কাকন রেজা। ফাইল ছবি
কাকন রেজা :
আড়ং এর একটা শো-রুমে গিয়েছিলাম বন্ধুর সাথে। তিনি একটা পাঞ্জাবি কিনবেন। কিনলেন, পকেট থেকে খসে গেলো হাজার পাচেঁক। কিনে তার মুখে একটা তেলতেলে হাসি। ভাবটা এমন, ‘দেখো আড়ং এর পাঞ্জাবি কিনেছি’। সেই ভাবটা ধরে রেখেই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন হলো’। আমি বললাম, যাচ্ছেতাই। চমকে ওঠে বললেন, ‘কস কি’। আমি বললাম, হ দোস্ত, এইটা বঙ্গতে কিনতে গেলে খুব বেশি হলে এক হাজার থেকে বারো’শ লাগবে। এবার বন্ধুর মুখে ‘কস কি’ উচ্চারণ বিস্ময়ের সাথে।
এই হলো আড়ং। এক কথায় মানুষের ভড়ং নিয়ে ব্যবসা করছে এবং তা সন্দেহাতীত ভাবে বলতে পারেন। আড়ং এর এসব পোশাক তৈরি করে ব্র্যাকের আরেকটা অংশ আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন। আমার জেলায় এই ফাউন্ডেশনের একটি শাখা রয়েছে। নিম্নবিত্তের নারীরা কাজ করেন এখানে। চোখ নষ্ট করে দিনভর হাতের কাজের ক্যারিশমা দেখান কাপড়ের ওপর। কিন্তু তারা কত টাকা মজুরি পান, তার একটু খোঁজ নেন। পাঁচ হাজার টাকার পাঞ্জাবি তৈরি করতে একজনের কতটা শ্রম লাগে এবং সেই শ্রমের আনুপাতিক মজুরি ন্যায়সঙ্গত কিনা এই খোঁজ কি কেউ কখনো নিয়েছেন? নেননি। অথচ অন্য দোকানে যে পাঞ্জাবি একহাজার থেকে বারো’শতে পাওয়া যায়, সেখানে আড়ং বেচছে তিন থেকে পাঁচগুন দামে।
নকশি কাঁথার কথা বলি। আমার জেলা এবং পাশের জেলায় বেশ কয়েকটি সংস্থা নকশি কাঁথা নিয়ে কাজ করছে। তারা গ্রামের মহিলাদের স্বনির্ভর করতে কাঁথা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। তাদের কাছ থেকে নকশি কাঁথা আমিও কিনেছি। কেন কিনেছি সে প্রশ্ন যদি করেন, তবে বলবো আড়ং এর দামে রীতিমত আতঙ্কিত হয়ে। আতঙ্কেই তাদের কাছে যাওয়া এবং কেনা। হ্যাঁ, আড়ং এর তিনভাগের একভাগ দামে কিনেছি সে নকশি কাঁথা। এই যে আড়ং নকশি কাঁথা বেচছে এত দামে তার আনুপাতিক হারে মজুরি কি পাচ্ছে, যারা কাঁথাতে নকশা বুনছেন তারা?
আমি যার কাছ থেকে নকশি কাঁথা কিনেছি, তাকে এবং তার সংগঠনের কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আড়ং এর এত দামের রহস্যটা কী। তারা একবাক্যে বলেছিলেন, তাদের ব্র্যান্ডিং এর এস্টাব্লিশমেন্ট কষ্ট হলো সেই বাড়তি টাকা। কী আশ্চর্য একটা প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ডিং এর খরচ নিতে হবে মানুষের পকেটে হাত ঢুকিয়ে! তাদের দোকানের সাজসজ্জা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র এবং বাতির টাকা দিতে হবে ক্রেতাদের প্রকৃত মূল্যমানের দুই, তিন বা চারগুন বেশি দিয়ে! বলিহারি দাদা।
দোষটা অবশ্য আড়ং এরও নয়। দোষটা হলো আমাদের লোকদেখানো বাৎসল্য চিন্তার। চতুর আড়ং সেই বাৎসল্যটাকেই ক্যাশ করেছে। পাঞ্জাবি নয় আমাদের দেখাতে হবে আড়ং এর সিল, লগো, স্টিকার। না হলে তো বোঝানো যাবে না, আমার বাপের কত পয়সা, কিংবা আমি নিজে কত কামাই। অন্যকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার অস্ত্র হলো আড়ং এবং সো-কল্ড ব্র্যান্ডগুলি।
প্রয়োজন এবং প্রদর্শনবাদীতা এ দুয়ের পার্থক্য আমরা ভুলতে বসেছি। না, এটা শুধু আড়ং এর স্টিকার প্রদর্শনই নয়, এ প্রদর্শনবাদীতা সবখানেই। এই যে সাহিত্যের ক্ষেত্রে আমি বলি, বিশেষ করে কবিদের ক্ষেত্রে। অনেক কবিকেই দেখা যায়, কাঁধে ঝোলা, পায়ে চটি গলিয়ে পথে নেমে যান। তাদের কাউকে কাউকে প্রশ্ন করেছিলাম, ভাই কবিতা কোথায় থাকে ঝোলায় না চটিতে। সবারই আঁতে লেগেছে। আতেলদের একটা জিনিসই থাকে আঁত। যা হালে হয়েছে অনুভূতি এবং যা প্রায়শই আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে। মোদ্দাকথা হচ্ছে, তারা কবি হওয়ার আগে কবি সেজে যাচ্ছে।
এসব কবিদেরও স্টিকার আছে। কী সে স্টিকার। ওই যে, কিছু মুখস্ত করা তত্ত্ব। পরাবাস্তবতাসহ নানা পরা’র কচকচানি। যা মূলত অপরের কাছ থেকে ধার করা। অথচ তাদের লেখা পড়তে গেলে চোখ গোল হয়, মাথা ঘুরে যায় এবং ভিড়মি খাওয়া আবশ্যিক হয়ে ওঠে। তারা একেই তাদের সাফল্য ভাবেন। আড়ং এর ব্যাপারটাও তাই। অন্য বিরক্ত হলেও প্রদর্শনবাদীরা সেই স্টিকার দেখিয়ে আত্মতৃপ্তি পায়। সেই কবিরাও ভড়ং এর স্টিকার লাগানো এবং মানুষের ভিড়মি খাওয়া লেখাতেই আত্মতৃপ্তি খোঁজে।
আজ থাক। শেষ করি একটা প্রশ্ন দিয়ে। অবশ্য প্রশ্নটি হাইপোথিটিক্যাল এবং সিরিয়াস ভাবে নেয়ার কিছু নেই। বলি, রবীন্দ্রনাথ আড়ং এর চাকরি প্রার্থী হলে কী হতো?
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।