কাকন রেজা।
কাকন রেজা :
সেরাম- এর সাথে যখন চুক্তি হয় তখন আমরা বলেছিলাম, বিষয়টি নিয়ে ভাবতে। কারণ চুক্তির প্রক্রিয়াটিই মূলত ছিলো গোলমেলে। চুক্তিতে সেরাম এর অপরপক্ষ বাংলাদেশ সরকার না বেক্সিমকো এ নিয়ে একটা ধোঁয়াশা ছিলো। আমরা বুঝেছিলাম এই চুক্তির ভবিষ্যত ভালো নয়। আজ সে কথা প্রমানিত। আজকে সংসদীয় কমিটি মামলা করার কথা ভাবছে সেরাম এর বিরুদ্ধে। এই মামলার চিন্তা হলো একধরণের অসহায়ত্ব। এই আলাপ অসহায়ের আক্ষেপ।
আমরা যখন বলেছিলাম ভারতীয় সেরাম ইনস্টিটিউটের সাথে চুক্তির ধরণ নিয়ে, তখন এই চুক্তির পক্ষে গুনকীর্তন করছিলেন একপাল কীর্তনীয়া। সাথে গাইছিলেন আমাদের দোষ। আজকে যখন দ্বিতীয় ডোজের প্রায় ১৪ লাখ টিকার ঘাটতি, তখন কীর্তনীয়াদের গলায় অন্য সুর। তারা আছেন ‘পঙ্গপাল’ কাহিনি নিয়ে।
ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে বাড়ি যান অসুবিধা নেই। ‘রেন্ট এ কার’ থেকে গাড়ি ভাড়া নিয়ে যান কথা নেই। অসুবিধা আর কথা কেবল গরীব মানুষদের বেলায়। ঈদে নিজ পরিবারের সাথে মেলার সাধ শুধু ধনীলোকদেরই রয়েছে। না হলে গরীবদের বাড়ি যাবার কেন বাস্তব সঙ্গত কোনো ব্যবস্থা নেই। কেন তাদের ভিড় করে ফেরিতে উঠতে হচ্ছে। এ প্রশ্নগুলো না করে সেই কীর্তনীয়া’গণ গরীব মানুষদের আখ্যায়িত করছে ‘পঙ্গপাল’ হিসেবে। কথা অবশ্য ভুল নয়, তারা গরীবদের পোকামাকড়ই মনে করে। যার ফলে অনুমোদনহীন কার্গো লঞ্চকে মেরে দেয়। প্রাণ হারান প্রায় ডজন তিনেক ‘পোকামাকড়’। ‘পঙ্গপালে’র একাংশ। অবৈধ স্পিডবোড ডুবে মারা যান আরো ডজন দুয়েক ‘কীটপতঙ্গ’। এরাও ‘পঙ্গপালে’র একাংশ। ‘পঙ্গপাল’, ‘পোকামাকড়’, ‘কীটপতঙ্গ’- এই শ্রেণির জান-জীবন-জবানের পরোয়া করে কে। এরা মরলেই ভালো, বেঁচে থাকলেই সমস্যা, সারাক্ষণ নানা দাবি তুলবে। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের দাবি। যারা মানুষকে ‘পঙ্গপাল’ বলেন তাদের চিন্তা এর চেয়ে বেশি মসৃণ না হবারই কথা।
তাই তাদের সেরাম এর টিকা প্রাপ্তি নিয়ে চিন্তা নেই। তারা তো সুরক্ষিত। তাদের সবাই টিকা পেয়ে গেছেন। যারা পাননি, তারা নেননি বলেই পাননি। তারা জানেন, চাইলে বিশেষ ব্যবস্থায় টিকা নিশ্চিত হবে। সুতরাং কত ডোজ কার কম হলো। কে পেলো, আর কে না পেলো, তাতে তাদের কী। এটা লেখার কী আছে। প্রথম ডোজের টিকা প্রদান বন্ধ। দ্বিতীয় ডোজের টিকা নেই। মেসেজ পেয়েও দ্বিতীয় ডোজের টিকা দিতে গিয়ে না পেয়ে বিক্ষোভ হয়েছে। এ খবরটিও সব মাধ্যমে আসেনি। আর আসবেই বা কেন, ‘পঙ্গপাল’দের নিয়ে ভাবনার কী আছে। তবে ফেরিতে ধনীদের গাড়ি আটকে যাচ্ছে। ‘পঙ্গপাল’রা গাড়ি উঠতে দিচ্ছে না। বাড়িতে পৌঁছতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। তাই ফেরির ‘পঙ্গপাল’দের নিয়ে লেখা।
চিন্তা করা যায় একটা ব্যবস্থায় বৈষম্য কত প্রকট হলে, মানুষকে ‘পঙ্গপাল’ হিসেবে আখ্যায়িত করার ধৃষ্ঠতা দেখানো সম্ভব হয়। একটা শ্রেণি আমজনতার থেকে কতটা আলাদা হলে এমনটা হতে পারে। একটা সিস্টেম গুটি কয়েক ধনীদের সুবিধা দিতে গিয়ে দেশের সিংহভাগ মানুষ যারা গরীব তাদের কতটা হেলাফেলা করেছে এই ‘পঙ্গপাল’ শব্দটি তারই প্রমান। এই মানুষদের গ্রামের বাড়ি যেতে হবে, কারণ কর্মহীন এ শহর তাদের পালবে না। পেটে ভাত দেবে না। তাদের বাধ্য হয়েই ফিরতে হবে উৎসের কাছে। পশুও মৃত্যুর সময় নিজ আশ্রয়ের কাছে ফিরে যেতে চায়। আর মানুষ, সেতো চাইবেই।
অনেকে বলবেন, তারা তো সাহায্য পাচ্ছেই। তাদের বলি, আড়াই হাজার টাকায় কয়জনের কতদিন চলে তার একটা হিসেব দিন। আপনাদের আড়াই হাজার টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে যদি বলা হয়, এ দিয়েই লকডাউনের সমান দিন পাড়ি দিতে হবে, তখন কী করবেন? অভিজাত রেস্তোরাঁর একবেলার খাবার কি হবে আড়াই হাজারে? আপনার এক বেলার খাবারই হয় না আড়াই হাজারে, আর তাদের বেলায় বলেন, সাহায্য তো পাচ্ছেই! বৈষম্য নিরসনের জন্যই মানুষ রাষ্ট্র গড়েছে। মানুষ নাগরিক হয়েছে নিজেদের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসা-শিক্ষা নিশ্চিত করতেই। না হলে রাষ্ট্রের কী প্রয়োজন।
জানি, অনেক সময় রাষ্ট্রও অসহায় হয়। রাষ্ট্র ব্যবস্থা অনেক সময় ব্যর্থ হয়। আর সেই ব্যর্থতাকে সফলতায় উত্তীর্ণ করতেই যারা বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করেন তাদের কথা বলতে হয়। সফলতা নিয়ে আলাপ না করলেও চলে। কারণ রাষ্ট্র সৃষ্টির উদ্দেশ্যই হচ্ছে সফল হওয়া। আর ব্যর্থ হলে সব সৃষ্টিই বিফলে যায়। সুতরাং ব্যর্থতার ক্ষেত্র চিহ্নিত এবং তাকে সফল করার চেষ্টাই হলো বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ। বুদ্ধিজীবীদের আলাপটাও হওয়া উচিত তাই নিয়ে।
আমাদের এখন অন্যতম কাজ হচ্ছে টিকা প্রাপ্তি নিশ্চিত করা। কারণ লকডাউন সাময়িক, দীর্ঘ মেয়াদি সমাধান নয়। কাগজে দেখলাম স্পেন করোনাজনিত বাধানিষেধ তুলে নিয়েছে। মানুষেরা এ উপলক্ষে উৎসব করছে। ইসরায়েলও তুলে নিয়েছে সকল নিষেধাজ্ঞা। নিউইয়র্কেও মাস্ক ব্যবহারে ক্ষেত্রে শিথিলতা ঘোষণা করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এর কারণ হলো, তারা ৮০ ভাগ মানুষকে টিকার আওতায় এনেছে। যার ফলে সৃষ্টি হয়েছে হার্ড ইমিউনিটি। এসব দেশে-জায়গায় মানুষ করোনার অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে শুরু করেছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় চলছে এখন নিদানকাল। ভারতের অবস্থাকে ম্যাসাকার বলা যায়। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি টিকা উৎপাদনকারী দেশ ভারত। অথচ তাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা সক্ষম হয়নি সেই উৎপাদনকে সঠিক ব্যবহার করতে। তারা তাদের প্রস্তুতি নেয়নি। মোদি সরকারের বাগাড়ম্বরই চলেছে বছর ধরে। কথিত উন্নয়নের বাগাড়ম্বর। যার ফলেই মৃত্যুপুরিতে পরিণত হয়েছে খোদ রাজধানী দিল্লিসহ ভারতের কয়টি রাজ্য। ভারত হলো আমাদের ঘাড়ের উপর। চারিদিকে আমরা ভারত দ্বারা বেষ্ঠিত। সুতরাং আমাদের বিপদও কম নয়। আসন্ন সেই বিপদ মোকাবেলায় আমাদের প্রস্তুতি কী?
সেই প্রস্তুতির ব্যাপারে আলাপ নেই। আছে কেবল গরীব মানুষদের খোয়ারবন্দী করার চিন্তা। ‘পঙ্গপাল’ বলে তাদের ব্যঙ্গ করা হচ্ছে। মনুষ্যত্ব চরম অপমানিত হচ্ছে এমন ব্যঙ্গে। আর যারা করছেন, তারাও মানুষের দলছুট হয়ে ক্রমেই পরিণত হচ্ছেন একেকজন ‘ঊনমানবে’।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।