফ্রয়েড কপচানোরা হয়ে যাবেন ফ্রড-তাত্ত্বিক। সুতরাং উপেক্ষা করুণ। উপেক্ষার চেয়ে বড় অস্ত্র আমাদের হাতে আপাতত নেই।
শেষ করার আগে মিয়ানমারের কথা বলি। সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে। সু চিকে নিয়ে অনেকে আফসোস করছেন। তা করুন। আফসোস করা ছাড়া আমাদের আর কী আছে। নিজের জন্যও আফসোস করি, পরের জন্যও। তাও ঘরে বসে। বাইরে দাঁড়িয়ে মুঠিবদ্ধ হাতটা তুলে জানান দেবার ক্ষমতাও নেই। সু চি’র এই পরিণতি স্বাভাবিক ছিলো। সুচি সেনাবাহিনীর সাথে আপোস করেই ক্ষমতায় এসেছিলেন। আপোসের সুখ কখনোই দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কোথাও না। ইতিহাস ঘেঁটে দেখুন, সত্যতা মিলবে।
পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত সু চি বাপের নামের ধারায় রাজনীতিতে এসেছিলেন। আসার পরই গৃহবন্দী হলেন। সেই গৃহবন্দীত্বও আয়েশের। সকল সুবিধাসহ নিজ বাড়িতে। মূলত তাকে তৈরি করা হচ্ছিলো। মানুষ ভাবছিলো এই তো আমাদের মসিহা। যখন সেনাবাহিনীর মনে হলো তাদের ভাবমর্যাদায় বড় ধরণের দাগ লেগে যাচ্ছে, তখন তৈরি সু চিকে ব্যবহার করলো তারা। ক্ষমতার ভাগাভাগি হলো। সু চিও খুশি, সেনাবাহিনীও। আর পাবলিক বরাবরই তিন নম্বর বাচ্চা। দুজন খেলো তারা আনন্দে লাফালো।
এই যে, মিয়ানমারে সংঘটিত রোহিঙ্গা বিষয়ক সকল কুকাজের দায়ভার গিয়ে পড়লো সু চি’র ওপর। সেনাবাহিনী কিছুটা হলেও থেকে গেলো আড়ালে। এখন পয়সা হজম, খেলা খতম। সু চি’র কাজ শেষ। এখন তাকে বাড়তে দিলে ছেটে দেয়া কঠিন হবে। অতএব সু চি আউট।
তবে সু চিকে নিয়ে আফসোস ও ভাবার কোনো কারণ নেই। তাকে আটক করা হয়েছে। এটাকে এক ধরণের অবসরও ভাবতে পারেন। হিসেব কষার সময় দেয়া। আপোসকামীদের জন্য রাস্তা সবসময়ই খোলা থাকে। কোনো এক আপোসে, সমঝোতায় আবার সু চি’র উত্থান ঘটবে। নয় তো আরেক সু চি খুঁজে নেয়া হবে। এর বাইরে আর কিছু নেই।
ফুটনোট : অনেকে বলেন, বর্তমান সময় আপোসহীনদের জন্য নয়। আপোসহীনদের জায়গা কারাগার না হয় মর্গ। কথাটা এক অর্থে মিথ্যা নয়। কিন্তু আপোসহীনরাই যুগে যুগে নমস্য হয়েছেন এ কথাটাও তেমন সত্যি।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।