আমিনা সুলতানা সানজানা
আমিনা সুলতানা সানজানা :
মূল গেইটের ঠিক ডান সাইডটায় যেখানে কয়েকটি গাছ ঝোপের মতো তৈরি করেছে, ওইখানে গাড়িটা রেখে শীলার গতিবিধি দেখছিল রাতুল। ময়নার মা বলছিল রাতুলকে, "আফনে চলে যাওয়ার পর আফা কিছু খাওন দাওন লইয়া পতিদিন বাইর হয়। কোনদিন নুডুলস কোনদিন কাবাব! আফনে আবার আফারে কইয়েন না ভাইয়া, আমি গরীব মানুষ। আমার চাকরি খাইলে আমার বাইচ্চারা না খাইয়া মরবো।"
"আচ্ছা যাও তুমি, আমি দেখবো।" চিন্তিত মুখে ময়নার মাকে আপাতত বিদায় করলো রাতুল। কিন্তু নিজে ঠিক বিশ্বাস করতে পারলো না!
সাত বছরের বিবাহিত জীবন রাতুল ও শীলার। দুজনই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসমেট। ভালো লাগা থেকে ভালোবাসা, তারপর বিয়ে। বিয়ের পর ছিমছাম জীবন। দুজনই চাকরি করে, তেমন কোন ইস্যু নেই জীবনে। এর মধ্যেই বছর দেড় বছর পর কনসিভ করলো শীলা। আনন্দের জোয়ার বয়ে গেল যেন ওদের জীবনে। যথা সময়ে সব আলোকিত করে দিয়ে মায়ের কোল জুড়ে এলো ছোট্ট সোনা মনি প্রভা।
প্রভার দেখাশোনা ঠিক ভাবে যেন হয়, তাই নিজের ক্যারিয়ার সেক্রিফাইজ করলো শীলা। অবশ্য সারাদিন মেয়ে প্রভার সাথে কাটানো সময়টাই তার বেশি ভালো লাগতো! প্রভার তুলতুলে গাল, ছোট ছোট হাত, সময়-অসময় কান্না এই ছিল শীলার স্বর্গ। অফিস শেষে রাতুল এসেও যোগ দিতো মা মেয়ের আড্ডায়। হ্যাঁ ছোট হলে কি হবে, আও-উ-উ করে খুব আড্ডা দিতো মা মেয়ে। আর বাবাকে দেখলে সব আহ্লাদ তখন বাবার কোলে, মাকে যেন চেনেই না। শীলা কপট রাগে বলতো তখন, "কি পাজি মেয়েরে, বাবাকে পেয়ে আমাকে বেমালুম ভুলে গেছে!" হাসি আনন্দে কি অসাধারণ ছিল সেই দিনগুলি।
প্রভার তখন সবে আড়াই বছর একদিন বিকেলে ছাদে গেলো মা মেয়ে। প্রায় বিকেলে ছাদে ঘুরতে যেতো ওরা দুজন। মেয়ে নিজের মতো টুক টুক করে হাঁটে সাথে সাথে শীলা থাকে, মুগ্ধ হয়ে দেখে মেয়ের কান্ড। সন্ধ্যা প্রায় হয় হয়, ছাদে শুকাতে দেয়া কাপড় তুলছে শীলা। কয়েক মিনিটের বিষয়, এর মধ্যে একটা ওড়নার টারসেল বাজে ভাবে পেঁছিয়ে গেছে রশিটা যে রডের সাথে বাধা সেখানে এক তারের সাথে। খুলতে বেগ পেতে হলো শীলার। ছোট্ট প্রভা চোখের আড়াল এই কয় মিনিট!
কিন্তু পিছন ফিরতেই বুকে কাঁটা বিধলো যেন, কোথাও নেই ছোট্ট সোনামনি প্রভা। শীলার কোমড় পর্যন্ত প্রাচীর দেয়া ছাদে, নিরাপদ ছাদ। তবুও দৌঁড়ে গেল প্রাচীরের এক পাশে, ছয় তলা ছাদ থেকে দেখতে একটুও কষ্ট হলো না নিচের ছোট্ট নিথর দেহটাকে। সাদা ফ্রক রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ততক্ষণে চারপাশে চিৎকার শুরু হয়ে গেছে।
আগের দিন ছাদে বারবিকিউ করেছিল এক দল। ইট দিয়ে বানানো হয়েছিল চুলা। সেই ইট রাখা ছিল প্রাচীরের এক পাশে। ছোট্ট সোনামনিটা মনে হয় সেই ইট বেয়ে বেয়ে দেখতে চেয়েছিল কি হয় নিচে। ওদিকে ওড়নার টারসেল ঠিক করতেই ব্যস্ত ছিল শীলা। তাই নিজেকেই এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী মনে করে সে। কোন ভাবেই তাকে বুঝানো যায়নি আর এটা একটা দুর্ঘটনা! মায়ের মন, মানবেও বা কেন?
কত টুকরো স্বপ্ন, কত ত্যাগ, কত ভালোবাসার ফল একটি সন্তান, তা মা মাত্রই জানে। তারপর যখন এমন কিছু হয়, তখন তা মেনে নেয়া যায় কি?
এরপর থেকেই শীলার আচরণ পরিবর্তন হতে থাকে অনেক। দূরত্ব বাড়তে থাকে রাতুলের সাথে। প্রথম প্রথম শীলার কষ্ট রাতুলের কষ্ট এক রকমই ছিল। কিন্তু দিনের সাথে সাথে রাতুল স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারলেও, শীলা আর পারলো না।
নিজের প্রতি সংসারের প্রতি কোন যত্ন নেই, কারো সাথে যোগাযোগ করতেও পছন্দ করে না আর আগের মতো। রাতুল আবার বাচ্চা নেয়ার কথা বললেও, শীলা কেমন জানি নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে এতো বছর।
ভ্রমণ, পছন্দের জামা, আত্মীয়দের সাথে আড্ডা দেয়া কোন কিছুই আর শীলাকে স্বাভাবিক জীবনে আনতে পারলো না।
আজ হঠাৎ শীলার এই গোপন অভিসারের কথা শুনে রাতুলের আর বুঝতে বাকি রইলো না, তাদের বিবাহিত জীবনে তৃতীয় জনের আগমন ঘটেছে। হয়তো এই সম্পর্কের ইতি হচ্ছে খুব শীঘ্রই। যার সব কিছু খারাপ লাগে, সে গোপনে কারো জন্য খাবার নিয়ে যাওয়া মানে অবশ্যই কোন গভীর বিষয়। রাতুলও ঠিক করে ফেলেছে, আজ গোপনে সে সব দেখবে। প্রয়োজনে ভিডিও করে শীলার বাবা মাকে পাঠাবে।..... "দেখেন আপনার মেয়ের কুকীর্তি। সে নাকি বিষন্নতায় আছে, তাই তো স্বামী অফিসে গেলে লুকিয়ে লুকিয়ে গোপন প্রেমে সুখ খুঁজে পায়!"
ভীষণ অস্থিরতা কাজ করছে রাতুলের ভিতর। ঘড়িতে এগারোটা দশ, গাড়িটা আড়াল করে বউয়ের জন্য অপেক্ষা করছে রাতুল বাইরে। আজ ধরবে চোর, এমন একটা অনুভূতি! ঠিক এগারোটা বাইশে গেইট দিয়ে বের হলো শীলা। খুব সাদামাটা পোশাক, ঘোমটা দেওয়া। নজরকাড়া কোনো সাজ নেই। রাতুল মনে মনে ভাবছে এটা একটা ফাঁদ নিশ্চয়ই, যাতে কারো এতো চোখে না পরে।
শীলা একটা রিক্সা নিলো, রাতুলের গাড়ি চলল ঠিক তার পিছন পিছন। যেন চোর পুলিশ খেলা। বেশি দূর না মোড়ের রাস্তাটা পার হয়ে গলির ভেতর ঢুকে গেল রিক্সাটা। আহা সেখানে আবার গাড়ি ঢুকে না! কোনভাবে একটা দোকানের সামনে গাড়ি পার্ক করে শীলার খোঁজে গলির ভেতর গেল রাতুল। কিন্তু ততক্ষণে আর খোঁজ নেই শীলার। আতিপাতি করে অনেক খুঁজেও বুঝতে পারলো না সে কোথায় গেছে অভিসারে। অহেতুক ফিরে এসে গলির সামনে গাড়িতে বসে খেয়াল রাখছে তার ফিরে আসার। যদি দেখা যায় সাথে কাউকে, যার জন্য শীলার এতো গোপনীয়তা।
নাহ, একটা নাগাদ একাই ফিরে এলো রিক্সা করে শীলা। আগামী কালের অপেক্ষায় রাতুলও অফিস মুখো হলো মনে রাজ্যের প্রশ্ন নিয়ে।
রাতে বাড়ি ফিরে সব যেন খুব স্বাভাবিক। একই বিছানায় শুয়েও আজ তারা দুজন দূরে। রাতুল মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, শীলার যদি এখন অন্য কাউকে ভালো লাগে, অন্য কারো মাঝে যদি সে সুখ খুঁজে পায়, তাহলে সেটাই হোক। জোর করে কাউকে বেঁধে রাখা যায় না। এসব ভাবতে ভাবতে সারারাত আর ঘুম হলো না তার। পাশেই আরাম করে ঘুমাচ্ছে তার স্ত্রী। বিবাহিত জীবনের এর চেয়ে বড়ো বিড়ম্বনা মনে হয় আর হয় না, একই সাথে জীবন কাটাতে এসে একই বিছানায় যোজন যোজন দূরত্ব।
আজকে আর গাড়ি নিয়ে ভুল করেনি রাতুল। যতটা সম্ভব আড়ালে থেকে শীলার পিছু নিলো সে। গলিতে ঢুকতেও কষ্ট হলো না। এরপর আরো দু গলি। তারপর ছোট্ট একটা কিন্টারগার্ডেন স্কুল। সারে এগারোটায় স্কুল ছুটি হতেই চার পাঁচ বছরের ছোট্ট একটা মেয়ে বের হয়ে দৌঁড়ে এলো শীলার কাছে। অন্য বাবা মায়েরা তাদের এই বয়সী বাচ্চাদের নিয়ে গেল বাড়ি। দূর থেকে রাতুল দেখছে শীলা কত আদর নিয়ে খাইয়ে দিচ্ছে বাচ্চাটাকে। এতো খারাপ লাগছে রাতুলের নিজের কাছেই! কি বাজে চিন্তা করেছে সে! না জেনে না বুঝে একটা সিদ্ধান্তের মাপকাঠিতে ফেলে দিয়েছে নিজের স্ত্রীকে!
পরে স্কুলের দাড়োয়ানের কাছে জেনে নিলো বাচ্চাটার বাবা মা নেই। তার চাচা আসে অনেক লেট করে, এই সময় ম্যাডাম এসে তাকে খাওয়ায় গল্প করে। সবাই জানে ম্যাডামের বাচ্চা মারা গেছে। তাই কেউ কিছু বলে না তাকে। বাচ্চার চাচাও অনুমতি দিয়েছে।
গলির মুখে শীলা রাতুলকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে গেল। রাতুল কাছে আসতেই শীলা মাথা এলিয়ে দিলো রাতুলের কাঁধে। এতোদিনের লুকিয়ে রাখা অভিসার সামনে আসতেই শরীর যেন ছেড়ে দিলো তাকে। অসুস্থ স্ত্রীকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে রিক্সায় চলল তারা নিজের ঘরে। এই সমস্যার সমাধান জানা নেই রাতুলের, মলম হয়তো দিতে পারবে শুধু। তবে তাই হোক।
রিক্সার বাইরে শীলার ওড়নার টারসেলটা উড়ছে বাতাসে, রাতুল এক দৃষ্টিতে সেখানেই তাকিয়ে রইলো।